শরিফুল কসাইয়ের বিচার দাবিতে উত্তাল হাড়াভাঙ্গা

শিশু নির্যাতনের ঘটনায় স্থানীয় শরিফুল ইসলাম ওরফে শরিফুল কসাইয়ের বিচারের দাবিতে সরব হয়েছে মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার হাড়াভাঙ্গা গ্রামের বাসিন্দারা।
আধিপত্য বিস্তার, মাদকের ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ, চাঁদাবাজি, অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়ে অর্থ উপার্জনসহ বহু অভিযোগ এনে যেকোনো মূল্যে শরিফুলের গ্রেপ্তার চেয়েছেন বিক্ষুব্ধ লোকজন।
যে ঘটনায় ক্ষোভের বিস্ফোরণ
গত ২৮ অক্টোবর শ্রেণিকক্ষের বেঞ্চে বসাকে কেন্দ্র করে ঝগড়া বাঁধে হাড়াভাঙ্গার ডিএইচ ফাজিল মাদ্রাসার প্রথম শ্রেণির ছাত্র ইসমাইল হোসেন ও সায়েম হোসেনের মধ্যে। বিষয়টি জানাজানি হলে সায়েমের বাবা আলমগীর ও চাচা শরিফুল কসাই মাদ্রাসায় ঢুকে ইসমাইলকে বেধড়ক মারপিট করে। তাকে আছাড় দিয়ে ফেলে জখম করে। ওই সময়ে মাদ্রাসার শিক্ষকরা হামলাকারীদের প্রতিরোধ করেননি বলে অভিযোগ করেন বিক্ষুব্ধ স্থানীয় বাসিন্দরা। তাঁরা ওই দিনই মাদ্রাসার প্রধান ফটক বন্ধ করে বিক্ষোভ করেন।
কসাই শরিফুল নামকরণ যেভাবে
হাড়াভাঙ্গা গ্রামের প্রয়াত সোলায়মান হোসেনের ছেলে শরিফুল ইসলাম। প্রায় ১৫ বছর আগে কসাইয়ের কাজ শুরু করার পর তাঁর নামের সঙ্গে যোগ হয় কসাই শব্দটি। হাড়াভাঙ্গা গ্রামের সেন্টারপাড়ায় গরু-ছাগলের মাংস বিক্রি তাঁর পেশা।
শরিফুলের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ
স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০০০ সালে একটি পিস্তলসহ নিজ বাড়ি থেকে শরিফুলকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ। তখন এলাকার মানুষের কাছে চাঁদাবাজিসহ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিষয়টি স্পষ্ট হয়।
অস্ত্র মামলায় হাজতমুক্ত হয়ে শরিফুল আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে। তাকে ঘিরে সন্ত্রাসীদের আনাগোনা বৃদ্ধি পায়। এলাকার বিভিন্ন অপকর্মে তাঁর প্রকাশ্য আধিপত্য সৃষ্টি হলেও গ্রামের মানুষ তাঁর ভয়ে জড়সড় হয়ে পড়ে। একসময় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ পদও জোটে তার ভাগ্যে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাড়াভাঙ্গার কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, কাজীপুর-সহড়াতলা সীমান্ত এলাকার চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বেশ সখ্য ছিল শরিফুল কসাইয়ের। ২০০৫ সালে কাজীপুর থেকে ফেনসিডিল নিয়ে খলিশাকুণ্ডি যাওয়ার পথে বালিয়াঘাট এলাকা থেকে পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে। এরপর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও মাদক ব্যবসার পাশাপাশি সম্প্রতি পল্লী বিদ্যুতের দালালির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে শরিফুল কসাই।
ভুক্তভোগী কয়েকজন জানান, কাজীপুর ইউনিয়নে পল্লী বিদ্যুতের সংযোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে শরিফুলের একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল। তার ইশারা ছাড়া কোনো ব্যক্তি মিটার পায়নি। সে গ্রাহকদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে লাখ লাখ টাকা।
ভুক্তভোগীরা আরো জানান, কিছুদিন আগে থেকে পল্লী বিদ্যুতে দালালদের দৌরাত্ম্য কিছুটা কমে গেলে বিপাকে পড়ে শরিফুল কসাই। এতে বিপাকে পড়েন তার কাছে টাকা দেওয়া নতুন সংযোগপ্রত্যাশী ব্যক্তিরাও। মিটার কিংবা টাকা ফেরত চাইতে গেলে তাঁদেরও নানাভাবে হুমকি-ধমকি দেয় শরিফুল।
হাড়াভাঙ্গা মোল্লাপাড়ায় বেশ কয়েকজনের বাড়িতে নতুন সংযোগ দেওয়ার জন্য এক লাখ টাকা নেয় শরিফুল। মিটার না পেয়ে ওই টাকা ফেরত চাইলে মোল্লাপাড়ার গফুরসহ কয়েকজনকে প্রাণনাশের হুমকি দেয় সে। কিছুদিন আগে শরিফুলের দাপটে তাঁরা মুখ বুজে থাকলেও এখন টাকা আদায়ে সোচ্চার হয়েছেন।
শরিফুল এখন
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শিশু নির্যাতনের ঘটনায় শরিফুল বিপাকে পড়েছে। এতদিন শরিফুলের বিরুদ্ধে কেউ মামলা না করলেও পুলিশের ভূমিকায় গ্রামের মানুষ সজাগ হয়েছে। তারা ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ফলে অনেকটাই একঘরে অবস্থায় রয়েছে শরিফুলের পরিবার। ঘটনার পর থেকেই সে ও তার ভাই আলমগীর আত্মগোপনে গেছে।
বিক্ষুব্ধ গ্রামবাসীর অবস্থান
স্থানীয় কয়েকজন অভিযোগ করে বলেছেন, গ্রামবাসী ঐক্যবদ্ধ হলেও শরিফুলের চাচাতো ভাই বজলু মিয়া তাকে আশ্রয় দিয়েছেন। বজলুর মাধ্যমে সে অন্যত্র অবস্থান করছে। তাদের অভিযোগ, শিশু ইসমাইলের পরিবারকে বাগে আনতে মধ্যস্থতার চেষ্টা করছেন বজলু। গ্রামবাসীর আক্রোশ থেকে রক্ষা পেতে বাড়ির সব আসবাবপত্র বজলু মিয়া ও শওকত আলীর বাড়িতে রেখেছে শরিফুল কসাইয়ের বাড়ির লোকজন। তাঁদের দুজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে শরিফুল ও তার ভাই আলমগীরের সন্ধান মিলবে বলে জানান গ্রামের অনেকেই।
গ্রামের লোকজন ডিএইচ ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ আবদুর রাজ্জাকের বিরুদ্ধেও বেশ কিছু অভিযোগ তুলেছেন। শরিফুলের মতো মানুষকে ‘ম্যানেজ’ করেই আবদুর রাজ্জাক নিয়োগ-বাণিজ্য করে বিত্তবৈভব গড়ে তুলেছেন বলে অভিযোগ গ্রামবাসীর। এ কারণে তাঁর সামনেই ইসমাইলকে নির্যাতন করা হলেও তিনি প্রতিবাদ করেননি। উপরন্তু শরিফুলকে নির্বিঘ্নে মাদ্রাসা থেকে সটকে পড়তে সহযোগিতা করেছেন। তাই কোনো অবস্থাতেই আবদুর রাজ্জাককে মাদ্রাসায় ঢুকতে দেওয়া হবে না বলে ঘোষণা দিয়েছেন তাঁরা।
পুলিশের বক্তব্য
এ বিষয়ে জানতে চাইলে গাংনী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আকরাম হোসেন বলেন, শিশু নির্যাতন মামলার আসামি শরিফুল কসাই, তার ভাই আলমগীর হোসেন ও মাদ্রাসার অধ্যক্ষ আবদুর রাজ্জাক এখন পলাতক। তবে তাদের গ্রেপ্তারে পুলিশের পক্ষ থেকে জোর চেষ্টা চালানো হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, শিশু নির্যাতনকারীরা কোনোভাবেই যেন ক্ষমা না পায়, সে জন্য পুলিশের আন্তরিকতার কোনো অভাব নেই।