ঘুষ কেলেঙ্কারির মামলা

এনামুল বাছির জীবনে ১০ টাকা ঘুষ নেননি : শুনানিতে ভাই

Looks like you've blocked notifications!
দুদকের সাময়িক বহিষ্কৃত পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছিরকে আজ মঙ্গলবার আদালত থেকে কারাগারে নিয়ে যায় পুলিশ। ছবি : ফোকাস বাংলা

৪০ লাখ টাকার বেশি ঘুষ কেলেঙ্কারির ঘটনায় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সাময়িক বহিষ্কৃত পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছিরের জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। আজ মঙ্গলবার ঢাকার জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ কে এম ইসরুল কায়েশ এ আদেশ দেন।

এদিকে আজ দুপুরে রাজধানীর শাহবাগ থানা থেকে পুলিশি পাহারায় দুদকের পরিচালক এনামুল বাছিরকে আদালতে হাজির করে পুলিশ। এরপর দুপুর ২টায় ঢাকার জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ আদালতে এনামুল বাছিরকে হাজির করে পুলিশ। পৌনে ৩টায় বিচারক মামলার শুনানির অনুমতি দিলে এনামুল বাছিরকে কাঁঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়।

শুনানির প্রথমে এনামুল বাছিরের আইনজীবী কবির হোসাইন আদালতকে বলেন, ‘এনামুল বাছির দুদকে ২৮ বছর ধরে চাকরি করছেন। চাকরি জীবনে তাঁর বিরুদ্ধে কখনো ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ আনা হয়নি। তাঁর বিরুদ্ধে কোনো অসততার অভিযোগ নেই। ডিআইজি মিজান চক্রান্ত করে এনামুল বাছিরের বিরুদ্ধে ঘুষ গ্রহণের মিথ্যা অভিযোগ এনেছেন।

ডিআইজি মিজানের সঙ্গে এনামুল বাছির টেলিফোনে কোনো কথা বলেননি। এনামুল বাছির ডিআইজি মিজানের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন বলে যে দাবি করা হচ্ছে, তা মোটেও সঠিক নয়। মিজানের দাবি করা অডিওতে কণ্ঠ যাচাই করার জন্য এনামুলের কণ্ঠ নেওয়া হয়নি।

পদোন্নতি সংক্রান্ত ব্যাপার নিয়ে এনামুল বাছির উচ্চ আদালতে রিট আবেদন করেন। এই কারণে ষড়যন্ত্র করে তাঁকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয়েছে। এ মামলার একটি ঘটনাস্থল দেখানো হয়েছে রমনা পার্ক। এনামুল বাছির একজন শিক্ষিত ব্যক্তি। ডিআইজি মিজানও শিক্ষিত। রমনা পার্কের মতো জায়গায় ঘুষের টাকার লেনদেন মোটেও বিশ্বাসযোগ্য নয়।’ শুনানিতে বলেন আইনজীবী কবির হোসাইন

এরপর এনামুলের আরেক আইনজীবী কামাল হোসেন বলেন, মোট পাঁচটি অডিও প্রকাশ হয়েছে। এখানে একটি অডিওর বিষয়ে তদন্ত হচ্ছে। বাকি চারটি অডিওর বিষয়ে তদন্ত হচ্ছে না। সেই চারটি অডিও নিয়ে দুদক কোনো প্রশ্ন করছে না। গত বছর এনামুলের প্রমোশন হওয়ার কথা। কিন্তু সে প্রমোশন ঠেকানোর জন্য এই ষড়যন্ত্র করা হয়েছে।

আইনজীবী কামাল বলেন, ডিআইজি মিজানের বিরুদ্ধে যে তদন্ত রিপোর্ট দেওয়ার কথা ছিল তার ১৫ দিন আগে আমি (এনামুল বাছির) হাইকোর্টে রিট করেছি। প্রথমে আমার বিরুদ্ধে ঘুষের অভিযোগ আনা হয়নি। একটি অনলাইন পত্রিকায় যে অডিও প্রকাশিত হয়েছে তাতে ম্যাকানিজম রয়েছে।

কামাল আরো বলেন, এনামুল বাছিরের স্যালারি অ্যাকাউন্ট ছাড়া আর কোনো অ্যাকাউন্ট বাংলাদেশ ব্যাংক পায়নি। এর আগে ডিআইজি মিজানের মামলা তদন্ত করার জন্য দুদকের আরেকজন ডেপুটি ডাইরেক্টর নিয়োগ করা হয়েছিল। তিনি  যখনই প্রতিবেদন দিতে যাবেন ঠিক তখনই সেই দুদক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ডিআইজি মিজান একই ধরনের ঘুষের অভিযোগ এনেছেন। এটা ডিআইজি মিজানের চরিত্র। তাঁর বিরুদ্ধে যেন কেউ প্রতিবেদন দিতে না পারেন, তাই ডিআইজি মিজান দুদককে জিম্মি করে রেখেছেন।

এনামুলের আইনজীবী কামাল বলেন, এনামুল জামিন পেলে বিদেশে পালাবেন না। তিনি অসুস্থ। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিবেদন দিয়ে বলেছে, বেতনের টাকা ছাড়া আর কোনো টাকা তাঁর ব্যাংক হিসাবে নেই।

এরপর এনামুল বাছিরের আপন ভাই খন্দকার এনামুল খায়ের আদালতে শুনানি করে বলেন, মাননীয় আদালত আমি এনামুল বাছিরের ভাই। আমার ভাই চাকরি জীবনে কারো কাছ থেকে ১০ টাকা ঘুষ নেননি। তাঁকে চক্রান্ত করে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয়েছে।

এনামুলের ভাই বলেন, আমি একটি আদালতে সরকারি কৌঁসুলি হিসেবে কর্মরত আছি। এর আগে আমার ভাই যখন দুদকে ছিল তখন আমি দুদকের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) হওয়ার জন্য ভাইয়ের কাছে গিয়েছিলাম। কিন্তু আমার ভাই তাতে সাড়া দেননি। তিনি আমাকে চলে যেতে বলেছেন। আমার ভাইয়ের কোনো অর্থ-সম্পত্তি নেই। যা আছে তা আমাদের পারিবারিক সম্পত্তি।

এনামুলের ভাই আরো বলেন, এনামুল বাছিরের স্ত্রী মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের ভাইস প্রিন্সিপাল আর মেয়ে বিটিভিতে চাকরি করেন। তাঁদের মাসে এখন আয় দুই লাখ টাকা। এত টাকা আয় করার পরও তিনি ঘুষ খাবেন এটা অবান্তর। আমার ভাইয়ের চোখে রক্ত জমে যায়। তিনি খুব অসুস্থ। আমরা সবাই তাঁর জামিনদার হবো। জামিন পেলে তিনি পলাতক হবেন না।

এরপর এনামুল বাছিরের জামিনের বিরোধিতা করে দুদকের কৌঁসুলি মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, অবৈধভাবে তথ্য পাচার ও ডিআইজি মিজানের কাছ থেকে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে দায়ের করা মামলায় গ্রেপ্তার দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছির দেশ থেকে পালানোর চেষ্টা করছিলেন। এ ছাড়া মামলার গুরুত্বপূর্ণ আলামত বিনষ্ট করার হীন চেষ্টাসহ সাক্ষীদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করছিলেন। তাঁকে জামিন দেওয়া হলে মামলার গুরুত্বপূর্ণ আলামত বিনষ্ট করতে পারেন এবং তদন্তকাজে ব্যাঘাত ঘটাতে পারেন।

দুদকের কৌঁসুলি বলেন, হাওয়ার ওপর ভিত্তি করে দুদকের পরিচালক এনামুল বাছিরের বিরুদ্ধে মামলা করেনি দুদক। ঘুষ গ্রহণ, ক্ষমতার অপব্যবহার ও অর্থপাচারের অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়ায় ডিআইজি মিজান ও এনামুল বাছিরের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এ ছাড়া দুদক কারো প্রতিপক্ষ নয়। যদি কেউ প্রতিপক্ষ মনে করেন, তাহলে তিনি ভুল করছেন।

মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, ঘুষ গ্রহণ সংক্রান্ত ডিআইজি মিজানের সঙ্গে এনামুল বাছিরের কথোপকথনের যে অডিও পাওয়া গেছে তার ফরেনসিক প্রতিবেদন এসেছে। ওই অডিওতে এনামুল বাছিরের কণ্ঠ বলে প্রতিবেদনে উঠে আসে। এনামুল বাছির গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। সেই কণ্ঠের সঙ্গে ডিআইজি মিজানের সঙ্গে কথোপকথনে এনামুল বাছিরের কণ্ঠের মিল পাওয়া গেছে। এনামুল বাছিরকে বিপদে ফেলার জন্য দুদক এই মামলা করেনি। টাকার লেনদেন হয়েছে। এখানে রাগ বিরাগের কোনো সুযোগ নেই। তদন্ত চলমান। এনামুল বাছিরকে কারাগারে পাঠানো হোক। 

এরপর উভয়পক্ষের শুনানি শেষে বিচারক এনামুল বাছিরকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।

গতকাল সোমবার রাত সোয়া ১০টার দিকে রাজধানীর দারুস সালামের নিজ বাসভবন থেকে দুদকের একটি দল এনামুল বাছিরকে গ্রেপ্তার করে। দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা প্রণব কুমার ভট্টাচার্য্য এনটিভি অনলাইনকে জানান, গ্রেপ্তারের পর বাছিরকে সারা রাত রমনা থানায় রাখা হয়।

গত মঙ্গলবার দুদকের পরিচালক ও অনুসন্ধান টিমের দলনেতা শেখ মোহাম্মদ ফানাফিল্যা সংস্থার ঢাকা-১ সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে মামলাটি দায়ের করেন। এর আগে দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে ডিআইজি মিজান ও সংস্থার পরিচালক বাছিরের বিরুদ্ধে মামলার অনুমোদন দেওয়া হয়।

গত ৯ জুন একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে প্রচারিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ডিআইজি মিজানের বিরুদ্ধে পরিচালিত দুর্নীতির অনুসন্ধান থেকে তাঁকে দায়মুক্তি দিতে দুদক পরিচালক বাছির ৪০ লাখ টাকা ঘুষের বিনিময়ে সমঝোতা করেন। ডিআইজি মিজান বিষয়টি রেকর্ড করে ফুটেজ ওই চ্যানেলকে দিয়ে দেন।

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, দুদকের এ পরিচালক রাজধানীর রমনা পার্কে বাজারের ব্যাগে করে ডিআইজি মিজানের কাছ থেকে ২৫ লাখ টাকা গ্রহণ করেন এবং বাকি ১৫ লাখ পরবর্তী এক সপ্তাহের মধ্যে দেওয়ার কথা বলেন। সেই সঙ্গে তিনি ছেলেকে স্কুলে আনা-নেওয়ার জন্য একটি গ্যাসচালিত গাড়ি দাবি করেন। এ ছাড়া তিনি কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য অবৈধভাবে পাচার করেন।

এ প্রতিবেদন প্রচারিত হওয়ার পর দুদকের সচিব মুহাম্মদ দিলোয়ার বখতকে প্রধান করে তিন সদস্যের উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করে এবং কমিটি ১০ জুন প্রতিবেদন জমা দেয়। প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে পরিচালক বাছিরকে দুদকের তথ্য অবৈধভাবে পাচার, চাকরির শৃঙ্খলা ভঙ্গ ও সর্বোপরি অসদাচরণের অভিযোগে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করে কমিশন। সেই সঙ্গে ডিআইজি মিজানের দুর্নীতি বিষয়ে অনুসন্ধান কর্মকর্তা হিসেবে ১২ জুন নিয়োগ পান দুদকের আরেক পরিচালক মো. মঞ্জুর মোরশেদ।

অন্যদিকে, ২০১৮ সালে একটি জাতীয় দৈনিকে ডিআইজি মিজানের বিরুদ্ধে এক সংবাদ পাঠিকাকে জোর করে বিয়ে করার সংবাদ প্রকাশের পর বিষয়টি ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি করে। ওই ঘটনায় পুলিশ সদর দপ্তরসহ দুদকে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।

এরপর নানা জল্পনা-কল্পনা শেষে বিতর্কিত ডিআইজি মিজানকে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনারের পদ থেকে প্রত্যাহার করে পুলিশ সদর দপ্তরে সংযুক্ত করা হয়। পরে ২৫ জুন তাঁকে সাময়িক বরখাস্তের কথা সাংবাদিকদের জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

দুদক পরিচালক মঞ্জুর মোরশেদ গত ২৪ জুন তিন কোটি ২৮ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন ও তিন কোটি সাত লাখ টাকার সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগে ডিআইজি মিজানসহ চারজনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। এ মামলায় ১ জুলাই বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি এস এম কুদ্দুস জামানের হাইকোর্ট বেঞ্চ ডিআইজি মিজানের জামিন নামঞ্জুর করে তাঁকে শাহবাগ থানায় হস্তান্তর করেন।