ডেঙ্গু আক্রান্ত ঢাবি ছাত্রী চাঁদনীর বাবা

মেয়েটা বেহুশের মতো পড়ে আছে!

Looks like you've blocked notifications!
ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মহিলা ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী সুমাইয়া সুলতানা চাঁদনী। ছবি : এনটিভি

‘ভাই, আমার মেয়েটা এক সপ্তাহ যাবত বেহুশের মতো পড়ে আছে। বসতে পারে না, দাঁড়াতে পারে না, কোনো কথা বলতে পারে না। মাঝে মধ্যে ডাকে সাড়া দিচ্ছে। একের পর এক শুধু স্যালাইন চলছে। সুস্থ কবে হবে তা জানি না।’

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মহিলা ওয়ার্ডে বসে এভাবে এনটিভি অনলাইনকে কথাগুলো বলছিলেন ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ছাত্রী সুমাইয়া সুলতানা চাঁদনীর বাবা হানিফ ভূঁইয়া। 

আজ শনিবার ঢাকা মেডিকেলের নতুন ভবনের চারটি বিভাগে গিয়ে দেখা যায়, এখানে ডেঙ্গু রোগীতে সয়লাব। ওয়ার্ডের বাইরে, বারান্দায় বা নামাজের স্থানের মেঝে, সিঁড়ির পাশেও তিল ধারণের ঠাঁই নেই। অনেকে রাজধানীর বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে ঠাঁই নাই পেয়ে সরকারি হাসপাতালের সিঁড়িতেও বিছানা পেতেছেন। আশপাশের ওয়ার্ডে, বেডে শত শত শুধু ডেঙ্গু রোগী। সবার মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। 

ঢাকা মেডিকেলের নতুন ভবনের ৮০২ নম্বর ওয়ার্ডে (মহিলা ওয়ার্ড) ভর্তি সুমাইয়া সুলতানা চাঁদনী (২০)। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্রী। বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলে থাকেন। শরীরে প্রচণ্ড জ্বর অনুভব করায় গ্রামের বাড়ি নরসিংদীতে চলে যান। বাড়িতে যাওয়ার পর বাবা-মা ভেবেছিলেন ঠাণ্ডাজনিত কারণে জ্বর। প্রাথমিক চিকিৎসার পরও জ্বর কমে না আসায় নরসিংদী জেলা সদর হাসপাতালে গিয়ে রক্ত পরীক্ষার পরই কপালে ভাঁজ পড়ে বাবা-মায়ের!

হাসপাতাল থেকে বলা হয়, ডেঙ্গুর ভাইরাস রয়েছে শরীরে। এরপরই নরসিংদী থেকে পাঠানো হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেই থেকে এক সপ্তাহ যাবত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৮০২ নম্বর  ওয়ার্ডে ভর্তি সুমাইয়া সুলতানা চাঁদনী। পাশে বসেই সেবা করছেন বাবা-মা দুজন।

এ বিষয়ে চাঁদনীর বাবা হানিফ ভূঁইয়া অনেকটা আবেগ-আপ্লুত হয়ে এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘ভাই আমি একটি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে চাকরি করি। আমার একমাত্র মেয়ে চাঁদনী। এক সপ্তাহ যাবত মেয়েটা বেহুশের মতো পড়ে আছে। বসতে পারে না, দাঁড়াতে পারে না, কোনো কথা বলতে পারে না। মাঝে মধ্যে শুধু ডাকে সাড়া দিচ্ছে। একের পর এক শুধু স্যালাইন চলছে। সুস্থ কবে হবে তা জানি না।’

হানিফ ভূঁইয়া বলেন, দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে চাঁদনী পড়াশুনা করে। কিন্তু সেখানেই মশার প্রকোপ বেশি। আক্রান্ত হয়ে জীবনের সঙ্গে লড়াই করছে। হাসপাতালে চিকিৎসার বিষয়ে হানিফ বলেন, এখানে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। তবে রোগীর তুলনায় সেবিকা নেই। একটি স্যালাইন পুশ করার জন্য নার্সদের কাছে দুই থেকে তিন ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।’

পাশে একই রোগে আক্রান্ত চাঁদপুরের হাইমচর উপজেলার বিঙ্গুলিয়া গ্রামের দশম শ্রেণির ছাত্রী নিপা আক্তার। এক সপ্তাহ আগে জ্বরে আক্রান্ত হলে বড় ভাই সেলিম মিয়া তাকে চাঁদপুর সদর হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানকার চিকিৎসকরা নিপাকে ঢাকায় কোনো হাসপাতালে ভর্তি করার পরামর্শ দেন। ঢাকায় এনে সেলিম মিয়া বোনকে তিনটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করাতে ব্যর্থ হন। শেষ পর্যন্ত তাদের ঠাঁই হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সিঁড়িতে।

পাশের ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, ঢাকার লালমাটিয়া মহিলা কলেজের ইংরেজি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী তাহমিনা জামান অনামিকা (২১)। কলেজ হোস্টেলে থাকাবস্থায় জ্বরে আক্রান্ত হন। প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য  ক্লিনিকে গেলে ধরা পড়ে ডেঙ্গু। এরপরই ভর্তি হন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সিট না পেয়ে ওয়ার্ডের বারান্দায় ঠাঁই হয়েছে তাঁর। চারদিন ধরে এখানে রয়েছেন। পাশে বসে সেবাযত্ন করছেন বড়বোন, বাবাসহ স্বজনরা।

এ বিষয়ে বড় বোন জেবিন এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার পর আমার ছোটবোন অনামিকার শরীরে প্লাটিলেটের পরিমাণ কমে যায়। ঢাকা মেডিকেলে ভর্তির পর প্লাটিলেটের পরিমাণ এখন কিছুটা বেড়েছে।’

পুরুষ ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র শফিকুর রহমান। কবি জসীম উদদীন হলের ১৩১ নম্বর রুমে থাকেন। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে রয়েছেন চারদিন ধরে।  সিট খালি না থাকায় ওয়ার্ডের সামনে গেস্ট রুমের সিটে উঠেছেন। তিনি বলেন, ‘ভাই, পুরো শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা, বমি হচ্ছে। ডাক্তার স্যালাইন দিয়েছেন। এভাবে আর শুয়ে থাকতে পারছি না।’

এ বিষয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের দায়িত্বরত চিকিৎসক রাশেদুল হাসান এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রতিদিন যেসব রোগী ভর্তি হচ্ছে, এর মধ্যে ৯৫ ভাগ রোগীই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত। এখানে রোগীর পরিমাণ এত বেশি যে ডাক্তার নার্স সবাইকে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

জানা গেছে, বেড সংকটের কারণে রাজধানীর অনেক বেসরকারি হাসপাতাল রোগী ফিরিয়ে দিচ্ছে। সেই রোগীগুলো যাচ্ছে সরকারি হাসপাতালে। এর মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সবচেয়ে বেশি ভিড় জমাচ্ছেন রোগীরা। ওয়ার্ডের বাইরে, বারান্দায় বা নামাজের স্থানের মেঝে সিঁড়ির পাশেও তিল ধারণের ঠাঁই নেই।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে চলতি মাসের ২৬ দিনে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১০ হাজার ৫২৮ জন। শুধু ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্ত হয়েছেন ৬৮২ জন।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের দেওয়া তথ্য মতে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে গত ২৪ ঘণ্টায় (২৬ জুলাই সকাল ১০টা থেকে ২৭ জুলাই ১০টা পর্যন্ত) ২৩৩ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ভর্তি হয়েছেন। একদিনে এত ডেঙ্গু রোগী ভর্তি দেশের ইতিহাসে এটাই সর্বোচ্চ!