ব্যাংকে টাকা রাখতে সন্ত্রস্ত ছিলেন ডিআইজি প্রিজন!
উপকারামহাপরিদর্শক (ডিআইজি প্রিজন) পার্থ গোপাল বণিক ব্যাংকে টাকা রাখতে ভীত সন্ত্রস্ত, তাই তিনি বাসায় ৮০ লাখ টাকা রেখেছেন। বর্তমানে শেয়ারবাজারে টাকা হারিয়ে যাচ্ছে। ব্যাংকে টাকা লোপাট হচ্ছে। ব্যাংকে তাই টাকা রাখা নিরাপদ না। তাই তিনি (ডিআইজি প্রিজন) টাকা বাসায় এনে রেখেছেন।
আজ সোমবার ঢাকার জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ কে এম ইমরুল কায়েশের আদালতে বিকেল ৫টায় ডিআইজি প্রিজন পার্থ গোপাল বণিকের আইনজীবী ফারুক আহম্মেদ জামিন শুনানিতে এ দাবি করেন।
আইনজীবী ফারুক শুনানিতে বলেন, এ টাকা পার্থের নিজের আয় করা। তিনি ২০১৮-১৯ সালের অর্থবছরে ইনকাম ট্যাক্স রিটার্ন দাখিল করেছেন। রিটার্নে তিনি এক লাখ নয় হাজার ৫২০ টাকা ট্যাক্স দাখিল করেছেন। আসামির বিরুদ্ধে কেউ কোনো ঘুষের অভিযোগ করে নাই। তাঁকে এ মামলায় ফাঁসানো হয়েছে। এ টাকা বৈধ। তিনি কোনো অপরাধ করেন নাই। এ ছাড়া মানিলন্ডারিংয়ের যে অভিযোগ করা হয়েছে, তার কোনো ভিত্তি নেই। বাংলাদেশের যেকোনো পরিমাণের অর্থ বাসায় রাখা অপরাধ না। তিনি কোনো অপরাধ করেন নাই।
আইনজীবী ফারুক বলেন, ডিআইজি প্রিজন কোনো বিদেশি অর্থ বাসায় রাখেননি। এ ছাড়া তাঁর স্ত্রী ভালোপর্যায়ে চাকরি করেন। তাঁর বাসায় পাওয়া ৮০ লাখ টাকার মধ্যে ৪০ লাখ টাকা শাশুড়ি ও মায়ের। তাঁদের এফডিআর ভেঙে বাসায় আনা হয়েছে। এ টাকা দিয়ে আসামি ঢাকায় ফ্ল্যাট কিনবেন। তাঁকে ষড়যন্ত্র করে ফাঁসানো হয়েছে।
ডিআইজি প্রিজনের পক্ষে অপর আইনজীবী আব্দুর রহমান হাওলাদার বলেন, আসামির ইনকাম ট্যাক্সে দেখানো হয়েছে তাঁর অ্যাকাউন্টে ৩৯ লাখ ৩৩ হাজার ৩৬ টাকা রয়েছে। এ ছাড়া বাকি টাকা শাশুড়ি ও মায়ের। ৮০ লাখ টাকা আসামির কোনো অবৈধ উপার্জন না। ঢাকায় ফ্ল্যাট কেনার জন্য তিনি টাকাগুলো ব্যাংক থেকে টাকা তুলে বাসায় এনেছেন।
এরপর বিচারক ডিআইজি প্রিজনকে বলেন, আপনি ডিআইজি প্রিজন না?
জবাবে ডিআইজি প্রিজন বলেন, হ্যাঁ, আমি ডিআইজি প্রিজন।
এরপর বিচারক প্রশ্ন করেন, আপনার বেসিক সেলারি কত?
আসামি বলেন, আমার বেসিক সেলারি ৩৯ হাজার টাকা।
বিচারক আবারও বলেন, আপনার বেসিক সেলারি শুরুতে কত?
জবাবে আসামি বলেন, ৩৯ হাজার টাকা।
তখন বিচারক বলেন, বেসিক তো ৩৯ হাজার টাকা হওয়ার কথা না।
এরপর বিচারক আবারও প্রশ্ন করে বলেন, আপনার গ্রেডিং কত?
জবাবে আসামি বলেন, আমি পঞ্চম গ্রেডিংয়ে চাকরি করি।
বিচারকের প্রশ্নের পরে আবার ডিআইজি প্রিজনের আইনজীবীরা শুনানি শুরু করেন।
এরপর আরেক আইনজীবী মাসুদ আহম্মেদ তালুকদার বলেন, মাননীয় আদালত, এই মামলায় মানি লন্ডারিং ও দুদক আইনের কথা বলা হয়েছে। মামলায় বলা হয়েছে, একজনের ঘরে ৮০ লাখ টাকা পাওয়া গেছে। এটা কার টাকা? এটা আসামি ডিআইজি প্রিজনের টাকা।
আইনজীবী মাসুদ আহম্মেদ বলেন, মামলায় বলা হয়েছে ঘুষের টাকা। কিন্তু একজনও ভুক্তভোগী অভিযোগ করেননি যে টাকা পাওয়া গেছে তা তাদের টাকা। এটা আসামির ও আরেক আত্মীয়ের টাকা। আমাদের দেশে মাছ ধরে না হুজুর, ডোবা খুঁইজ্জা আসামিকে ধরছে ডোবা খুঁইজ্জা। মানি লন্ডারিং হলে দুদক বাসায় ডলার, ইউরোসহ বিদেশি অনেক অর্থ পেত। এখন বাসায় বাংলাদেশের টাকা রাখা কোন আইনে অপরাধ মাননীয় আদালত? এ টাকা অবৈধভাবে অর্জিত হয়নি। আসামির নিজের টাকা।
আরেক আইনজীবী খোরশেদ আলম শুনানিতে বলেন, কোনো অথরিটি দাবি করেনি যে ডিআইজি প্রিজনকে টাকাটা দিয়েছে। ইতিমধ্যে মাননীয় আদালত পুলিশের ডিআইজি মিজানের বিরুদ্ধে একটা অভিযোগ ছিল, ঘুষের টাকা দিয়েছে। কিন্তু আমার আসামিকে কেউ ঘুষের টাকা দেয়নি। আসামির টাকা হোয়াইট মানি। আসামির যে টাকাটা হোয়াইট, সে সপক্ষে আয়কর রিটার্ন দিয়েছি এবং এনবিআর আমাকে সার্টিফিকেট দিয়েছে।
আইনজীবী খোরশেদ বলেন, অনেকে আছে কোটি কোটি টাকা দিয়ে প্রপারটি কিনতেছে, কিন্তু তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আসতেছে না। আমার আসামিকে কালার করার জন্য মিডিয়া ডেকে মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে এ মামলার কোনো ভিত্তি নেই।
শুনানির সময় বিচারক আবার ডিআইজি প্রিজনকে প্রশ্ন করেন, ডিআইজি সাহেব, একটি প্রশ্নের উত্তর দেন। যে ৩৯ লাখ টাকা আছে সেটা কোথা থেকে এনেছেন? টাকাটা কোথা থেকে এসেছে।
জবাবে আসামি বলেন, পোস্ট অফিস থেকে এফডিআরের টাকা তুলেছি।
বিচারক প্রশ্ন করেন, ইনকাম ট্যাক্সে সেই ৩৯ লাখ টাকার কথা কি বলেছেন?
আসামি বলেন, বেসিক্যালি এটা আমার বেতন-ভাতার টাকা। আমার যে ইনকাম ট্যাক্সের লইয়ার ছিল তিনি এ টাকার কথাটা ট্যাক্স রিটার্নে তুলেন নাই। তাঁর ভুল ছিল।
তখন বিচারক বলেন, আপনি ইনকাম ট্যাক্সে আপনার এফডিআরের বিষয়ে কিছু বলেননি।
এরপর দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল শুনানিতে বলেন, ডিআইজি প্রিজন একজন সরকারি চাকরিজীবী। আয়কর ফাইল অনুযায়ী, এক বছরে তাঁর বেতন থেকে আয় ছয় লাখ ৭৬ হাজার টাকা এবং ১৫ লাখ টাকা তিনি ব্যবসা থেকে আয় করেছেন। একজন সরকারি কর্মচারী কী ব্যবসা করেন? বছরে ছয়-সাত লাখ টাকা বেতন পেয়ে সংসার চালিয়ে কত টাকা সাশ্রয় করতে পারেন যে ৮০ লাখ টাকা তাঁর বাসায় পাওয়া যেতে পারে? টাকাগুলো সবই অবৈধ উপায়ে অর্জন করা।
দুদকের আইনজীবী বলেন, ডিআইজি প্রিজনের অবৈধ সম্পদের তদন্ত করছে দুদক। সে তদন্তের সময়ে তাঁর কাছে ৮০ লাখ টাকার খবর পেলে দুদক অভিযান চালিয়ে সে টাকা জব্দ করে। আমরা তাঁকে রিমান্ডে নিয়ে এ টাকার উৎস আর কোথায় টাকা আছে জিজ্ঞাসাবাদ করব। তাঁর জামিনের ঘোর বিরোধিতা করছি।
এরপর শুনানি শেষে বিচারক আসামির জামিনের আবেদন নাকচ করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
এদিকে আজ বিকেল ৪টায় ডিআইজি প্রিজন পার্থ গোপাল বণিককে আদালতে হাজির করে দুদক। এরপরে তাঁকে আদালতে নিয়ে আসা হয়। উৎসুক বিচারপ্রার্থী ও আইনজীবীদের ভিড়ের কারণে বিচারক আসামি পার্থকে আদালতের হাজতে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। এরপর বিকেল পৌনে ৫টায় ডিআইজি প্রিজন পার্থকে আবারও হাজির করে পুলিশ। এরপর আসামিকে কাঁঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের সহকারী পরিচালক মো. সালাহউদ্দিন কারাগারে পাঠানোর আবেদনে উল্লেখ করেন, ডিআইজি প্রিজন পার্থ সরকারি চাকরিতে কর্মরত থেকে অর্পিত ক্ষমতার অপব্যবহার করে অবৈধ উপায়ে বৈধ পারিশ্রমিকের অতিরিক্ত হিসেবে ঘুষ গ্রহণ করে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত ৮০ লাখ টাকা অর্জন করেন। তা নিজের দখলে নিয়ে অবৈধ পন্থায় গোপন করে পাচারের জন্য নিজ আবাসিক বাসার কেবিনেটে লুকিয়ে দণ্ডবিধির ১৬১ ধারাসহ ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫ (২) ধারা এবং মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর ৪(২) ধারার শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন মর্মে মামলাটি দায়ের করা হয়েছে।
এর আগে দুদকের ঢাকা সমন্বিত জেলা কার্যালয় ১-এ সংস্থাটির সহকারী পরিচালক সালাহউদ্দিন আহমেদ বাদী হয়ে পার্থর বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলার এজাহারে তাঁর বিরুদ্ধে দণ্ডবিধি ১৬১, দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫ (২) ধারা ও মানি লন্ডারিং আইনে অভিযোগ আনা হয়েছে।
পার্থ গোপাল বণিক চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি প্রিজন থাকার সময় অনিয়ম ও দুর্নীতি করেছেন এমন অভিযোগে দুদকের প্রধান কার্যালয়ে গতকাল রোববার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন দুদক পরিচালক মুহাম্মদ ইউসুফ। পরে, ঘুষ ও দুর্নীতির কয়েক লাখ নগদ টাকা বাসায় রয়েছে- এমন তথ্যের ভিত্তিতে তাঁকে নিয়ে রাজধানীর ভূতের গলির বাসায় অভিযান চালাতে যায় দুদক। এ সময় পার্থর স্ত্রী ডা. রতন মনি সাহা গেট না খুলে পাশের ভবনের ছাদে টাকা ভর্তি দুটি ব্যাগ ছুড়ে ফেলেন। দুদক কর্মকর্তারা সেই দুটি ব্যাগ উদ্ধার করে ৫০ লাখ টাকা পান। পরে দুদক কর্মকর্তারা বাসার গেট ভেঙে ভেতরে ঢোকার কথা বললে পার্থর স্ত্রী গেট খুলে দেন। দুদক বাসার বিভিন্ন স্থানে তল্লাশি চালিয়ে আরো ৩০ লাখ টাকা উদ্ধার করে। সেই সঙ্গে একটি প্রাইভেট কার জব্দ করা হয়।
তবে এসব দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত নয় বলে দাবি করেছেন ডিআইজি প্রিজন পার্থ কুমার বণিক।
দুদক পরিচালক ইউসুফ দাবি করেছেন, পার্থর বাসা থেকে যে টাকা উদ্ধার হয়েছে তা অবশ্যই ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত। তিনি জানিয়েছেন, এ ছাড়া পার্থর আরো কিছু অবৈধ সম্পদ রয়েছে বলে তদন্তে বেরিয়ে এসেছে। পরে তাঁর বাসা থেকে ৮০ লাখ টাকা জব্দ করা হয়।
আজ দুপুরে দুদক সচিব মুহাম্মদ দিলোয়ার বখত বলেন, উদ্ধারকৃত টাকার বিষয়ে পার্থ বণিক স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। অনুসন্ধান কর্মকর্তা জব্দকৃত টাকার বৈধ উৎস খুঁজে পাননি।