ডেঙ্গু নিয়ে সিটি কপোরেশনকে হাইকোর্ট

এখন সরকার ধমক দিয়েছে, আপনারা চুপ করে গেছেন

Looks like you've blocked notifications!

ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া রোগের বাহক এডিস মশা নির্মূল ও ধ্বংসের শুনানিকালে আদালত বলেছেন, গত ফেব্রুয়ারি মাসে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সতর্ক করার পর সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ বিষয়ে সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ড চালানো উচিত ছিল। এগুলোর কিছুই হয়নি। হলে হয়তো এ পরিস্থিতি হতো না। আমরা রুল দেওয়ার পর আপনাদের (সিটি করপোরেশনের) ঘুম ভাঙল। তখন কয়েকদিন উল্টাপাল্টা কথা বলেছেন। এখন সরকার ধমক দিয়েছে, আপনারা চুপ করে গেছেন।

আদালত বলেন, মশা নিধনের বিষয়টি আপনারা সিরিয়াসলি (গুরুত্ব) নিচ্ছেন না। আপনারা ওষুধ ছিটাচ্ছেন কিন্তু কাজ হচ্ছে না। অবস্থা এমন যে, আপনার রাইফেল আছে, গুলি নেই, এমন রাইফেল থেকে কী লাভ?

আজকে দেখলাম স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক ডিএসের (উপসচিব) স্ত্রী ডেঙ্গুতে মারা গেছেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কী করে? নিজের মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তার স্ত্রী মারা যায়, তারা জেগে ঘুমালে আমরা তো তাদের ডেকে তুলতে পারব না। মশা মারতে বিদেশ থেকে যথাযথ ওষুধ আনতে কত সময় লাগবে, তা ১ আগস্টের মধ্যে সুনির্দিষ্টভাবে জানাতে হবে।

মঙ্গলবার বিচারপতি তারিক-উল হাকিম ও বিচারপতি মো. সোহরাওয়ারদীর হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন। 

আদালতে ঢাকা উত্তর সিটির পক্ষে ছিলেন আইনজীবী তৌফিক ইনাম টিপু ও দক্ষিণ সিটির পক্ষে আইনজীবী সাঈদ আহমেদ রাজা। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল কাজী মাঈনুল হাসান।

শুনানিকালে আদালত বলেন, ‘আমাদের ধারণা, যে ওষুধ ছিটানো হচ্ছে, তাতে কোনো কাজ হচ্ছে না। এজন্য বিভিন্ন মহল থেকে অধিক কার্যকর ওষুধ ছিটানোর কথা বলা হচ্ছে। আপনার রাইফেল আছে, গুলি নেই, এমন রাইফেল থেকে কী লাভ?’

আইনজীবী বলেন, চীন থেকে ওষুধ আনা হবে। সিটি করপোরেশন সীমাবদ্ধতার মধ্যেও সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে মশা নিধনে।

আদালত বলেন, আপনাদের এই কর্মকাণ্ডের জন্য জবাবদিহিতা করতে হবে।

আইনজীবী বলেন, সারা বছরই মশা নিধন কার্যক্রম চলে। এখন মশার প্রকোপ বেড়েছে।

আদালত বলেন, যদি সারা বছর কার্যক্রম চলে, তাহলে প্রকোপ বাড়বে কেন?

আইনজীবী বলেন, নতুন একটি ওষুধ আনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। আজ হয়তো লাইসেন্সটা পেয়ে যাবে। এক-দুই সপ্তাহের মধ্যে হয়তো ওষুধ চলে আসবে। সরকারের সর্বোচ্চ মহল থেকে বিষয়টি মনিটর করা হচ্ছে।

আদালত বলেন, ভারতেও ওষুধ রয়েছে, সেখান থেকে দ্রুত ওষুধ আনা যেতে পারে।

ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার মাইনুল হাসানকে আদালত বলেন, ঢাকার বাইরে ডেঙ্গুর বিস্তার লাভ করেছে। এ ব্যাপারে সরকার কী করছে? আমরা কি প্রত্যেক দপ্তরের লোকদের ডেকে এনে তাদের বক্তব্য শুনব?

ব্যারিস্টার মাইনুল হাসান আদালতকে বলেন, ডেঙ্গু বর্তমানে যে আকার ধারণ করেছে, তাতে সরকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে নিয়ন্ত্রণে রাখতে। যদি এই প্রচেষ্টা গ্রহণ করা না হতো তাহলে আরো বড় আকার ধারণ করত। তবে পুরোনো ওষুধ যথেষ্ট কার্যকর হচ্ছে না। এর পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে।

আদালত বলেন, অর্থমন্ত্রী বলছেন, ঢাকার মশা মারবে সিটি করপোরেশন। তাহলে দেশের মশা কে মারবে? আমরা নতুন ওষুধ ক্রয় নিয়ে কোনো দপ্তর বা বিভাগের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি দেখতে চাই না।

দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আইনজীবী সাঈদ আহমেদ রাজা বলেন, বর্তমান অবস্থায় সরকার দুই সিটি করপোরেশনকে নতুন ওষুধ এনে দিলে ভালো হয়। তাহলে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা থাকবে না।

আদালত বলেন, ওষুধের ডোজ বাড়ানোয় মশা মরেছে?

আইনজীবী বলেন, মনে হয় কিছুটা উন্নতি হয়েছে। ফলাফল পেতে আরো সময় লাগবে।

আদালত বলেন, হাসপাতালে যে হারে প্রতিদিন রোগী ভর্তি হচ্ছে, তাতে বোঝা যায় ওষুধ কতটা কার্যকর হচ্ছে!

আইনজীবী বলেন, গত ২৭ জুলাই কাউন্সিলরদের নিয়ে একটি মতবিনিময় সভার সিদ্ধান্ত অনুসারে পরমাণু শক্তি কমিশনে এ বিষয়ে একটি মিটিং হয়েছে আরো অধিকতর কার্যকর কীটনাশক কীভাবে দেওয়া যায়।

তখন আদালত বলেন, আরো অধিকতর কার্যকর লাগবে কেন, যেটা আছে সেটা কাজ করছে না?

জবাবে আইনজীবী বলেন, কাজ হচ্ছে। কৃষি গবেষণাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এ ওষুধকে কার্যকরী বলেছে।

তখন আদালত বলেন, সরকার তো বলছে, কার্যকর ওষুধ ছিটানোর কথা। যদি কার্যকর ওষুধই হবে তাহলে সরকার কেন বলছে? এই যে অবস্থার (ডেঙ্গুর প্রকোপ) সৃষ্টি হয়েছে, এটা কী কারণে হয়েছে?

এ সময় আইনজীবী বলেন, কার্যক্রম তো চলছেই। আপনারা রুল জারির পর গতি বেড়েছে। কাজ হচ্ছে, কয়েকদিন সময় লাগবে।

তখন আদালত বলেন, আমার তো মনে হয় না। আমার বাসার এলাকায় ওষুধ ছিটাতে আসেনি। আমি এটা বিশ্বাস করি না। আপনারা এই জিনিসটা সিরিয়াসলি নিচ্ছেন না, আপনাদের জবাবদিহি করতে হবে। গত ফেব্রুয়ারিতে আপনাদের সতর্ক করা হয়েছিল। আপনারা উদ্যোগ নিলেন না কেন?

আইনজীবী বলেন, ওই সময় থেকেই তো আমাদের কার্যক্রম চলছে। কিন্তু এখন প্রকোপ বেড়েছে।

পরে তৌফিক ইনাম টিপু সাংবাদিকদের বলেন, গত সপ্তাহে আমরা কোর্টকে বলেছি ডোজ বাড়িয়ে দিয়ে অনেক বার ছিটাব। এরপর আমরা কী কী করেছি আজকে সেটার একটা বিবরণ দিয়েছি। আগে প্রতি ওয়ার্ডে ছিল ১৫ জন। এখন ২০ জন করে স্প্রে ম্যান দেওয়া হয়েছে। নতুন করে ফগার মেশিন আনা হয়েছে। কার্যক্রমটা ব্যাপকভিত্তিক চালানো হচ্ছে। পাশাপাশি সবাই মিলে একটা সিদ্ধান্ত হয়েছে-এখন যে ওষুধ আছে তার পাশাপাশি আরো কার্যকর ওষুধ আনা হবে। সেটার জন্য প্ল্যান প্রোটেকশনে অ্যাপ্লাই করা হয়েছে। যে কেউ চাইলে তো সরাসরি মেডিসিন আনতে পারে না। কারণ এটা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।  প্ল্যান প্রোটেকশনের অনুমোদন পেলে দ্রুততম সময়ে আনা হবে।

আদালত বলেছেন, আপনারা আগামী বৃহস্পতিবারের মধ্যে হলফনামা দিয়ে জানান, আপনারা যে মেডিসিনগুলো আনতে চাচ্ছেন সেটা কত দ্রত এবং কত সময়ের মধ্যে আনা সম্ভব হবে। সে ব্যাপারে আমরা অথরিটির (সিটি করপোরেশন) সঙ্গে কথা বলে সেটা আগামী বৃহস্পতিবার হলফনামা দিয়ে বলব, কতদিনের মধ্যে এটা আনতে পারব।

এর আগে আদালতের তলবে ২৫ জুলাই হাজির হয়েছিলেন ঢাকার দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এবং উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা। ওই দিন মশা মারতে সমন্বিত (কম্বাইন্ড) অভিযান চালানোর কথা আদালতকে জানিয়েছিল ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের আইনজীবী।

গত ২২ জুলাই তাদের তলব করেছিলেন হাইকোর্ট। এর আগে ১৪ জুলাই এক আদেশে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ডেঙ্গু-চিকুনগুনিয়াসহ বিভিন্ন রোগের বাহক এডিস মশা নির্মূল ও ধ্বংসের পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।

একইসঙ্গে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার বিস্তার রোধে পদক্ষেপ নিতে ডিএসসিসি ও ডিএসসিসিকে নির্দেশ দেওয়া হয়। ২২ জুলাইয়ের মধ্যে এ বিষয়ে নেওয়া পদক্ষেপ আদালতকে জানানোর নির্দেশও দেওয়া হয়।