রেনুর দুই সন্তানের পাশে চাইল্ড হ্যাভেন স্কুল

Looks like you've blocked notifications!
রাজধানীর উত্তরার চাইল্ড হ্যাভেন স্কুলের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মঞ্জুরুল ইসলাম আজ সোমবার দুপুরে তাসলিমা বেগম রেনুর শিশু মেয়ে তুবার হাতে নতুন জামাকাপড়, বেশ কিছু খেলনা, খাদ্যদ্রব্য, ব্যাগ ও বইপত্র তুলে দেন। ছবি : সংগৃহীত

রাজধানীর বাড্ডায় ছেলেধরা গুজব ছড়িয়ে হত্যার শিকার তাসলিমা বেগম রেনুর দুই শিশু সন্তানের পাশে দাঁড়িয়েছে উত্তরার চাইল্ড হ্যাভেন স্কুলের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও শুভানুধ্যায়ী। আজ সোমবার দুপুরে স্কুলের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মঞ্জুরুল ইসলামের নেতৃত্বে একদল শিক্ষক ও শিক্ষার্থী রাজধানীর মহাখালীতে রেনুর বড় বোনের বাসায় যায়। তারা রেনুর দুই শিশু সন্তান তাহসিন আল মাহির ও তাসমিন মাহিরা তুবার হাতে আর্থিক সহায়তা বাবদ এক লাখ টাকা, নতুন জামাকাপড়, বেশ কিছু খেলনা, খাদ্যদ্রব্য, ব্যাগ ও বইপত্র তুলে দেয়।

রেনুকে হত্যার প্রতিবাদে এর আগে গত ২৪ জুলাই উত্তরায় ৪ নম্বর সেক্টরে স্কুলের সামনে ও ৬ নম্বর সেক্টরে সিটি করপোরেশন কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন ও সমাবেশ করে চাইল্ড হ্যাভেন স্কুল। সেই মানববন্ধনে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. আফছার উদ্দিন খান, স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকা, পাঁচ শতাধিক ছাত্রছাত্রীসহ সহস্রাধিক অভিভাবক ও এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তি অংশ নেয়।

রাজধানীর উত্তরার চাইল্ড হ্যাভেন স্কুলের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মঞ্জুরুল ইসলাম আজ সোমবার দুপুরে তাসলিমা বেগম রেনুর শিশু মেয়ে তুবার হাতে নতুন জামাকাপড়, বেশ কিছু খেলনা, খাদ্যদ্রব্য, ব্যাগ ও বইপত্র তুলে দেন। ছবি : সংগৃহীত

এরপর রেনুর দুই সন্তানের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তহবিল গঠনের উদ্যোগ নেন চাইল্ড হ্যাভেন স্কুলের অধ্যক্ষ বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক মঞ্জুরুল ইসলাম। তাঁর আহ্বানে সাড়া দেন স্কুলের বর্তমান ও সাবেক শিক্ষক-শিক্ষিকা, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, এলাকাবাসী, রাজউক কলেজ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থীরাসহ এলাকাবাসী।

আজ দুপুরে চাইল্ড হ্যাভেন স্কুলের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মঞ্জুরুল ইসলামের নেতৃত্বে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের একটি প্রতিনিধিদল মহাখালীতে রেনুর বড় বোনের বাসায় যায়। তুবা-মাহিরের জন্য আসার কথা শুনে তাদের দেখে কেঁদে ফেলেন রেনুর বড় বোন। স্কুলের ছাত্রীরা তুবাকে দেখেই বুকে জড়িয়ে ধরে। আদর করে মুহূর্তে ভাব জমিয়ে ফেলে। এক সাথে অনেক খেলার সাথী পেয়ে তুবাও খুশি হয়। এরপর তুবা ও মাহিরের হাতে একের পর এক খেলনা, জামা, খাদ্যদ্রব্য ও উপহার সামগ্রী তুলে দেন অধ্যক্ষ মঞ্জুরুল ইসলাম। উপহার পেয়ে খুব খুশি হয় মা-হারা তুবা। তুবা-মাহিরের ভবিষ্যতের জন্য এক লাখ টাকা তুলে দেন অধ্যক্ষ।

রাজধানীর উত্তরার চাইল্ড হ্যাভেন স্কুলের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মঞ্জুরুল ইসলাম আজ সোমবার দুপুরে তাসলিমা বেগম রেনুর ছেলে তাহসিন আল মাহিরের হাতে আর্থিক সহায়তা বাবদ এক লাখ টাকা তুলে দেন। ছবি : সংগৃহীত

এরপর তুবা ও মাহিরের সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটান স্কুলের শিক্ষার্থী ও শিক্ষিকারা। অনেকে ছবি তোলেন তাদের সঙ্গে। অধ্যক্ষ মঞ্জুরুল ইসলাম কথা বলেন রেনুর বড় বোন ও বোনের ছেলে সৈয়দ নাসিরউদ্দিন টিটুর সঙ্গে। অধ্যক্ষ রেনুর যেকোনো এক সন্তানের পড়াশুনার সব খরচের দায়িত্ব নেওয়ার আশ্বাস দেন।

এ সময় অধ্যক্ষ মঞ্জুরুল ইসলাম মাহিরকে বলেন, ‘আমিও ছোটবেলায় মাকে হারিয়েছি। এরপর অনেক কষ্ট করে পড়াশুনা করে বড় হয়েছি। মা হারানোর কষ্ট আমি বুঝি। তোমাকে ভালোভাবে পড়তে হবে। আপুকে (তুবা) দেখতে হবে। তোমার কোনো চিন্তা নেই। যখন যা দরকার হয়, আমরা থাকব তোমাদের পাশে।’

এরপর অধ্যক্ষ তুবা ও মাহিরকে একদিন চাইল্ড হ্যাভেন স্কুলে নিয়ে যাওয়ার জন্য খালাতো ভাই টিটুর কাছে অনুরোধ করেন। তিনি বলেন, স্কুলের বাচ্চারা তাদের একটু দেখার জন্য অস্থির হয়ে আছে।

অধ্যক্ষ মঞ্জুরুল ইসলাম টিটুর হাত ধরে বলেন, ‘তুবা-মাহিরের পাশে আমি সারা জীবন আছি, যতদিন বেঁচে আছি। আপনি বললে তুবার সারা জীবনের পড়ার খরচ আমরা বহন করব ইনশা আল্লাহ।’

এ সময় তুবার খালা বলেন, ‘আমাদের জন্য দোয়া করবেন। আমরা তো আছি ওদের জন্য।’

তুবার সঙ্গে খেলছে চাইল্ড হ্যাভেন স্কুলের শিক্ষার্থীরা। ছবি : সংগৃহীত

জবাবে মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, ‘আপনারা তো আছেন। এটা বলছি, কারণ, এটা আমাদের মানবিক দায়িত্ব।’

এরপর তুবা-মাহিরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফেরার সময় কেঁদে ফেলেন চাইল্ড হ্যাভেন স্কুলের এক শিক্ষিকা।

গত ২০ জুলাই সকালে ঢাকার উত্তর-পূর্ব বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে তাসলিমা বেগম রেনুকে (৪০) ‘ছেলেধরা’ গুজব ছড়িয়ে প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। দুই ছেলেমেয়েকে ভর্তির জন্য সেখানে খোঁজ নিতে গিয়ে গুজবের কবলে পড়ে গণপিটুনিতে তাঁর মৃত্যু হয়। পরের দিন লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার উত্তর সোনাপুর গ্রামের পারিবারিক কবরস্থানের বাবার কবরের পাশে তাঁকে দাফন করা হয়। এরপর থেকে মহাখালীতে খালার বাড়িতে রয়েছে রেনুর দুই শিশু সন্তান তুবা ও মাহির।

তুবা ও মাহিরকে নিয়ে গতকাল এনটিভি অনলাইনে ‘মায়ের জন্য বুক ব্যথা করে, জ্বর আসে তুবার’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়।

তুবার খালাতো ভাই সৈয়দ নাসিরদ্দিন টিটু এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘তুবা ছোট বলে অনেক কিছুই বলতে পারে না। তবে মাঝেমধ্যে তুবাকে দেখে মনে হয় ওর কলিজাটা পুড়ে যাচ্ছে। ভেতরে উলট-পালট করছে। এটা আমরা বুঝি। সেজন্য আমরা তাকে তার মায়ের ব্যাপারে কিছুই বলি না। তবে মা তো, সে (তুবা) এখন অনেক কিছুই অনুভব করে।’

রাজধানীর মহাখালীতে তাসলিমা বেগম রেনুর দুই শিশু সন্তান তুবা ও মাহিরের সঙ্গে উত্তরার চাইল্ড হ্যাভেন স্কুলের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মঞ্জুরুল ইসলাম, শিক্ষিকা, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। ছবি : সংগৃহীত

নানান সময় বিভিন্ন কথা বলে কাটে তুবার প্রতিদিন। কখনো খুব উল্লাসে থাকে তো কখনো খুব মনমরা হয়ে। সারাদিন বাসায় লোক ভিড় করে। অনেকেই খবর নিতে যায় তুবার। কিন্তু তুবা সাধারণত করো সঙ্গে কথা বলে না। নিতান্তই শিশুসুলভ স্বভাবে তার মতো হয়ে কেউ কথা বললে হয়তো পাশে গিয়ে একটু বসে। তবে দ্রুতই স্থান ত্যাগ করে সে।

মায়ের মৃত্যুর আগে তুবা বেশ শান্ত স্বভাবের ছিল। এখন সে যা বলবে তাই-ই করবে। এর বাইরে তাকে দিয়ে কিছু করানো যায় না বলে জানিয়েছেন নাসিরউদ্দিন টিটু।

তুবার একমাত্র ভয় কাকের। কাকের কথা বললেই সে চুপ হয়ে যায়। ‘কাক আসবে, কাক’ তাহসিন আল মাহির তুবাকে লক্ষ্য করে এই কথা বললেই সে চুপ হয়ে যায়। ঘরের দরজা বন্ধ করে দিতে যায়। একবার মাহিরের কোলেই মাথা গোজে।

কী হবে তুবার লেখাপড়ার?

এখন তুবা পড়তে চায় না। সারাক্ষণ খেলা আর কখনো চুপচাপ হয়ে থাকে সে। তবে সৈয়দ নাসিরউদ্দিন টিটু জানালেন, ঢাকার একটি ভালো ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে তুবাকে ভর্তি করাবেন। টিটু বলেন, ‘আমি তাকে একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ও লেভেল পর্যন্ত পড়াব। তারপর বিদেশে পাঠাব উচ্চ শিক্ষার জন্য। আমি চাই তাকে মানবিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে। সমাজের অন্ধত্ব ঘোচানো তার শিক্ষার মূল মোটিভ হবে। তাকে বিদেশে লেখাপড়া করতে এমন প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করব যেখানে মানবিক ও সমাজবোধের শিক্ষা দেওয়া হবে।’

চাইল্ড হ্যাভেন স্কুলের অধ্যক্ষ মঞ্জুরুল ইসলাম তুবার খালাতো ভাই সৈয়দ নাসিরউদ্দিন টিটুর হাত ধরে রেনুর যেকোনো এক সন্তানের পড়াশুনার সব খরচের দায়িত্ব নেওয়ার আশ্বাস দেন। ছবি : সংগৃহীত

টিটু আরো বলেন, ‘এখন থেকেই তাকে বিভিন্নভাবে শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করছি। চলতি বছরটি ওকে বাড়িতে রেখে শিক্ষা দেব। আগামী বছর একটি ভালো ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেব। তার জন্য আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে চাই। স্কুলে ভর্তি করাতে গিয়ে তার মা গণপিটুনিতে হত্যার শিকার হয়েছে। আমি তাকে ভালো ভালো স্কুল-কলেজে পড়াব।’

তুবার ভাই তাহসিন আল মাহিরের কী অবস্থা?

তুবার ভাই তাহসিন আল মাহির আগে নোয়াখালীর চাটখিল উপজেলার দাদার বাড়িতে বসবাস করত। সেখানে লামচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ত সে। তবে মা মারা যাওয়ার পর সে দাদার বাড়ি থেকে মহাখালীতে খালার বাসায় চলে এসেছে। এখানেই ভর্তি হবে মাহির। এখন থেকে তুবা ও মাহির খালার বাসায় থেকেই লেখাপড়া করবে।

সৈয়দ নাসিরউদ্দিন টিটু জানালেন, আগামী বছরের শুরুতেই ঢাকার আদমজি ক্যান্টনমেন্ট স্কুলে ভর্তি করবেন মাহিরকে। অন্তত মাধ্যমিক পাস করিয়ে তাকেও বিদেশে উচ্চ শিক্ষার জন্য পাঠাবেন।

তাসলিমা বেগম রেনুর মামলার কী অবস্থা?

বাড্ডা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রফিকুল ইসলাম এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘রেনু হত্যা মামলায় এখনো পর্যন্ত আমরা ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করেছি। যাদের সবাইকেই রিমান্ডে নেওয়া হয়েছিল। এদের ভেতরে চারজন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। পিটিয়ে হত্যার ভিডিও ফুটেজ দেখে আমরা আরো তিনজনকে ফাইন্ড আউট করেছি। তাদের গ্রেপ্তারে অভিযান পরিচালনা করছি আমরা। দ্রুতই হয়তো তাদের ধরে ফেলতে পারব।’