১৫ বছর ধরে পরিবারকে খুঁজছেন রংপুরের শাহেদা

Looks like you've blocked notifications!
ঢাকা মহানগর পুলিশের খিলগাঁও জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনারের অফিস কক্ষে শাহেদা আক্তার। ছবি : সাইফুল সুমন

ছেলেমেয়েকে রেখে পালিয়ে বিয়ে করেন মা। কিছুদিন পর বিয়ে করেন বাবাও। আর এতেই তছনছ পুরো সংসার। একমাত্র ভাই আবদুর রহিমকে রেখে ছয় বছর বয়সে বাড়ির পাশের এক দাদা শাহেদা আক্তারকে নিয়ে আসেন ঢাকায়। পরে রাজধানীর একটি বাসায় গৃহকর্মীর কাজ দেন তিনি। এরপর নিখোঁজ হয় সেই দাদা। শুরু হয় শিশু শাহেদার ওপর নির্যাতন। মারধর করে আটকে রাখা হতো তাকে। এভাবে নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে গেলে বছর তিনেক পর ২০০৭ সালের শুরুতে ওই বাসা থেকে পালিয়ে যান শাহেদা। অথচ নয় বছরের শিশু শাহেদা তখন ঢাকা শহরের কিছুই চিনতেন না।

পালিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে থাকেন শাহেদা। কেউ তাকে চেনেন না। শাহেদাও কাউকে নয়। দীর্ঘ সময় পর এক রিকশাচালক তার কান্নার কারণ জানতে চান। তখন ঘটনার বিস্তারিত জানান তাঁকে। সে সময় নির্যাতনের কারণে শাহেদার ঠোঁট-মুখ ফেটে রক্ত বের হচ্ছিল। পরে রিকশাচালক শাহেদাকে নিজের বাসায় নিয়ে যান। কয়েকদিন পর আবারও একটি বাসায় শাহেদাকে গৃহকর্মীর কাজ দেন ওই রিকশাচালক। তারপর থেকে রাজধানীর মাদারটেকের সিঙ্গুপুর রোডের পুরোনো পানির পাম্পের পাশের ওই বাসায় কাজ করতে থাকেন শাহেদা।

কাজের সঙ্গে সঙ্গে মাদারটেকের ওই বাসায় চলতে থাকে শাহেদার লেখাপড়াও। বাড়িওয়ালার নাম হাবিবুর রহমান। তাঁকে মামা বলে ডাকেন শাহেদা। ওই পরিবারের সদস্য হিসেবে বেশ আনন্দেই কাটে তাঁর জীবন। এর ভেতরে হাবিবুর রহমান অনেকবার শাহেদার পরিবারের খোঁজ করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তাঁর পরিবারকে খুঁজে পাননি। এভাবেই চলতে থাকে শাহেদার জীবন। পরে ২০১৫ সালের ৫ জুন আবদুর রহিম (৩২) নামের একজনের সঙ্গে শাহেদার বিয়ে হয়। শাহেদার ভাই ও স্বামীর নাম একই। বিয়ের যাবতীয় খরচ বহন করেন হাবিবুর রহমান। শুধু তাই নয়, এখনো জামাই-মেয়ের মতো তাঁদের বাসায় আনা-নেওয়া করেন হাবিবুর। এখন সাদ (৩) নামের একটি ছেলেও আছে শাহেদার। কথাগুলো এনটিভি অনলাইনকে জানাচ্ছিলেন শাহেদা আক্তার নিজেই।

বিয়ের আগে শাহেদা আক্তার। ছবি : সংগৃহীত

এত কিছুর পরও শাহেদার ভেতরে শূন্যতা হচ্ছে, তিনি তাঁর পরিবারকে খুঁজে পাচ্ছেন না। বিশেষ করে বড় ভাই আবদুর রহিমের খোঁজ করছেন শাহেদা আক্তার। কিন্তু খুঁজে পাচ্ছেন না। কারণ শাহেদা তাঁর ছোটকালের কথা মনে করতে পারেন না। মনে করতে পারেন না গ্রামের নাম। এমনকি স্মরণ করতে পারেন না তাঁর নিজের বাবার নামও। তবে স্মরণ আছে মা রহিমা খাতুনের নাম। জানেন রংপুর জেলায় তাঁর দাদার বাড়ি। এই এতটুকুকে সম্পদ মনে করেই আজ ১৫ বছর ধরে খুঁজে চলেছেন পরিবারকে।

পরিবারকে খুঁজে পেতে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) খিলগাঁও জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার মো. জাহিদুল ইসলাম সোহাগের সহযোগিতা চেয়েছেন শাহেদার স্বামী আবদুর রহিম। জাহিদুল ইসলামের অফিস কক্ষে বসেই শাহেদা আক্তার এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে কথা বলেন।

শাহেদা আক্তার বলেন, ‘আমার সঠিক মনে নেই। তবে ছয় বছর বয়সের দিকে ঢাকায় নিয়ে আসছিল আমার এক দাদা। তারপর এক বাসায় কাজ দেন। কিন্তু কোন বাসায় বা কোন এলাকায় তা আমার মনে নেই। তারা প্রায় প্রতিদিনই খুব মারত আমায়। মারার পরে ঘরে আটকাইয়া রাখত। একদিন মাইরা আমার ঠোঁট-মুখ ফাটাইয়া দেয়। সেই দিনই বাসা থেকে পালিয়ে রাস্তায় চলে আসি। কাঁদতেছিলাম দেখে এক রিকশাচালক আমাকে তাঁর বাসায় নিয়ে যায়। এরপর আমার মামার (হাবিবুর রহমান) বাসায় কাজ দেন। বিয়ের দিন পর্যন্ত মামার বাসায় ছিলাম। এখনো ভালোই আছি। কষ্ট হয় শুধু ভাই, দাদি আর বাবা-মার কথা মনে হলে। বিশেষ করে আমার ভাইকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে আমার। আর কিছুই চাই না আমি, শুধু পরিবারকে খুঁজে পেতে চাই।’

ঢাকা মহানগর পুলিশের খিলগাঁও জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনারের অফিস কক্ষে স্বামী ও সন্তানসহ শাহেদা আক্তার। ছবি : সাইফুল সুমন

ছোটকালের কোনো স্মৃতি আপনার মনে পড়ে কি না, এমন প্রশ্নে শাহেদা আক্তার এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আমার মা এক চেয়ারম্যানের ছেলের সঙ্গে পালিয়ে বিয়ে করেন। সে সময় ওই চেয়ারম্যান আমার দাদির নামে কেস (মামলা) করেন। আমার মনে আছে, আমার ভাই আর আমাকে নিয়ে দাদি কোথায় যেন পালিয়েছিল। তারপর আমার বাবা আবার বিয়ে করেন। এরপর থেকে আমি দাদির সঙ্গে ছিলাম। ভাই গরুর রাখাল ছিল।’

আর কিছু মনে পড়ে না-এমন প্রশ্নে শাহেদা বলেন, ‘আমার মা আর দাদি ওই চেয়ারম্যানের বাসায় কাজ করতেন। তখন আমার মা ওই চেয়ারম্যানের ছেলের সঙ্গে পালিয়ে আবার বিয়ে করেন। এর বাইরে আর কিছু মনে পড়ে না।’ বলতে বলতে কেঁদে ওঠেন শাহেদা আক্তার।

শাহেদা আক্তারের বিষয়ে সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) জাহিদুল ইসলাম সোহাগ বলেন, ‘শাহেদা আক্তার তো সঠিকভাবে কিছুই বলতে পারে না। আসলে ছোট ছিল তো, কিছুই হয়তো মনে পড়ে না। এখন তাঁর বয়স ২০ বছর বা কাছাকাছি হবে হয়তো।’