পদ্মার পানির তোড়ে প্লাবিত হচ্ছে উত্তরের জনপথ
ফারাক্কার সব গেট খুলে দেওয়ায় গতকাল সোমবার থেকে পদ্মা নদীতে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে পানি। ফলে প্লাবিত হচ্ছে বিভিন্ন এলাকা। এরই মধ্যে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন উত্তরবঙ্গের অসংখ্য মানুষ। নদীতে বিলীন হয়ে গেছে বসতভিটা। বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে স্কুল-কলেজ। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ফসলি জমি।
ভারি বৃষ্টিপাতের জেরে সৃষ্ট বন্যা থেকে ভারতের রাজ্য বিহারের রাজধানী পাটনাসহ আরো ১২ জেলাকে রক্ষার জন্য ফারাক্কা বাঁধের ১১৯টি গেটের সব খুলে দিয়েছে ভারত।
গতকাল সোমবার ফারাক্কার সব গেট খুলে দেওয়ায় পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদের একাংশ ও বাংলাদেশে বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। মালদা জেলার ফুলহর, মহানন্দা ও কালিন্দী নদীতে পানি বাড়ছে। সেখানে একাধিক জায়গায় নদীর বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে বিস্তীর্ণ এলাকা। চরম বিপৎসীমার ওপর দিয়ে বইছে গঙ্গা ও ফুলহর।
এরপরই রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী (চলতি দায়িত্ব চাঁপাইনবাবগঞ্জ) সৈয়দ সাহিদুল আলম বলেছিলেন, সোমবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত এক দিনে ১১ সেন্টিমিটার পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে ধারণা করা হচ্ছে, হয়তো সব গেট খুলে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া টানা বর্ষণের কারণেও পদ্মার পানি বেশি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে বন্যার আশঙ্কা রয়েছে।
পাবনা থেকে এ বি এম ফজলুর রহমান জানিয়েছেন, পাবনার পাকশী হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে পদ্মা নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আজ সকাল ১০টায় পানি পরিমাপ করার পর এ তথ্য জানা গেছে।
পাবনা পানি উন্নয়ন বোর্ড হাইড্রোলজি বিভাগের উত্তরাঞ্চলীয় নির্বাহী প্রকৌশলী কে এম জহিরুল হক বলেন, ২৪ ঘণ্টায় পদ্মার পাকশী হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে পানি বেড়েছে ১৪ সেন্টিমিটার। আর সকাল ১০টায় বিপৎসীমা ১৪ দশমিক ২৫ সেন্টিমিটার অতিক্রম করে। এর আগে সকাল ৯টার দিকে পরিমাপ অনুযায়ী বিপৎসীমার এক সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছিল।
দীর্ঘ ১৬ বছর পর এই পয়েন্টে পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করল। সর্বশেষ ২০০৩ সালে এই পয়েন্টে পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করেছিল। এদিকে পানি বাড়ার ফলে নিচু এলাকায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন চরাঞ্চলের মানুষ।
রাজশাহী থেকে শ. ম সাজু জানিয়েছেন, উজান থেকে নেমে আসা পানির ঢলে রাজশাহীতে বেড়েই চলেছে পদ্মার পানি। আজ দুপুর ১২টায় রাজশাহী পয়েন্টে পদ্মার পানির উচ্চতা ছিল ১৮ দশমিক শূন্য ৭ মিটার। পদ্মার পানি এখন বিপৎসীমার মাত্র ৪৩ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
এদিকে পদ্মার ভাঙনে বাঘা, গোদাগাড়ী ও পবা উপজেলার দুই হাজার ছয়টি পরিবারের বসতভিটা নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। এ তিনটি উপজেলা ছাড়াও জেলার চারঘাট উপজেলার পদ্মা তীরবর্তী বেশ কিছু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। অনেকের বাড়িতে পানি ঢুকে পড়ায় দুর্ভোগে পড়েছে মানুষ।
তবে রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সৈয়দ সাহিদুল আলম জানান, গতকাল সোমবারের চেয়ে আজ পদ্মায় পানি বাড়ার হার কমেছে। জরুরি ভিত্তিতে বালুভর্তি জিও ব্যাগ প্রস্তুত করে রাখছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।
এদিকে, পদ্মায় পানি বৃদ্ধির ফলে সৃষ্ট বন্যা মোকাবিলায় করণীয় সম্পর্কে আজ ক্ষতিগ্রস্ত উপজেলাগুলোর সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্স করেছে জেলা দুর্যোগ ও ত্রাণ ব্যবস্থাপনা কমিটি।
জেলা দুর্যোগ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম জানান, বন্যা মোকাবিলায় জেলা প্রশাসনের প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি রয়েছে।
নাটোর থেকে প্রতিনিধি হালিম খান জানিয়েছেন, ফারাক্কার গেট খুলে দেওয়ায় নাটোরের লালপুর উপজেলায় পদ্মা নদীতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে।
আজ সকাল পর্যন্ত পদ্মার পানি হার্ডিঞ্জ পয়েন্টে বিপৎসীমা বরাবর ও চারঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমার ৪৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
তবে এরই মধ্যে লালপুর উপজেলার তিনটি ইউনিয়নের ১৮টি চরের ফসল ও বাড়িঘর তলিয়ে গেছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে এসব চরে বসবাসকারী প্রায় তিন হাজার পরিবার।
কুষ্টিয়া থেকে প্রতিনিধি সাবিনা ইয়াসমিন শ্যামলী জানিয়েছেন, গতকাল সোমবার ফারাক্কার সব গেট খুলে দেওয়ায় কুষ্টিয়ায় অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে পদ্মার পানি। বিপৎসীমার মাত্র এক সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে পানি।
এদিকে পদ্মায় পানি বৃদ্ধির ফলে ভারত সীমান্তবর্তী দৌলতপুরে বন্যা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে। পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চিলমারী, রামকৃষ্ণপুর ছাড়াও ফিলিপনগর ও মরিচা ইউনিয়নের গ্রামগুলো বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে।
এই চার ইউনিয়নের প্রায় ৫০ গ্রামে পানি ঢুকে গেছে। প্রায় ১৫ হাজার মানুষ নিজ বাড়িতে পানিবন্দি অবস্থায় মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। পানি ঢুকে যাওয়ায় ১৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ এলাকার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। প্রায় দুই হাজার হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
কুষ্টিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী পীযূষ কুণ্ডু বলেন, বৃষ্টির কারণে গত ১৫ দিন ধরেই কুষ্টিয়ার পদ্মা নদীতে পানি বাড়ছে। ভারতের ফারাক্কার বিরূপ প্রভাব, উজান থেকে নেমে আসা ঢলে গত দুদিন অস্বাভাবিকহারে বেড়েছে পানি। আজ সকাল ৯টায় হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে পানির সমতল ছিল ১৪ দশমিক ২৪, যা বিপৎসীমার এক সেন্টিমিটার নিচে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের আশঙ্কা, যেভাবে পানি বাড়ছে, তাতে আজই বিপৎসীমা অতিক্রম করবে। এতে চরম ক্ষতির আশঙ্কায় সব প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
স্থানীয় রামকৃষ্ণপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান সৈয়দ আহম্মেদ জানান, গেল রাতে সামান্য কিছু ত্রাণ সহায়তা পাওয়া গেছে। চিলমারী ও রামকৃষ্ণপুর ইউনিয়নে মোট এক হাজার ৫০০ পরিবারের জন্য শুকনো খাবার, চাল, ডাল পেয়েছেন, যা আজ তাঁরা বিতরণ করবেন। এটি প্রয়োজনের তুলনায় খুবই নগণ্য, বানভাসি মানুষকে বাঁচাতে তাঁরা দ্রুত আরো ত্রাণ সহায়তা প্রার্থনা করছেন ইউপি চেয়ারম্যান।