বেতার উপস্থাপক আনোয়ারুল ইসলামের অশ্রুসিক্ত চির বিদায়

Looks like you've blocked notifications!
বাংলাদেশ বেতারের সিনিয়র উপস্থাপক এ কে এম আনোয়ারুল ইসলামের মরদেহে ফুলেল শ্রদ্ধা। ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশ বেতারের সিনিয়র উপস্থাপক এ কে এম আনোয়ারুল ইসলাম গতকাল রোববার রাত সাড়ে ৮টায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতালে ইন্তেকাল করেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তাঁর প্রথম জানাজা আজ সোমবার সকাল সাড়ে ৮টায় রাজধানীর মিরপুর ১১ নম্বর সেকশনে ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের পাশের গলিতে বাসভবনের সামনে অনুষ্ঠিত হয়। এরপর সকাল ১০টায় মরহুমের প্রিয় প্রাঙ্গণ জাতীয় বেতার ভবন চত্বরে দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।

মরহুমের দ্বিতীয় জানাজায় শরিক হন বাংলাদেশ বেতারের কর্মকর্তা-কর্মচারী, নিজস্ব-অনিয়মিত শিল্পী ও উপস্থাপকরা। জানাজা পড়ান তাঁর ছোট ছেলে টিংকু। পরে বাংলাদেশ বেতারের মহাপরিচালকসহ সব স্তরের কর্মচারী, রেডিও অ্যানাউন্সারস ক্লাব-র‍্যাংকের পক্ষ থেকে সভাপতি মাহবুব সোবহান ও সাধারণ সম্পাদক মোবারক হোসেনসহ ঘোষক-ঘোষিকা মরহুমের কফিনে ফুলেল শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এ সময় তাঁর প্রচেষ্টায় বেতারে তালিকাভুক্ত অনেকে বেদনাহত হয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। পরে বেলা সাড়ে ১১টায় কালশী কবরস্থানে তাঁর লাশ দাফন করা হয়।

বাংলাদেশ বেতারের স্বর্ণযুগে কর্মময় জীবন

এ কে এম আনোয়ারুল ইসলাম ১৯৭০ সালে তৎকালীন বাংলাদেশ বেতার, রাজশাহী কেন্দ্রে অনুষ্ঠান ঘোষণায় কণ্ঠস্বর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ‘খ’ শ্রেণির ঘোষকের মর্যাদা পান। এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর পরই তিনি ঘোষণার দায়িত্ব পালন শুরু করেন। শুরু হয় তাঁর বেতার জীবন। অনুষ্ঠান উপস্থাপনার পাশাপাশি তিনি রেডিও ম্যাগাজিন স্পন্দন উপস্থাপনাসহ নানা ধরনের বিশেষ অনুষ্ঠান উপস্থাপনা যেমন : কবিতা আবৃত্তি, নাটকে অভিনয়, সংবাদ পাঠ এবং মঞ্চ অনুষ্ঠান নিয়ে কর্মব্যস্ত সময় অতিক্রম করতেন। উপস্থাপনা সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে অংশ নিয়ে সাফল্যের সঙ্গে কৃতকার্য হন। কয়েক দফা মাসিক নির্ধারিত চুক্তিপত্রের আওতায় রাজশাহী কেন্দ্রে দীর্ঘ ২৩ বছর দায়িত্ব পালন শেষে পারিবারিক প্রয়োজনে ১৯৯৩ সালে থেকে স্থায়ীভাবে ঢাকায় বসবাস করতে শুরু করেন এবং একই সঙ্গে ঢাকা বেতারে কর্মজীবন শুরু করেন।

১৯৯৩ সালে আনোয়ারুল ইসলাম বাংলাদেশ বেতারের হোম সার্ভিস, বাণিজ্যিক কার্যক্রম, বহির্বিশ্ব কার্যক্রম, জনসংখ্যা স্বাস্থ্য পুষ্টি সেল এবং ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিস নৈমিত্তিক উপস্থাপক হিসেবে কাজ শুরু করেন। বাণিজ্যিক কার্যক্রমে গানের ডালি গ্রন্থনা ও উপস্থাপনার দায়িত্ব পান তিনি শুরু থেকেই। এ দায়িত্বের পাশাপাশি তিনি ‘মন ছুয়ে যায়’ অনুষ্ঠানের গ্রন্থনা ও উপস্থাপনার দায়িত্বও পালন করেছেন দীর্ঘদিন। মন ছুয়ে যায়, ঢাকা-খ থেকে প্রতি মঙ্গলবার সকাল ১০টা থেকে ১১টা পর্যন্ত প্রচারিত হতো। এ ছাড়া তিনি ঢাকা-ক থেকে প্রতি শুক্র ও শনিবার সৈনিক ভাইদের জন্য জাতীয় অনুষ্ঠান দুর্বার উপস্থাপনা করেছেন দীর্ঘদিন।

আনোয়ারুল ইসলাম ২০০৫ সালের ২৬ মে সকালে প্রথম ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ বলে বাংলাদেশ বেতার, ট্রাফিক সম্প্রচার কার্যক্রমের উদ্বোধন ঘোষণা করেন। এই দিন থেকেই তিনি এফএম উপস্থাপনায় বৈচিত্র্য আনতে দিন-রাত কাজ করতে শুরু করেন। বিভিন্নভাবে অতীত অভিজ্ঞতাকে তিনি কাজে লাগিয়েছেন এবং এ ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ঐকান্তিক সহযোগিতাকে তিনি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ বরণ করতেন।

আনোয়ারুল ইসলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি বিবাহিত এবং দুই ছেলে সন্তানের বাবা। তিনি অত্যন্ত হাসিখুশি এবং সুখী মানুষ ছিলেন। তিনি বলতেন ‘বেতারই আমার জীবন, আমার অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ’ । দীর্ঘ প্রায় ৫০ বছর বেতার উপস্থাপনাকেই তাঁর ধ্যান-জ্ঞান বলে বিশ্বাস করতেন। বেতার স্মৃতির ভাণ্ডারে তাঁর সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনেক স্মরণীয় ঘটনা। অগ্রজদের সম্মানের সঙ্গে স্মরণ করে তিনি বলেছেন, ‘যাদের কাছে শিখেছি, তাদের প্রতি আমার শ্রদ্ধার শেষ নেই!’ অন্যদিকে, যারা নবাগত তাদের চলার পথকে মসৃণ করার ক্ষেত্রে তিনি সদা প্রস্তত থাকতেন। নিজ কর্মক্ষেত্র সম্পর্কে তিনি বলতেন, ‘জীবনের শেষ দিনেও আমি যেন মাইক্রোফোনে দায়িত্ব পালন করতে পারি।’

আনোয়ারুল ইসলামকে নিয়ে এ প্রজন্মের উপস্থাপকদের প্রতিক্রিয়া

আনোয়ারুল ইসলাম সম্পর্কে তাঁর অনুজ সিনিয়র অনুষ্ঠান ঘোষক শাকিল আহমেদ বলেন, ‘এই মাইক্রোফোন যার ধ্যান ও জ্ঞান, যার সূচনা সুদূর রাজশাহী বেতার থেকে, মাইক্রোফোন যাঁর ছিল অন্তপ্রাণ, শ্রদ্ধেয় আনোয়ার ভাই আমাদের আরেকজন অভিভাবক। সময়নিষ্ঠা আর কর্তব্যের প্রতি অসম্ভব দায়িত্বসচেতন বেতার পাগল এই মানুষটি আজ না ফেরার দেশে। তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।’

আনোয়ারুল ইসলাম সম্পর্কে তাঁর অনুজ অনুষ্ঠান ঘোষক শিশির অপু বলেন, ‘আনোয়ার ভাই হুট করে এভাবে আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। বাংলাদেশ বেতার হারাল এক উদ্যমী কণ্ঠ। আমরা হারালাম একজন প্রকৃত অভিভাবক, সহযোদ্ধা। অতল শ্রদ্ধা রইল আপনার পুণ্য স্মৃতির প্রতি।’

বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনের অনুষ্ঠান ঘোষক এস এম আসাদুজ্জামান শোভন বলেন, ‘এ কে এম আনোয়ারুল ইসলাম ছিলেন একটি ইনস্টিটিউট। দীর্ঘ ৫০ বছরের অভিজ্ঞতার সবটাই তিনি শেয়ার করেছেন অনুজদের সঙ্গে। বর্তমান প্রজন্মের এমন কোনো ঘোষক-ঘোষিকা নেই, যারা আনোয়ার ভাইয়ের কাছে ঘোষণা বা উপস্থাপনা শেখেননি! চিরসবুজ এ কে এম আনোয়ারুল ইসলাম চলে গেছেন না ফেরার দেশে, কিন্তু অনেক ‘জুনিয়র আনোয়ার’ তৈরি করে গেছেন তিনি। তিনি বেঁচে থাকবেন তাঁর সৃষ্টির মধ্যে অনন্তকাল।’