ভাবমূর্তি রক্ষায় চ্যালেঞ্জ

যেসব নেতার হাতে যেতে পারে যুবলীগ

Looks like you've blocked notifications!
শেখ ফজলে শামস পরশ, মহিউদ্দিন আহমেদ মহি, নূরে আলম চৌধুরী লিটন ও ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস (উপরে বাঁ থেকে)। ছবি : সংগৃহীত

বেকারত্ব দূরীকরণ, দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষার সম্প্রসারণ, আত্মনির্ভরশীল অর্থনীতি গড়ে তোলার লক্ষ্যে  প্রতিষ্ঠিত হয় আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন যুবলীগ। কিন্তু প্রতিষ্ঠার ৪৭ বছরে এসে এসব লক্ষ্য অর্জনে বর্তমান কমিটি ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দলীয় কোন্দল, মাদক ব্যবসা ও জুয়ার আসর পরিচালনার অভিযোগ উঠেছে সংগঠনের বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে। সর্বশেষ ক্যাসিনোকাণ্ডে এ সংগঠনটির ভাবমূর্তি এখন সংকটে। এসব কর্মকাণ্ডের জন্য যুবলীগের শীর্ষ নেতাদের দায়ী করছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতারা।

তাদের মতে, কয়েকজন নেতার বেপরোয়া জীবনযাপনের কারণে পুরো সংগঠনটি মুখ থুবড়ে পড়েছে। তবে এ জন্য নতুন করে দলটিকে ঢেলে সাজাতে হবে। আগামী ২৩ নভেম্বর যুবলীগের সপ্তম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হবে। লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নয়, সংগঠনটির ইমেজ রক্ষায় সপ্তম কংগ্রেসে যাচ্ছে সংগঠনটি। ক্যাসিনোকাণ্ডে লণ্ডভণ্ড আওয়ামী লীগের অন্যতম এ সহযোগী সংগঠন যুবলীগের নতুন নেতৃত্ব যাচ্ছে কাদের হাতে, সেটিই এখন নেতাকর্মীদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে।

জানা যায়, ১৯৭২ সালের ১১ নভেম্বর প্রতিষ্ঠিত হয় যুবলীগ। সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান শেখ ফজলুল হক মনি। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে যুবলীগে ছয়টি জাতীয় কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়েছে। সংগঠনটির সর্বশেষ কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয় ২০১২ সালে। ১৯৭৪ সালের প্রথম জাতীয় কংগ্রেসে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক শেখ ফজলুল হক মনি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ওই সময়ে তাঁর বয়স ছিল মাত্র ৩২ বছর। ওই সময় যুবলীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ৪০ বছরের বয়সসীমার একটি বিধান ছিল।

তবে ১৯৭৮ সালে অনুষ্ঠিত সংগঠনটির দ্বিতীয় জাতীয় কংগ্রেসে ওই বিধানটি বিলুপ্ত করা হয়। এরপর অনুষ্ঠিত কংগ্রেসে আমির হোসেন আমু চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৮৬ সালের তৃতীয় কংগ্রেসে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন মোস্তফা মোহসীন মন্টু। এর পর ১৯৯৩ সালে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন। ১৯৯৬ সালের চতুর্থ জাতীয় কংগ্রেসে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন শেখ ফজলুল করিম সেলিম। ২০০৩ সালের পঞ্চম জাতীয় কংগ্রেসে ৪৯ বছর বয়সে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন জাহাঙ্গীর কবির নানক। এরপর ২০০৮ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন তৎকালীন প্রেসিডিয়াম সদস্য মোহাম্মদ ওমর ফারুক চৌধুরী।

আর সর্বশেষ ২০১২ সালে অনুষ্ঠিত হয় সংগঠনটির ষষ্ঠ জাতীয় কংগ্রেস। এ কংগ্রেসে ৬৪ বছর বয়সে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন মোহাম্মদ ওমর ফারুক চৌধুরী। ওমর ফারুক শেখ সেলিমের বোনের জামাই। এই কমিটি দিয়েই চলছে বর্তমান যুবলীগ, যেখানে শেখ সেলিমের হাত দিয়েই যুবলীগ চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পান ওমর ফারুক চৌধুরী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্নে যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান শেখ ফজলুল হক মনির ছোট ভাই শেখ ফজলুল হক সেলিম।

আগামী ২৩ নভেম্বর সংগঠনটির সপ্তম কংগ্রেসের তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে। কংগ্রেসকে ঘিরে সরব নেতাকর্মীরা। দীর্ঘ সাত বছর পর হতে যাওয়া এই সম্মেলনে ক্যাসিনো কেলেঙ্কারি, অনিয়ম, দুর্নীতি আর টেন্ডারবাজির অভিযোগে ভাবমূর্তি সংকটে পড়া যুবলীগকে টেনে তোলাই নতুন নেতৃত্বের চ্যালেঞ্জ হবে বলে মনে করছেন তারা।

যুবলীগের শীর্ষ দুই পদে এরই মধ্যে আলোচনায় আসছে অনেক নাম। যদিও তাদের অনেকেই প্রকাশ্যে নিজ নিজ প্রার্থিতার বিষয়ে এখনই ঘোষণা দিচ্ছেন না। বেশিরভাগ প্রার্থীই বলছেন, দলীয় সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দায়িত্ব দিলে তাঁরা সেই চ্যালেঞ্জ নিতে প্রস্তুত রয়েছেন। সম্ভাব্য প্রার্থীদের অনেকেই রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে দলীয় কার্যালয় ও ধানমণ্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির কার্যালয়ে নিয়মিত যাওয়া-আসা করছেন। যোগাযোগ বাড়িয়েছেন আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গেও।

আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অন্যবারের চেয়ে এবার সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতৃত্ব নির্বাচনের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন হবে। তারা বলছেন, এবার সরাসরি নেতৃত্ব নির্বাচন করবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাই তিনি নিজেই বিভিন্ন মাধ্যমে সম্ভাব্য প্রার্থীদের সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিচ্ছেন। এবার সংগঠনে স্থান পাবেন পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি, দক্ষ সংগঠক ও ত্যাগী নেতারা। এ ছাড়া ছাত্রলীগের ব্যাকগ্রাউন্ড আছে এমন নেতাদের গুরুত্ব দেওয়া হবে এবার।

যুবলীগের সপ্তম জাতীয় কংগ্রেসে শীর্ষ নেতৃত্বে যারা আসতে পারেন তারা হলেন যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান শেখ ফজলুল হক মনির ছোট ছেলে ঢাকা-১০ আসনে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস ও বড় ছেলে শেখ ফজলে শামস পরশ, যুবলীগের বর্তমান কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন আহমেদ মহি, বতর্মান কমিটির এক নম্বর সদস্য ও জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ নূরে আলম চৌধুরী লিটন, যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মির্জা আজম, বর্তমানে প্রেসিডিয়াম সদস্য ফারুক হোসেন ও অ্যাডভোকেট বেলাল হোসেন, প্রকাশনা সম্পাদক ইকবাল মাহমুদ বাবলু, ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি বাহাদুর বেপারি ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাবেক নেতা এন আই আহমেদ সৈকত।

যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন আহমেদ মহি এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘যাদের এ সংগঠনের জন্য ত্যাগ আছে, যারা নির্লোভ, যাদের শরীরে কোনো ধরনের দুর্নীতির কালিমা লেপন হয় নাই এবং এ সংগঠনে যারা অতীতে রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার সব কর্মসূচিকে সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে পালন করেছেন এবং কর্মীবান্ধব নেতা তাদের হাত ধরে এ সংগঠনটি আগামী দিনে আলোর দিকে এগিয়ে যাবে।’

কেন্দ্রীয় কমিটির পদপ্রত্যাশী যুবলীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ইকবাল মাহমুদ বাবলু এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘যুবলীগে নবীনদের স্থান দেওয়া হোক, এটাই আমরা চাই। দলের দুর্দিনে যারা ছাত্ররাজনীতি করেছে, তাদের মূল্যায়ন করা হবে বলে আমরা প্রত্যাশা করি।’

সাইফুল ইসলাম আকন্দ, খন্দকার আরিফুজ্জামান আরিফ ও রেজাউল করিম রেজা (বাঁ থেকে)। ছবি : সংগৃহীত

ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগ

ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগে শীর্ষ নেতৃত্বে পদপ্রত্যাশী হিসেবে আলোচনায় রয়েছেন দক্ষিণের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক এইচ এম রেজাউল করিম রেজা, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি) শাখা ছাত্রলীগের সাবেক আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম আকন্দ, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি সৈয়দ আলাউল ইসলাম সৈকত, সাংগঠনিক সম্পাদক মাকসুদুর রহমান মাকসুদ ও দক্ষিণ যুবলীগের উপদপ্তর সম্পাদক খন্দকার আরিফুজ্জামান আরিফ।

সাইফুল ইসলাম আকন্দ বলেন, ‘যুবলীগের নেতৃত্বে পরিচ্ছন্ন যুবকরাই আসুক এমনটা আমরা চাই। যাদের দলের প্রতি কমিটমেন্ট আছে, দলকে ব্যবহার করে নানা অপকর্মে লিপ্ত হয় না এমন কেউ নেতৃত্বে আসুক এটাই আমাদের আশা।’

ইসমাইল হোসেন, তাসভীরুল হক অনু ও এ এইচ এম কামরুজ্জামান কামরুল (বাঁ থেকে)। ছবি : সংগৃহীত

ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগ

ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগে নেতৃত্ব নিয়ে আলোচনায় রয়েছেন- ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল হোসেন, ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও উত্তর যুবলীগের বর্তমান প্রথম যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক তাসভীরুল হক অনু, সহসভাপতি জাকির হোসেন বাবুল, সহসভাপতি জাহান এম এ রহমান, উত্তরের সাংগঠনিক সম্পাদক শাহাদাত হোসেন সেলিম এবং উপদপ্তর সম্পাদক এ এইচ এম কামরুজ্জামান কামরুল।

উত্তর যুবলীগের প্রথম যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক তাসভীরুল হক অনু বলেন, ‘যারা রাজপথে ছিলেন, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে ১/১১ পর্যন্ত দলে ত্যাগ রয়েছে, দলের জন্য ভূমিকা রয়েছে তারাই নেতৃত্বে আসুক, এটাই আমি চাই।’

গতকাল রোববার বিকেলে কাউন্সিলের দিক-নির্দেশনা নিতে গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশিদের নেতৃত্বে প্রেসিডিয়াম সদস্যরা সেখানে প্রধানমন্ত্রী যুবলীগের নেতৃত্বের বয়সসীমা ৫৫ নির্ধারণ করে দেন।  

আওয়ামী লীগের এ সহযোগী সংগঠনের নেতা নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে জানতে চাইলে সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশীদ এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘এখানে কেউ প্রার্থী হন না। অনেকে আলোচনায় থাকার চেষ্টা করেন বা নেতাদের কাছে নিজেকে তুলে ধরেন। আর প্রতিষ্ঠার পর থেকে যুবলীগের কংগ্রেসে কখনো ভোট হয়নি। কংগ্রেসের দ্বিতীয় অধিবেশনে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা নতুন নেতাদের নাম ঘোষণা করেন।’

কতজন কাউন্সিলর ও ডেলিগেট থাকবে জানতে চাইলে হারুনুল রশীদ বলেন, ‘প্রত্যেক সাংগঠনিক জেলা ইউনিট থেকে ২৫ জন করে কাউন্সিলর আসবে। কেন্দ্রসহ মোট কাউন্সিলর হবে দুই হাজার ২০০ জন। আর ডেলিগেট আনুমানিক ২০ হাজারের মতো হতে পারে।’