এখনো কেঁদে বুক ভাসান নুসরাতের মা

Looks like you've blocked notifications!

ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে হত্যা করা হয়েছে ছয় মাসেরও বেশি হয়ে গেছে। কিন্তু এখনো তাঁর ছায়া রয়ে গেছে পরিবার, স্বজন আর শিক্ষক-সহপাঠীদের মধ্যে। এখনো তাঁর স্মৃতি হাতড়ে বেড়ান প্রিয়জনেরা। কিছুতেই ভুলতে পারছেন না তাঁরা নুসরাতকে। জন্মদাত্রী মা কেঁদে কেঁদে বুক ভাসাচ্ছেন, অপেক্ষায় আছেন নুসরাতের হত্যাকারীদের উপযুক্ত শাস্তির। আগামীকাল বৃহস্পতিবার আলোচিত এই হত্যা মামলার রায়ের দিন নির্ধারিত রয়েছে।

নুসরাত উপজেলার উত্তর চরচান্দিয়া গ্রামের এ কে এম মুসা মানিক আর শিরিন আক্তার দম্পতির একমাত্র মেয়ে। তিনি সোনাগাজীর ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার আলিম পরীক্ষার্থী ছিলেন। পরীক্ষা চলাকালীন মাদ্রাসার ছাদে নিয়ে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দিয়ে হত্যা করা হয় তাঁকে। তিন ভাইয়ের এক বোন ছিলেন নুসরাত।

গত সোমবার সকালে নুসরাতের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়িজুড়ে সুনসান নীরবতা। বাড়িতে নুসরাতের মা আর মাহমুদুল হাসান নোমানসহ কয়েকজনকে পাওয়া গেল। বাড়ির লোকজন এই প্রতিবেদককে নিয়ে যান নুসরাতের ঘরে। সেখানে টেবিলে সাজানো নুসরাতের বই-পত্র, ছবি আর আলনায় রয়েছে তাঁর ব্যবহার করা কাপড়চোপড়। নুসরাতের ভাই জানালেন, মা সব সময় শুধু কাঁদেন। বাবা কাঁদেন। তাঁরা মেয়েকে কিছুতেই ভুলতে পারছেন না।

কথা বলতে বলতে চোখ ভিজে আসে মাহমুদুল হাসান নোমানের। তিনি বলেন, ‘নুসরাত ছাড়া আমাদের পরিবার শূন্য। আমাদের ঘরে অনেক সম্পদ না থাকলেও আমাদের বোন ঘর আলোকিত করে রাখত।’

নুসরাতের বাবা-মায়ের কথা একটাই, তাঁরা মেয়ের হত্যাকারীদের ফাঁসি চান। হত্যাকারীদের শাস্তি না দেখা পর্যন্ত তাঁরা শান্তি পাবেন না।

নুসরাতের মাদ্রাসায় গিয়ে কোনো সহপাঠীকে পাওয়া যায়নি। সেখানে উপস্থিত শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অত্যন্ত শান্ত স্বভাবের ছিলেন নুসরাত জাহান রাফি। ছোট ভাইয়ের সঙ্গে প্রায়ই মাদ্রাসায় আসা-যাওয়া করতেন।

নুসরাতের খুব কাছের বন্ধু নিশাত, ফূর্তি, সাথী ও তামান্না। নিশাত ও ফূর্তির সঙ্গে নুসরাতের অনেক স্মৃতি। নুসরাত সবকিছুই শেয়ার করতেন এই বান্ধবীদের সঙ্গে। অধ্যক্ষের হাতে যৌন নিপীড়নের পর নিশাত আর ফূর্তিকে সব জানিয়েছিলেন নুসরাত।

গত সোমবার নিশাত ও ফূর্তির সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তাঁরা বলেন, নুসরাত শিক্ষা দিয়ে গেছেন কীভাবে প্রতিবাদ করতে হয়। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমন অসংখ্য নুসরাত নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। অসংখ্য সিরাজ স্কুল-মাদ্রাসায় ঘাপটি মেরে বসে আছে। খুনিদের বিচারের মাধ্যমে নুসরাতের আত্মা কিছুটা হলেও শান্তি পাবে।

নুসরাতের মাদ্রাসার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মাওলানা মো. হোসাইন বলেন, ‘নুসরাতকে এর আগে দেখেছি কি না মনে পড়ছে না। তবে অগ্নিদগ্ধ হওয়ার পর ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে তাঁকে দেখতে যাই। এমন একটি নিষ্পাপ মেয়ের ওপর কীভাবে এমন নৃশংসতা চালিয়েছে ভাবতেই শিউরে উঠি। নুসরাত হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তি কামনা করছি।’

নুসরাত হত্যার নেপথ্যে

মামলার বিবরণে জানা যায়, ফেনী সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার আলীম পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফিকে চলতি বছরের ২৬ মার্চ ওই মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলা তাঁর অফিসকক্ষে ডেকে নিয়ে শ্লীলতাহানির চেষ্টা করেন। এ ঘটনায় নুসরাতের মা শিরিন আক্তার বাদী হয়ে গত ২৭ মার্চ সোনাগাজী থানায় অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলাকে আসামি করে একটি মামলা করেন। এ মামলায় গত ২৭ মার্চ পুলিশ অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলাকে গ্রেপ্তার করে।

সিরাজ-উদ-দৌলার নির্দেশে মাকসুদ কমিশনার, সাহাদাত হোসেন শামীম তাঁদের অনুসারীদের নিয়ে অধ্যক্ষের মুক্তির দাবিতে সোনাগাজী বাজারে মানববন্ধন করে এবং থানা ঘেরাও করার চেষ্টা করে। একই সঙ্গে সিরাজ-উদ-দৌলার অনুসারীরা নুসরাতকে মামলাটি উঠিয়ে নেওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকে। কিন্তু নুসরাত মামলা উঠিয়ে নিতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

পরে গত ৬ এপ্রিল সকালে নুসরাত আলিমের আরবি প্রথম পত্র পরীক্ষা দিতে মাদ্রাসায় গেলে দুর্বৃত্তরা তাকে ডেকে কৌশলে মাদ্রাসার ছাদে নিয়ে যায়। পরে তার গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। দগ্ধ নুসরাত ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পাঁচ দিন পর ১০ এপ্রিল রাতে মারা যায়।

পরদিন ১১ এপ্রিল বিকেলে সোনাগাজীতে জানাজা শেষে নুসরাতকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। এ ঘটনায় নুসরাতের বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান বাদী হয়ে ৮ এপ্রিল নুসরাতকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে সোনাগাজী মডেল থানায় মামলা করেন। পরে সেটি হত্যা মামলায় রূপান্তর করা হয়।

নুসরাতের ওপর হামলার ঘটনায় ফেনী, সোনাগাজীসহ সারা দেশের মানুষ ফুঁসে ওঠে। মশাল মিছিল, মানববন্ধন, বিক্ষোভ মিছিল করে দোষীদের গ্রেপ্তার ও বিচার দাবি করে।

তবে নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টাকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়ার জন্য স্থানীয় প্রভাবশালী গোষ্ঠী, থানা পুলিশ, কয়েকজন সুবিধাভোগী সাংবাদিক মরিয়া হয়ে অপপ্রচার চালাতে থাকে। সে সময়ের জেলা পুলিশ সুপার এস এম জাহাঙ্গীর আলম সরকার সোনাগাজী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোয়াজ্জেম হোসেনের পক্ষে সাফাই গেয়ে নুসরাত আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে বলে পুলিশ সদর দপ্তরে প্রতিবেদন দেয়।

এ প্রতিবেদনের কারণে পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর আলম সরকারকে ফেনী থেকে প্রত্যাহার করে ঢাকা পুলিশ সদর দপ্তরে নিয়ে যাওয়া হয়। একই সময়ে ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনকের প্রত্যাহার করা হয়। এর আগে গত ২৭ মে নুসরাতের শ্লীলতাহানির ঘটনায় ওসি মোয়াজ্জেম নুসরাতকে থানায় জিজ্ঞাসাবাদের নামে হেনস্তা করার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। ভিডিও প্রচারের এ ঘটনায় আইসিটি আইনে মামলায় ওসি মোয়াজ্জেম বর্তমানে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রয়েছেন।

পরে এ মামলা তদন্ত করার জন্য পিবিআইর কাছে হস্তান্তর করা হয়। তদন্ত শেষে গত ২৯ মে ফেনীর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট জাকির হোসেনের আদালতে ১৬ জনকে অভিযুক্ত করে ৮০৮ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্র দেন নুসরাত হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) পরিদর্শক মো. শাহ আলম।

এ মামলায় আটক থাকা চার্জশিটের বাইরের পাঁচজনকে বিচারিক আদালত মামলার দায় থেকে অব্যহতি দেন। তাঁরা হলেন কেফায়েত উল্লা, আরিফুল ইসলাম, নূর হোসেন, সাইদুল ইসলাম ও আলাউদ্দিন।

অভিযোগপত্রভুক্ত ১৬ আসামির মধ্যে ১২ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। ৩০ মে মামলাটি ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়। ১০ জুন আদালত মামলাটি আমলে নিলে শুনানি শুরু হয়। ২০ জুন অভিযুক্ত ১৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন বিচারিক আদালত। এর পর ২৭ ও ৩০ জুন মামলার বাদী ও নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হাসান নোমানকে জেরার মধ্য দিয়ে এ মামলার বিচারকাজ শুরু হয়। এর পর মোট ৯২ সাক্ষীর মধ্যে ৮৭ জনের সাক্ষ্য নেন আদালত।

মামলায় যারা আসামি

চাঞ্চল্যকর এই মামলায় উভয়পক্ষের শুনানি শেষ হয় গত ৩০ সেপ্টেম্বর। তারপরই আদালত রায়ের জন্য দিন নির্ধারণ করেন। মামলার বিচারকাজ শুরুর ৬২ দিনের মধ্যে সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করা হয়।

এ মামলায় মোট আসামির সংখ্যা ১৬ জন। তাঁরা হলেন প্রধান আসামি মাদ্রাসার অধ্যক্ষ এস এম সিরাজ-উদ-দৌলা, দুই নম্বর আসামি ফেনী কলেজের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ও অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলা মুক্তি পরিষদ আন্দোলনের আহ্বায়ক মো. নুর উদ্দিন, তিন নম্বর আসামি মাদ্রাসার ফাজিলের ছাত্র শাহাদাত হোসেন শামীম, চার নম্বর আসামি পৌর আওয়ামী লীগের সদ্য বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক এবং ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মাকসুদ আলম, পাঁচ নম্বর আসামি ছাত্রলীগকর্মী ও মাদ্রাসার ফাজিল বিভাগের ছাত্র মো. জোবায়ের, ছয় নম্বর আসামি চরচান্দিয়া ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সভাপতি ও মাদ্রাসার আলিম পরীক্ষার্থী জাবেদ হোসেন, সাত নম্বর মাদ্রাসার হেফজ বিভাগের শিক্ষক এবং ফাজিল দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র হাফেজ আবদুল কাদের, আট নম্বর আসামি মাদ্রাসার ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক আফছার উদ্দিন।