ছাত্রলীগ নেতার জবানবন্দিতে নুসরাত হত্যার ভয়ংকর বর্ণনা

Looks like you've blocked notifications!

ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি হত্যা মামলায় হত্যাকাণ্ডের ভয়ংকর বর্ণনা নিয়ে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন ছাত্রলীগ নেতা শাহাদাত হোসেন শামীম। তিনি এ মামলার তিন নম্বর আসামি। আগামীকাল চাঞ্চল্যকর এই মামলার রায় হওয়ার কথা রয়েছে।

উপজেলার চরচান্দিয়া ইউনিয়নের চরচান্দিয়া গ্রামের নওয়াব আলী টেন্ডল বাড়ির আবদুর রাজ্জাকের ছেলে শাহাদাত হোসেন শামীম। তিন ভাই আর এক বোনের মধ্যে তিনি সবার ছোট। ছোটবেলা থেকে বেপরোয়া তিনি। শামীম মাদ্রাসা শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ও চরচান্দিয়া ইউনিয়ন ছাত্রলীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক। মাদ্রাসার ফাজিল বিভাগের ছাত্র।

অভিযোগ রয়েছে, এক প্রবাসীর স্ত্রীর সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্কের কারণে প্রায় তিন বছর আগে গণধোলাইয়ের শিকার হন শামীম। জনতা তখন তাঁকে পুলিশে দিয়েছিল, কিন্তু টাকার বিনিময়ে থানা থেকে ছাড়া পান তিনি। পড়ালেখার পাশাপশি স্থানীয় ভূঞার হাটে মোবাইল ফোনের ব্যবসা করতেন। তাঁর বাবা আবুধাবিপ্রবাসী হলেও বর্তমানে দেশে আছেন। শামীমের দুই ভাই মালয়েশিয়াপ্রবাসী। একমাত্র বোনের বিয়ে হয়েছে।

অধ্যক্ষ সিরাজের অনুগত হিসেবে মাদ্রাসার অভ্যন্তরে একটি কক্ষে ছাত্র সংসদের নামে নিয়মিত অফিস চালাতেন শামীম। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বিভিন্ন অজুহাতে চাঁদা আদায় করে অধ্যক্ষ এবং সহযোগীরা ভাগবাটোয়ারা করে নিতেন। হত্যাকাণ্ডের পর ময়মনসিংহ জেলার মুক্তাগাছা থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করে পিবিআই। পরে রিমান্ডে নিয়ে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। রিমান্ড শেষে আদালতে জবানবন্দি দেন শামীম।

নুসরাতকে হত্যার বর্ণনা দিতে গিয়ে শামীম বলেন, ‘আমি সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসায় অষ্টম শ্রেণি থেকে পড়ালেখা করি। দশম শ্রেণি থেকে অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার সঙ্গে আমার ভালো সম্পর্ক হয়। আলিম পড়াশোনা থেকে আমার অধ্যক্ষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হয়। তাঁর সঙ্গে আমার সব বিষয়ে আলাপ হতো। মাদ্রাসার সব আয় ও সুবিধার ভাগ আমি পেতাম।’

‘তিনি (সিরাজ) আমাকে বিভিন্ন সময় আর্থিক সহযোগিতা করতেন। তাঁর চরিত্র খারাপ ছিল, তা আমরা জানতাম। কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে অধ্যক্ষের যৌন সম্পর্ক হয়, তা অনেকে জানেন।’

ছাত্রলীগ নেতা আরো বলেন, ‘কয়েকটি মেয়ে অধ্যক্ষ সিরাজের বিরুদ্ধে এর আগে অভিযোগ করে। প্রায় তিন মাস আগে নুসরাত জাহান রাফির বান্ধবী ফূর্তিকে তিনি যৌন হয়রানির চেষ্টা করেন। ফূর্তি ও তাঁর বাবা-মা এ নিয়ে অভিযোগ করেন। এ বিষয়টি মাদ্রাসা পরিচালনা পর্ষদের সহসভাপতি রুহুল আমিন ও সদস্য কাউন্সিলর মাকসুদ আলম ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেন। একপর্যায়ে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আক্তারুন্নেছা শিউলি মাদ্রাসায় যান, তিনিও ঘটনা জানতে পারেন। পরে এটা কীভাবে সমাধান হয়, জানি না।’

জবানবন্দিতে শামীম আরো বলেন, ‘গত ২৭ মার্চ আমি জানতে পারি, অধ্যক্ষ সিরাজ মাদ্রাসার পিয়ন নুরুল আমিনের মাধ্যমে নুসরাত জাহান রাফিকে তাঁর কক্ষে ডেকে আনেন। তার পরে তাঁকে যৌন হয়রানি করেন। ওই দিন দুপুর ১টার পরে আমি মাদ্রাসায় আসি। এসে দেখি অধ্যক্ষের কক্ষে নুসরাত জাহান রাফির আম্মা, বড় ভাই, নিশাত, ফূর্তি, রুহুল আমিন, ইয়াসিন কমিশনার, শেখ মামুন ও থানার উপপরিদর্শক (এসআই) ইকবাল হোসেন। এর পরে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোয়াজ্জেম হোসেনের সঙ্গে উপপরিদর্শক (এসআই) কথা বলে অধ্যক্ষকে থানায় নিয়ে যায়। আমিও থানায় যাই। সেখানে মামলা হয়। অধ্যক্ষ হুজুরকে গ্রেপ্তার করে জেলহাজতে নিয়ে যাওয়া হয়।’

শামীম বলেন, ‘আদালতে হুজুরের বিরুদ্ধে মামলাগুলো আমি দেখাশোনা করি এবং অ্যাডভোকেটের সঙ্গে দেখা করি। আমি মাদ্রাসার অনুমোদিত ছাত্রলীগের সভাপতি। স্থানীয় নেতা রুহুল আমিন ও মাকসুদের আশ্রয়ে ও নির্দেশনায় আমি রাজনীতি করি। গত ২৬ মার্চ শেখ মামুন রাফির পক্ষে তাঁর মা-ভাইদের নিয়ে মানববন্ধন করেন। আমরা পাল্টা হুজুরের জন্য মানববন্ধন করি।’

‘কাউন্সিলর মাকসুদ আলম সরাসরি আমাদের সঙ্গে ছিলেন। রুহুল আমিন উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি আমাদের সমর্থন করে। মানববন্ধনে নুর উদ্দিন, জীবন, জোবায়ের আহম্মেদ, ইংরেজি শিক্ষক আফছার স্যার, সেলিম স্যার, মহিউদ্দিন, শাকিল জাবেদ, সাইমুন, রাকিব, গিয়াস, কামরুনন্নাহার মনি, উম্মে সুলতানা পপি ও শম্পা ছিলেন। আমরা শিক্ষার্থীদের জোর করে ভয় দেখিয়ে মানববন্ধনে নিয়ে আসি। সেলিম স্যার, শেখ মামুনের সঙ্গে মাকসুদের হাতাহাতি হয়। তারপরে সিদ্ধান্তক্রমে আমরা পুনরায় ৩০ মার্চ মানববন্ধন করি। ওই দিন মানববন্ধনে কুমিল্লা সাউথ ইস্ট ব্যাংকে কর্মরত কেফাত উল্লাহ জনি উপস্থিত ছিলেন। তিনি খরচ দেন। মাকসুদ কাউন্সিলর ও আগের দিনে নেতৃত্বের সবাই উপস্থিত ছিলেন। এই দিনও সেলিম স্যার ও আফসার স্যার উপস্থিত ছিলেন। তাদের সঙ্গে সিরাজ-উদ-দৌলার ভালো সম্পর্ক। স্থানীয় পুলিশ আমাদের কোনো বাধা দেয় নাই। আমার সঙ্গে মাকসুদ ও রুহল আমিন যোগাযোগ রাখেন। মানববন্ধন শেষে আমরা স্থানীয় ইউএনওকে স্মারকলিপি প্রদান করি।’

শামীম আরো বলেন, ‘মানববন্ধনে যারা সক্রিয় ছিলাম, তারা আর্থিকভাবে ও অন্যান্যভাবে সুবিধা নিতাম। স্থানীয় ফেসবুক ও পত্রিকায় কাজ করে মাহবুব, সে মানববন্ধনে কাজ করে ও ফেসবুকে অপপ্রচারের কাজ করে। সে সিরাজ হুজুরকে মামা বলে ডাকে। গত ১ এপ্রিল মাকসুদ কাউন্সিলর ও আফসার স্যারের নির্দেশনা মতে আমরা জেলখানা যাওয়ার উদ্দেশ্যে বের হই। রুহুল আমিন ও মাকসুদ স্যারের পরামর্শে ডিসি স্যার-এসপি স্যারকে স্মারকলিপি প্রদান করি। তারপরে জেলখানায় যাই। আমি নুর উদ্দিন, আবদুল কাদের, জাবেদ, জোবায়ের, হুজুরের ছেলে মিশু ও আদনান এবং ফেসবুক ও পত্রিকায় কাজ করা মাহবুব কারাগারে গিয়ে হুজুরের সঙ্গে দেখা করি। হুজুর আমাদের সঙ্গে দীর্ঘসময় কথা বলেন। তাঁর মুক্তির জন্য কী করেছি তা জানতে চান। আমাদের বলে দেয়, তারপর চিন্তাভাবনা করার জন্য। মাকসুদ ও রুহুল আমিনের সঙ্গে কথা বলার জন্য বলে। তিনি ৩ এপ্রিল আবার দেখা করতে নির্দেশ দেন। ৩ এপ্রিল আমি, নুর উদ্দিন, হাফেজ আবদুল কাদের, জোবায়ের, জাবেদ, শরিফ, শাকিল রানা, ভাগিনা সম্পর্কের লোক মাহবুব, ছেলেমিশু ও আদনান, ইমরান হোসেন মামুন অধ্যক্ষের সঙ্গে দেখা করি। জেলখানায় আমরা তাঁর সঙ্গে কথা বলি। হুজুর আমাদের জানায় যে, অতি তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা নিতে। রাফিকে মামলা তুলে নেওয়ার জন্য চাপ দিতে এবং প্রয়োজনে মাকসুদের সঙ্গে আলাপ করে হত্যা করার জন্য বলে।’

শামীমের ভাষ্য হচ্ছে, ‘অধ্যক্ষ সিরাজ আমাকে নুর উদ্দিন ও আবদুল কাদেরকে আলাদাভাবে নির্দেশ দেন। টাকা-পয়সা যা লাগে তা তিনি (সিরাজ) দেবেন বলে আমাদের জানান। আমরা তারপর জেলে যাওয়া অন্য সবাইকে হুজুরের নির্দেশ জানাই। সবাই একমত পোষণ করেন। এলাকায় এসে মাকসুদকে জানাই। তিনি বৈঠক করতে বলেন। তিনি ১০ হাজার টাকা দেন খরচ করার জন্যে। সেলিম স্যার পাঁচ হাজার টাকা দেন। মাকসুদের নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা ৪ এপ্রিল মাদ্রাসার পশ্চিম হোস্টেলে বৈঠকে বসি। সেখানে অধ্যক্ষ মুক্তি পরিষদ গঠন করি। নুর উদ্দিন আহ্বায়ক ও আমি যুগ্ম আহ্বায়ক ও মহিউদ্দিন শাকিলকে সদস্য সচিব করা হয়। বৈঠকে আমি, নুর উদ্দিন, সোহাগ, শামীম, সালমান ভূঁইয়া হুজুরের মুক্তির বিষয়ে যেকোনো পদক্ষেপে সবাই সহযোগিতা করার অঙ্গীকার করা হয়। এই বৈঠক রাত সাড়ে ৮টার দিকে শেষ হয়। পরবর্তীতে গত ৪ এপ্রিল, ওই দিন নুসরাত জাহান রাফিকে হত্যা করার বিষয়ে আমরা আবার রাত সাড়ে ৯টায় একই স্থানে গোপন বৈঠকে বসি। সেখানে আমি, নুর উদ্দিনসহ অনেকে উপস্থিত ছিলাম। আমি, নুর উদ্দিন, আবদুল কাদের হত্যার পরিকল্পনা করি।’

‘রাফি প্রায় দেড় মাস আগে আমাকে প্রেমে প্রত্যাখান করে ও অপমান করে। তাই আমার ব্যক্তিগত ক্ষোভ ছিলো। আমরা আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিই যে, ৬ এপ্রিল আরবি প্রথম পরীক্ষার দিন নুসরাত জাহান রাফিকে হত্যা করে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দিবো। থানার বিষয়ে মাকসুদ আলম ও রুহুল আমিন দেখবে। সিদ্ধান্ত মোতাবেক আমি, জোবায়ের, কামরুন নাহার মণি সাইক্লোন শেল্টার সেন্টারের ছাদে থাকব। মণি আমাদের জন্য তার বাড়ি থেকে তিনটি বোরকা নিয়ে আসবে। আমি কেরোসিন তেল সরবরাহ করব। উম্মে সুলতানা পপি ওরফে শম্পা নুসরাত রাফিকে কৌশলে ডেকে আনবে। সে রাফিকে জানাবে, নিশাতকে সাইক্লোন শেল্টারের ভেতরে কে যেন মেরেছে। গেটে আফসার স্যার, গেইটের বাহিরে নুর উদ্দিন, হাফেজ অবস্থান নেবে। সাইক্লোন শেল্টারের নিচে পাহারায় থাকবে মহিউদ্দিন শাকিল ও শামীম। আমি বিষয়টি মাকসুদ কাউন্সিলর, আফছার স্যার, সেলিম স্যার, হজুরের দুই ছেলে মিশু ও আদনান, মনি, উম্মে সুলতানা পপিকে জানাই। সবাই হত্যার বিষয়ে একমত হয়। যেকোনো দায়িত্ব গ্রহণে রাজি হয়।’

জবানবন্দিতে শামীম আরো বলেন, ‘গত ৪ এপ্রিল পরিকল্পনা অনুযায়ী ৬ এপ্রিল সকাল ৭টা থেকে সাড়ে ৭টার দিকে আমরা মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে একত্র হই। আমি নুসরাতকে হত্যার জন্য বিকেল ৪টা থেকে ৫টার মধ্যে ৫ এপ্রিল এক লিটার কেরোসিন তেল ক্রয় করি। তা আমার কাছে সংরক্ষণ করি। ওই কেরোসিন নিয়ে আমি সকালবেলায় ছাদে চলে যাই। কামরুন নাহার মণি তাঁর বাড়ি থেকে তিনটি বোরকা, হাত মোজা ও পা মোজা নিয়ে আসে। আমি, জাবেদ, জোবায়ের সকাল সাড়ে ৯টায় বোরকা পরি। আমি ও জাবেদ চশমা ব্যবহার করি নাই। উম্মে সুলতানা পপি নুসরাত রাফিকে পৌনে ১০টায় তাঁর ঘনিষ্ঠ বান্ধবী নিশাত কেউ ছাদে মারধর করে জানিয়ে কৌশলে নিয়ে আসে। এ সময়ে নিচে মহিউদ্দিন ও শাকিল নিচে পাহারা দেয়। উম্মে সুলতানা পপি কৌশলমতে নুসরাত জাহান রাফিকে নিয়ে সেসহ ছাদে আসে। আমরা তখন তৃতীয়তলার কক্ষে ছিলাম। রাফি ও উম্মে সুলতানা পপি ছাদে উঠলে আমরা পিছে পিছে ছাদে যাই। মণি ও পপি ওকে ধরে ফেলে, আমি তার মুখ চেপে ধরি। রাফির পরনে ওড়না ছিঁড়ে জোবায়ের রাফির হাত ও পা বেঁধে ফেলে। আমরা তাকে শুয়ে ফেলি। এ সময় আমি নুসরাত জাহান রাফির মুখ চেপে ধরে গলা ধরে রাখি। কামরুননাহার মণি তার বুক চেপে ধরে। উম্মে সুলতানা পপি তার পা ধরে রাখে। এই সময় মণি ও তার সঙ্গে পপির কৌশল পরিকল্পনামতে রাফিকে ধাঁধায় ফেলার জন্য পপিকে শম্পা বলে ডাকে।’

‘এই জাবেদ পলিব্যাগ থেকে নুসরাত জাহান রাফির পা থেকে বুক পর্যন্ত কেরোসিন ঢেলে দেয়। আমি মুখ চেপে ধরায় ও আওয়াজ বন্ধ রাখার জন্য আর মুখে কেরোসিন দেওয়া হয়নি। তারপর জোবায়ের ম্যাচের কাঠি থেকে নুসরাত জাহান রাফির গায়ে আগুন দেয়। আগুন দিতে প্রায় পাঁচ মিনিট লাগে। দ্রুত আগুন নুসরাতের গায়ে ছড়িয়ে পড়ে। আমি, জাবেদ ও জুবায়ের বোরকা খুলে ফেলি। আমি জাবেদকে আমার বোরকা দিই। আমি ও জোবায়ের প্রস্রাবখানার পাশ দিয়ে বের হয়ে যাই। জাবেদ মাদ্রাসার হোস্টেলে ঢুকে যায়। মণি ও পপি পরীক্ষার হলে ঢুকে যায়। আমি ঘটনার পরে বাইরে গিয়ে রুহুল আমিনকে জানাই যে, মাদ্রাসায় রাফির গায়ে আগুন দেওয়া হয়। তারপরে আকবর সাহেবকে জানাই। তারপরে আমি বাড়ি চলে যাই। আমি পালিয়ে যাই। আমাকে ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা থেকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে।’