দগ্ধ নুসরাত হাসপাতালে বলেছিল, ‘মা, এদের যেন শাস্তি হয়’

Looks like you've blocked notifications!
গতকাল বুধবার ফেনীর নিজবাড়িতে এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে কথা বলেন নুসরাত জাহান রাফির মা শিরিন আক্তার। ছবি : এনটিভি

ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফির হত্যাকারীদের সর্বোচ শাস্তি ঘোষণা করে রায় কার্যকরের দাবি জানিয়েছেন নুসরাতের মা শিরিন আক্তার। গতকাল বুধবার দুপুরে ফেনীতে নিজের বাড়িতে নুসরাতের পড়ার ঘরে বসে এনটিভি অনলাইনকে এ দাবি জানান তিনি।

নুসরাতের মা শিরিন আক্তার বলেন, ‘প্রতিটা মুহূর্তে ওকে মিস করতেছি। নুসরাত ছাড়া আমার ঘর একেবারে শূন্য। নুসরাতকে ওই হায়েনারা বাঁচতে দিল না। ওরা আমার মেয়েকে যেভাবে পুড়িয়ে মেরেছে, এসব ঘাতকদেরও সর্বোচ্চ শাস্তি দিয়ে যেন মারা হয়। তাহলে আমার নুসরাতের আত্মা শান্তি পাবে।’

‘নুসরাত হাসপাতালে আমাকে বলেছিল, মা এদের যেন শাস্তি হয়’ উল্লেখ করে শিরিন আক্তার বলেন, ‘নুসরাতকে পরীক্ষার জন্য পাঠিয়েছি। যদি কোনোভাবে জানতে পারতাম, তাহলে মেয়েকে পাঠাতাম না। ঘাতকরা আমার মেয়ের শরীরকে পুড়িয়ে অঙ্গার করে ফেলেছে। হাসপাতালে বসে আমি নুসরাতের পুরো শরীর দেখেছি, ওর শরীরের চামড়া পুড়ে হাড্ডি পর্যন্ত দেখা গেছে। শুধু পায়ের নখগুলো ছিল। আর সবকিছু পুড়ে গেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমার মেয়েকে বাঁচানোর অনেক চেষ্টা করেছেন। এ জন্য অনেক ধন্যবাদ।’

‘নুসরাতের প্রতিটি স্মৃতি আমাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। মাদ্রাসা যাওয়ার আগে এবং মাদ্রাসা থেকে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলত, মা আমি এসেছি। এসব আমি এখন আর শুনতে পাই না। যত দিন বেঁচে থাকি, তত দিন নুসরাতের মৃত্যু কষ্ট আমাকে তাড়িয়ে বেড়াবে। ওকে আমি বাঁচাতে পারলাম না। নুসরাত সব সময় বলত, পড়ালেখা করে অনেক বড় হবে, ম্যাজিস্ট্রেট হবে। ছোট থেকে ও শান্ত স্বভাবের ছিল।’

পাশে বসে থাকা নুসরাতের দাদা মোশাররফ হোসেন নুসরাতের নাম ধরে ডুকরে কেঁদে ওঠেন। তিনি বলেন, ‘আমার একমাত্র নাতনি, কত আদরের ছিল। সব সময় দাদু দাদু করেই ঘর মাতিয়ে রাখত। কোনোভাবে মেনে নিতে পারছি না। আল্লাহ যেন ওদের বিচার করে।’

নুসরাত হত্যার নেপথ্যে

মামলার বিবরণে জানা যায়, ফেনী সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার আলীম পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফিকে চলতি বছরের ২৬ মার্চ ওই মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলা তাঁর অফিসকক্ষে ডেকে নিয়ে শ্লীলতাহানির চেষ্টা করেন। এ ঘটনায় নুসরাতের মা শিরিন আক্তার বাদী হয়ে গত ২৭ মার্চ সোনাগাজী থানায় অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলাকে আসামি করে একটি মামলা করেন। এ মামলায় গত ২৭ মার্চ পুলিশ অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলাকে গ্রেপ্তার করে।

সিরাজ-উদ-দৌলার নির্দেশে মাকসুদ কমিশনার, সাহাদাত হোসেন শামীম তাঁদের অনুসারীদের নিয়ে অধ্যক্ষের মুক্তির দাবিতে সোনাগাজী বাজারে মানববন্ধন করে এবং থানা ঘেরাও করার চেষ্টা করে। একই সঙ্গে সিরাজ-উদ-দৌলার অনুসারীরা নুসরাতকে মামলাটি উঠিয়ে নেওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকে। কিন্তু নুসরাত মামলা উঠিয়ে নিতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

পরে গত ৬ এপ্রিল সকালে নুসরাত আলিমের আরবি প্রথম পত্র পরীক্ষা দিতে মাদ্রাসায় গেলে দুর্বৃত্তরা তাকে ডেকে কৌশলে মাদ্রাসার ছাদে নিয়ে যায়। পরে তার গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। দগ্ধ নুসরাত ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পাঁচ দিন পর ১০ এপ্রিল রাতে মারা যায়।

পরদিন ১১ এপ্রিল বিকেলে সোনাগাজীতে জানাজা শেষে নুসরাতকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। এ ঘটনায় নুসরাতের বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান বাদী হয়ে ৮ এপ্রিল নুসরাতকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে সোনাগাজী মডেল থানায় মামলা করেন। পরে সেটি হত্যা মামলায় রূপান্তর করা হয়।

নুসরাতের ওপর হামলার ঘটনায় ফেনী, সোনাগাজীসহ সারা দেশের মানুষ ফুঁসে ওঠে। মশাল মিছিল, মানববন্ধন, বিক্ষোভ মিছিল করে দোষীদের গ্রেপ্তার ও বিচার দাবি করে।

তবে নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টাকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়ার জন্য স্থানীয় প্রভাবশালী গোষ্ঠী, থানা পুলিশ, কয়েকজন সুবিধাভোগী সাংবাদিক মরিয়া হয়ে অপপ্রচার চালাতে থাকে। সে সময়ের জেলা পুলিশ সুপার এস এম জাহাঙ্গীর আলম সরকার সোনাগাজী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোয়াজ্জেম হোসেনের পক্ষে সাফাই গেয়ে নুসরাত আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে বলে পুলিশ সদর দপ্তরে প্রতিবেদন দেয়।

এ প্রতিবেদনের কারণে পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর আলম সরকারকে ফেনী থেকে প্রত্যাহার করে ঢাকা পুলিশ সদর দপ্তরে নিয়ে যাওয়া হয়। একই সময়ে ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনকের প্রত্যাহার করা হয়। এর আগে গত ২৭ মে নুসরাতের শ্লীলতাহানির ঘটনায় ওসি মোয়াজ্জেম নুসরাতকে থানায় জিজ্ঞাসাবাদের নামে হেনস্তা করার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। ভিডিও প্রচারের এ ঘটনায় আইসিটি আইনে মামলায় ওসি মোয়াজ্জেম বর্তমানে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রয়েছেন।

পরে এ মামলা তদন্ত করার জন্য পিবিআইর কাছে হস্তান্তর করা হয়। তদন্ত শেষে গত ২৯ মে ফেনীর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট জাকির হোসেনের আদালতে ১৬ জনকে অভিযুক্ত করে ৮০৮ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্র দেন নুসরাত হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) পরিদর্শক মো. শাহ আলম।

এ মামলায় আটক থাকা চার্জশিটের বাইরের পাঁচজনকে বিচারিক আদালত মামলার দায় থেকে অব্যহতি দেন। তাঁরা হলেন কেফায়েত উল্লা, আরিফুল ইসলাম, নূর হোসেন, সাইদুল ইসলাম ও আলাউদ্দিন।

অভিযোগপত্রভুক্ত ১৬ আসামির মধ্যে ১২ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। ৩০ মে মামলাটি ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়। ১০ জুন আদালত মামলাটি আমলে নিলে শুনানি শুরু হয়। ২০ জুন অভিযুক্ত ১৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন বিচারিক আদালত। এর পর ২৭ ও ৩০ জুন মামলার বাদী ও নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হাসান নোমানকে জেরার মধ্য দিয়ে এ মামলার বিচারকাজ শুরু হয়। এর পর মোট ৯২ সাক্ষীর মধ্যে ৮৭ জনের সাক্ষ্য নেন আদালত।