বাল্যবিবাহকে ‘লালকার্ড’
লালকার্ড দেখিয়ে বাল্যবিবাহকে না বলল সাতক্ষীরার স্কুল শিক্ষার্থীরা। ‘বাল্যবিবাহ নয়, লেখাপড়াই প্রধান কাজ’ এই মতে অনড় থেকে শিক্ষার্থীদের অঙ্গীকার, সমাজে কম বয়সে বিয়ের অভিশাপ ঠেকাতে একযোগে কাজ করবে তারা। নিজের বাড়ি ছাড়াও প্রতিবেশীর বাড়িতে কারো বাল্যবিবাহের চেষ্টা হলে তাও প্রতিরোধ করার অঙ্গীকার করেছে সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ভোমরা ইউনিয়নের স্কুল শিক্ষার্থীরা।
আজ মঙ্গলবার সকালে সাতক্ষীরা সদর উপজেলার শাখরা কোমরপুর এজি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ‘বাল্যবিবাহ রোধে লালকার্ড’ শীর্ষক এক কর্মসূচির সূচনা হয়। বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে কর্মসূচিতে উপস্থিত থেকে শিক্ষার্থীরা জানিয়ে দিয়েছে, আলোকিত জীবন গঠনে বাল্যবিবাহ বন্ধের বিকল্প নেই।
শিক্ষাই প্রথম এবং শিক্ষাই জীবনকে সুন্দর জায়গায় নিয়ে যেতে পারে— এই মন্তব্য করে তারা জানিয়েছে জীবন গড়তে চাইলে বাল্যবিবাহকে না করতে হবে। বাল্যবিবাহ অধিকার কেড়ে নেয় এবং এটি পারিবারিক নির্যাতনে ঠেলে দেয়, এমন বিভিন্ন বিষয় উল্লেখ করে শিক্ষার্থীরা বলেছে, ‘আমরা পরনির্ভরশীল হতে চাই না।’
এ ছাড়া ১৮ বছরের আগে মেয়ে শিশু এবং ২১ এর আগে ছেলে শিশুর বিয়ে হতে দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছে তারা। ভোমরা ইউনিয়ন থেকে বাল্যবিবাহরোধ কর্মসূচির সূচনা হয়েছে ঝুঁকির মধ্যে থাকা কিন্তু সচেতন এসব শিক্ষার্থীর হাতে লালকার্ড তুলে দেওয়ার মধ্য দিয়ে।
লালকার্ড দেওয়ার অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন জেলা প্রশাসক মো. নাজমুল আহসান। বাল্যবিবাহের ক্ষতিকর দিকগুলোর কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘কাজী, পুরোহিত ও মসজিদের ইমামরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, তাঁরা অপরিণত বয়সের ছেলেমেয়ের বিয়ে পড়াবেন না। অল্প বয়সে বিয়ে হলে তাদের জীবন নষ্ট হয়ে যাবে এবং তারা নানাভাবে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকবে।’
জেলা প্রশাসক মো. নাজমুল আহসান জানান, বাল্যবিবাহের ফলে নবাগত শিশু পুষ্টিহীনতায় ভোগে। যত দিন বেঁচে থাকে তত দিন অসুস্থ অবস্থায় জীবনের সাথে সংগ্রাম করে। বাল্যবিবাহ আমাদের সমাজকে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে মন্তব্য করে জেলা প্রশাসক বলেন, ‘অভিভাবক, শিক্ষক, সমাজনেতা ও শিশু-কিশোরদের এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে।’
ভোমরা ইউনিয়ন থেকে বাল্যবিবাহ রোধের যে যাত্রা শুরু হয়েছে, তা সাতক্ষীরা জেলা ছাড়িয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়বে— এই আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি বলেন, ‘একজন শিক্ষিত নারী তার সন্তানকে যথাযথভাবে গড়ে তোলার সুযোগ পাবে। এজন্য বাল্যবিবাহ নয়, শিশুর শিক্ষায় অভিভাবকদের মনোযোগী হতে হবে।’
সদর উপজেলা চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান বাবু বলেন, ‘বাল্যবিবাহরোধ আমাদের সবার দায়িত্ব।’ সরকার সব শিশুর লেখাপড়ার সুযোগ করে দিয়েছে উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, ‘স্কুল থেকে শিশুরা যাতে ঝরে না পড়ে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।’ নিয়মিত স্কুলে পাঠানো হলে শিশুরা আরো সচেতন হয়ে উঠবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহ আব্দুল সাদী জানান, সাতক্ষীরায় দেড় বছরে ৫১৪টি বাল্যবিবাহ হয়েছে। এই সংখ্যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এ সময়ের মধ্যে সামাজিক ও আইনি ব্যবস্থার মাধ্যমে ৫৫টি সদর বাল্যবিবাহ বন্ধ করা গেছে। এসব কাজে সহায়তা দিয়েছেন এলাকার সচেতন মানুষ।’
নির্বাহী অফিসার আরো বলেন, ‘ বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে আমরা কাজ শুরু করেছি এবং তা একদিন শেষ করতে চাই। ভোমরা ইউনিয়নের ৩০ হাজার জনগোষ্ঠীর মধ্যে বাল্যবিবাহ রোধ সংকল্প ছড়িয়ে পড়েছে। অচিরেই তা পুরো জেলায় ছড়িয়ে পড়বে।’
শাহ আব্দুল সাদী বলেন, ‘আমরা শিশুদের হাতে বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে লালকার্ড তুলে দিয়েছি। এতে শিশুটি বাল্যবিবাহ রোধে শক্তি পাবে।’ সব শিক্ষার্থীকে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি আরো বলেন, ‘কোনো অভিভাবক কিংবা কোনো আত্মীয়স্বজন ১৮ বছরের আগে মেয়ের বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে শিশুদের পাশেই থাকবে প্রশাসন।’
সাতক্ষীরা প্রেসক্লাব সভাপতি অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, ‘বাল্যবিবাহ আমাদের সামাজিক শৃঙ্খলা ভঙ্গ করছে। অল্প বয়সে বিয়ে এবং সন্তান ধারণ করলে তা মা ও শিশু উভয়ের স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাদের ওপর নেমে আসে পারিবারিক নির্যাতন। এতে জীবনহানি ছাড়াও তারা পাচারের শিকার হতে পারে।’
প্রেসক্লাব সভাপতি আরো বলেন, ‘এই বয়সে শিশুদের হাতে থাকবে বই। তারা স্কুলে যাবে , লেখাপড়া করবে, বড় হবে তারপর পরিণত বয়সে বিয়ের পিঁড়িতে বসবে। মা-বাবাকে বুঝতে হবে, কন্যাশিশু বোঝা নয় , কন্যাশিশু পারিবারিক সম্পদ। তাকে গড়ে তোলার দায়িত্ব অভিভাবক ও শিক্ষকদের।’
অনুষ্ঠানের সভাপতি ভোমরা ইউপি চেয়ারম্যান আসাদুর রহমান জানান, তাঁর ইউনিয়নের প্রায় ৩০ হাজার জনগোষ্ঠীর মধ্যে বাল্যবিবাহের ক্ষতিকর দিক তুলে ধরা হয়েছে। তারা তাদের শিশুকে অপ্রাপ্ত বয়সে বিয়ে দেবে না বলে সম্মতি দিয়েছে।
ইউপি চেয়ারম্যান বলেন, ‘ভোমরা ইউনিয়ন বাল্যবিবাহরোধে একটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।’
শিক্ষার্থীদের হাতে লালকার্ড তুলে দেওয়ার অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য দেন, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান কোহিনুর ইসলাম, ঝাউডাঙ্গা ইউপি চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম, ভোমরা ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম, উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার জয়নুল আবেদীন, শাখরা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আহমেদ শরিফ ইকবাল প্রমুখ।
অনুষ্ঠানে জারি গেয়ে বাল্যবিবাহকে না করার আহ্বান জানিয়ে বয়ান শোনান স্থানীয় কাসেম বয়াতি ও তাঁর দল।