৬৮ বছরের সম্পর্ক ছিন্ন করে কাল চলে যাবেন তাঁরা

Looks like you've blocked notifications!
লালমনিরহাটের হাতীবান্ধার বিলুপ্ত ১৩৬ নম্বর উত্তর গোতামারী ছিটমহলের গৃহবধূ পার্বতীর স্বামী থাকেন বাংলাদেশের ভূখণ্ডে। তাই তাঁর নাম ওঠেনি যৌথ গণনায়। ফলে শুধু কোলের শিশুকে নিয়ে ভারতে যাওয়ায় অপেক্ষায় আছেন পার্বতী। বাবা সঙ্গে যেতে পারবেন না-এই কথা উঠতেই হাউ মাউ করে কেঁদে ওঠে শিশু মেয়েটি। ছবি : এনটিভি

অবশেষে যেন বেজে উঠল বিদায় ঘণ্টা। কেউ গোছাচ্ছেন ব্যবহৃত আসবাব, কেউ বা পরিধেয় কাপড়-চোপড় বা অস্থাবর সম্পত্তি বলতে যার যা আছে। কেউ কেউ দেখা করে আসছেন স্বজন-বন্ধুদের সঙ্গে। কারো বাড়িতে আবার ভিড় করছেন স্বজনরা নিজেই। সব মিলিয়ে তাঁরা এখন ভীষণ ব্যস্ত। 

আজকের দিনটিই বাংলাদেশে তাঁদের শেষ দিন। কাল যখন সূর্য উঠবে ঠিক তার পরপরই তাঁরা বেরিয়ে পড়বেন বাড়ি থেকে। আর দিনের আলো ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই পৌঁছে যাবেন নিজ দেশ ভারতে। শত চেষ্টাতেও আর কখনো ফিরতে পারবেন না নিজের সেই বাড়িতে। তাঁরা যেতে না যেতেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে তাদের সেই চিরচেনা বাড়িঘর। কারণ বাড়িঘর বলতে তাদের যা ছিল তা আগেই বিক্রি করে দিয়েছেন। ফলে মানুষগুলো বাড়ি থেকে বের হতে না হতেই ঘরগুলো সরিয়ে নিয়ে যাবেন এক-একজন ক্রেতা। কখনো যদি আসেন এই দেশে, তখন আসতে হবে ‘অতিথি’ হিসেবে, পাসপোর্ট-ভিসা নিয়ে। কারণ এই পথটি তাঁরা আগেই স্বেচ্ছায় বেছে নিয়েছেন। তাঁরা বিলুপ্ত ভারতীয় ছিটমহলবাসী। যুগের পর যুগ ধরে এই দেশের ভেতরে থাকলেও শেষ পর্যন্ত তাঁরা ‘নিজের দেশেই’ ফিরতে সম্মতি দিয়েছিলেন। 

সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে কাল বৃহস্পতিবার প্রথম দফায় লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার বিলুপ্ত উত্তর গোতামারী ছিটমহলের ১৮ পরিবারের ৬৪ জন মানুষকে পৌঁছে দেওয়া হবে ভারতে। যাদের মধ্যে শিশুসহ নারী ও পুরুষ রয়েছেন। এ জন্য প্রয়োজনীয় সব ধরনের প্রস্তুতি শেষ হয়েছে বলে জানিয়েছেন হাতীবান্ধা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাহবুবুর রহমান। উভয় দেশের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গত ১ নভেম্বরই ভারতীয় নাগরিকত্ব গ্রহণকারীদের একটি দলকে সে দেশে পাঠানোর কথা ছিল। তবে তা বাতিল করে পরে আরো কয়েকটি তারিখ নির্ধারণ করা হলেও ভারতীয় কর্তৃপক্ষের প্রস্তুতি না থাকায় সেগুলোও বাতিল করে সর্বশেষ কাল প্রথম দলটিকে পাঠানোর সিদ্ধান্ত জানিয়েছে ভারত। 
 জানা গেছে, লালমনিরহাটের তিনটি উপজেলায় থাকা ৫৯টি ছিটমহলের মধ্যে সাতটি থেকে ১৯৫ জন মানুষ ভারতীয় নাগরিকত্ব চেয়ে আবেদন করেছিলেন। এর মধ্যে দুটি হচ্ছে হাতীবান্ধার এবং অপর পাঁচটি পাটগ্রাম উপজেলার বিলুপ্ত ছিটমহল। ওই ১৯৫ জন ছাড়া বাকিরা এ দেশেই থেকে যাচ্ছেন। যাঁরা চলে যাচ্ছেন, তাঁরাসহ তাঁদের বিভিন্ন অস্থাবর সম্পত্তি ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ভারতের কোচবিহার জেলার মেখলিগঞ্জে তৈরি অস্থায়ী ক্যাম্পে পৌঁছে দিতে প্রয়োজনীয় সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ সরকার। 

প্রথম দফায় হাতীবান্ধার বিলুপ্ত ১৩৫ ও ১৩৬ নম্বর উত্তর গোতামারী ছিটমহলের ভারতীয় নাগরিকত্ব চেয়ে আবেদনকারী ১৮ পরিবারের ৬২ জনের সবাইকে কাল একসঙ্গে ভারত পাঠানো হবে। তাদের মধ্যে সনাতন ধর্মাবলম্বী ৬০ জন এবং দুই যুবক রয়েছে দুটি মুসলমান পরিবার থেকে। 

ভারতে যাওয়ার অপেক্ষায় থাকা লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এসব মানুষ নিজেদের সব প্রস্তুতি শেষ করে ফেলেছেন। গুছিয়ে নিয়েছেন সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার মতো সহায়-সম্বল। এখন শুধু আজকের রাতটি পার করবেন কোনো রকমে। এরপর সকাল হলেই উঠে পড়বেন সরকারি ব্যবস্থাপনায় পাঠানো গাড়িতে। এসব মানুষ যাচ্ছেন ঠিকই তবে এপারে রেখে যাচ্ছেন স্বজন, বন্ধু, প্রতিবেশী কিংবা এ দেশের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা অনেক স্মৃতি। তাই একেবারে শেষ সময়ে এসে তাঁরা যেন মুষড়ে পড়ছেন। বিশেষ করে ভারতীয় নাগরিকত্ব গ্রহণকারী পরিবারের মধ্যে যাঁরা বাংলাদেশে মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন, তাঁদের কষ্টের যেন শেষ নেই। 
এ রকমই একজন কানন বালা (৪৭)। তিনি বলেন, ‘আমরা এতদিন ছিটমহলে থাকলেও দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছি বাংলাদেশে। তাই এখন মেয়ে-জামাই ও নাতি-নাতনিদের রেখেই  চলে যেতে হচ্ছে। আর হয়তো কোনোদিন তাঁদের সঙ্গে দেখা হবে না-এটা ভাবতেই বুকটা যেন চাপা দিচ্ছে।’ 

বাংলাদেশি মেয়ে ববিতা রানীর (২৩) বিয়ে হয়েছিল ছিটমহলে। তাই স্বামী তপন কুমারের সঙ্গে তিনিও ভারত যাচ্ছেন কাল। তিনি বলেন, ‘যেহেতু স্বামী সেখানে যাচ্ছে তাই আমাকেও যেতে হচ্ছে। তবে এই দেশে রেখে যাওয়া স্বজনদের জন্য বারবার কান্না পাচ্ছে।’ বাবা-মাসহ নিজ নিজ পরিবারের লোকজন বাংলাদেশি নাগরিকত্ব চেয়ে আবেদন করলেও ওই ছিটমহলের দুটি পরিবারের দুই যুবক মহুবর ও রশিদুল চেয়েছিলেন ভারতীয় নাগরিকত্ব। 

তাঁদের পরিবার জানায়, দুই যুবক অনেকদিন ধরে অবৈধভাবে সীমান্ত পেরিয়ে দিল্লিতে কাজ করে আসছিল। আর মাঝেমধ্যে বাড়ি এসেছিল। এ প্রসঙ্গে মহুবর বলেন, ‘ভারতে গেলে অনেক সুযোগ-সুবিধা মিলবে এবং যখন তখন দিল্লি গিয়ে রাজমিস্ত্রির কাজ করতে পারব তাই চলে যাচ্ছি।’