যান্ত্রিক ত্রুটিতে মংলা-ঘাষিয়াখালী চ্যানেলের খননকাজ ব্যাহত

Looks like you've blocked notifications!
১১টি ড্রেজারের মধ্যে আটটিই বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মংলা-ঘাষিয়াখালী চ্যানেলের খননকাজ ব্যাহত হচ্ছে। ছবি : এনটিভি

তদারকি ও নজরদারির অভাবে অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে মংলা-ঘাষিয়াখালী আন্তর্জাতিক নৌরুটের খননকাজ। গুরুত্বপূর্ণ এই চ্যানেলের খননকাজে নিয়োজিত ১১টি ড্রেজারের মধ্যে আটটিই বন্ধ রয়েছে। বাকি চারটি দিয়ে ঢিমেতালে চলছে খননকাজ। এ ছাড়া এ পর্যন্ত যেসব নদ-নদীর খননকাজ শেষ হয়েছে, সেগুলোও পলি পড়ে ভরাট হচ্ছে। এতে ঠিক থাকছে না নাব্যতাও। যথাযথ পরিকল্পনার অভাবে এই রুটের খননকাজ ব্যর্থ হতে পারে-এমন আশঙ্কা প্রকাশ করে খুব শিগগির বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী ও পরিবেশবাদীরা।

এসব কারণে সংশ্লিষ্ট প্রকল্প পরিচালক ও স্থানীয় তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর (ড্রেজার) বিরুদ্ধে অব্যবস্থাপনা, অদক্ষতা ও প্রকল্প এলাকায় অবস্থান করে খননের বিষয়ে নজরদারি না করার অভিযোগ উঠেছে। বিশ্বের বৃহত্তর ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন রক্ষা ও মংলা বন্দর সচলের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক এই নৌ-চ্যানেলটি খননের জন্য প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণে বর্তমানে মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে খনন কার্যক্রম। এ ছাড়া অভিযোগ রয়েছে, খননকাজে দায়িত্বরত বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) কর্মকর্তারা কর্মস্থলে না থেকে বেশির ভাগ সময়ই থাকেন ঢাকায়। ফলে তদারকির অভাবে প্রকল্পের কাজ চলছে ধীরগতিতে।

সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে চ্যানেল খননকাজে বিআইডব্লিউটিএর ছয়টি ও বেসরকারি সংস্থার পাঁচটি ড্রেজার খননকাজে নিয়োজিত রয়েছে। এই ১১টির মধ্যে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে খান গ্রুপের দুটি, এসএস রহমান কোং-এর দুটি ও চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশনের একটিসহ পাঁচটিই বন্ধ রয়েছে। আর বিআইডব্লিউটিএর তিনটি ড্রেজার বন্ধ রয়েছে।

রামপাল উপজেলার চেয়ারম্যান শেখ আবু সাঈদ বলেন, ‘মংলা-ঘাষিয়াখালী চ্যানেলের গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে সরকার ২০১৪ সালের ১৫ জুন মৃতপ্রায় এই চ্যানেলটি সচলের জন্য খননকাজ শুরু করে। ২০১৫ সালের ১৫ জুন চ্যানেলটি পুরোপুরি খনন শেষে পরিপূর্ণভাবে নৌযান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এখন তা বাস্তবায়ন হয়নি। প্রায় ২৪০ কোটি টাকা ব্যয়ের এই প্রকল্প ২০১৪ সালের জুন থেকে ২০১৫ সালের ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত চ্যানেল হতে প্রায় এক কোটি কিউবিক ঘন মিটার পলি মাটি অপসারণ করেছে। শুরুতে খননকাজের যে গতি ছিল বর্তমানে তা অনেকটা স্থবির হয়ে পড়েছে। এরই মধ্যে এ পর্যন্ত যা খনন হয়েছে দ্রুত পলি পড়ে ভরাট হওয়ায়  ঠিক থাকছে না নাব্যতা। এ ছাড়া বিআইডব্লিউটিএ ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের যৌথভাবে চিহ্নিত চ্যানেল সংলগ্ন ৮৩টি শাখা নদী ও শাখা খালের জরিপ কাজ গত দুই মাসেও সম্পন্ন হয়নি। চ্যানেলটির সংযোগ খালগুলো পুরোপুরি অপসারণ ও অবৈধ দখলমুক্ত না হওয়ায় রাতে নদীতে পানির প্রবাহ বাড়ছে না। এ কারণে নাব্যতা কমছে প্রতিনিয়ত।’

আবু সাঈদ আরো বলেন, ‘এ ব্যাপারে বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করে সরকার এলাকাবাসীকে মুক্তি দিক এবং আমাদেরও মুক্তি দিক।’

যান্ত্রিক ত্রুটির বিষয়ে খুলনা বিভাগীয় কমিশনার মো. আবদুস সামাদ বলেন, ‘ত্রুটি তো যে কোনো মেশিনেই থাকে, আজকে ত্রুটি আছে, ঠিক করা হচ্ছে, কালকে আবার চালু হয়ে যাচ্ছে। এভাবে ড্রেজার কর্তৃপক্ষ কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া ত্রুটি কিছু কিছু থাকলেও সেগুলো সারিয়ে আবারও আমরা কাজ করছি।’

এ ব্যাপারে পরিবেশ সুরক্ষায় উপকূলীয় জোটের সভাপতি এস এম শাহনেওয়াজ আলী বলেন, ‘চ্যানেল খননে পরিবেশবাদী সংগঠনের বিশেষজ্ঞ ও স্থানীয়দের মতামত অবজ্ঞা করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টদের আন্তরিকতার সঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে।’

পরিবেশবাদী বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা কোস্টাল ডেভেলপমেন্ট পার্টনারশিপের (সিডিপি) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ জাহাঙ্গীর হাসান মাসুম বলেন, ‘চ্যানেল খননের আগে সংশ্লিষ্ট শাখা নদী-খালগুলো উন্মুক্ত করা জরুরি ছিল। সেই সঙ্গে অবৈধ বাঁধ ও দখলদারদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা এখনো গ্রহণ করা হয়নি। জলাশয়গুলোর পানি চ্যানেলে নামার ব্যবস্থা করতে হবে। সুন্দরবনের জীব-বৈচিত্র্যের ক্ষতি কমাতে চ্যানেলটি দ্রুত চালু করা প্রয়োজন। চ্যানেল সচল করার গুরুত্বটি এলাকার জনগণকে বুঝাতে হবে।’ অবৈধ বাঁধ ও পলি অপসারণে এখনই ব্যবস্থা না নিলে এ চ্যানেলটির কাঙ্খিত ফলাফল থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কাও প্রকাশ করেছেন তিনি।

চ্যানেল খননের বিষয় পরিবেশবাদী সংগঠন সেভ দ্য সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম বলেন, ‘খননের বিষয় নিয়ে আমরা অনেক কথা বলেছি। চ্যানেলটি প্রথমে যেভাবে খনন শুরু হয়েছে সেটি খুবই ত্রুটিপূর্ণ। কারণ চ্যানেল খননের আগে প্রভাবশালীদের দখলে থাকা নদী-খাল দখলমুক্ত করে অবৈধ বাঁধ ও পলি অপসারণ করে জোয়ারাধার বা জোয়ার অববাহিকার বিষয়টি নিশ্চিত জরুরি ছিল। সেনা ও নৌবাহিনীর তত্ত্বাবধানে এ চ্যানেলটি খননের দাবি জানিয়ে তিনি আরো বলেন, ‘বর্তমান শুষ্ক মৌসুমে জোয়ার-ভাটা রাতে কম। তাই পলি কম আসছে। কিন্তু পানিপ্রবাহ অনুপাতে পলি ঠিকই পড়ছে।’ পলি পড়ে আবারও চ্যানেল ভরাট হওয়ার কথা বিবেচনা করে এখনই বিকল্প ব্যবস্থার দাবি জানিয়েছেন ফরিদুল ইসলাম।

নাব্যতার বিষয়ে খুলনার বিভাগীয় কমিশনার মো. আবদুস সামাদ আরো বলেন,  বর্তমানে এ চ্যানেল দিয়ে ১২ ফুট গভীরতার নৌযান চলাচল করছে। কিছু কিছু জায়গায় প্রতিনিয়ত পলি পড়লেও যেমনটা আশঙ্কা করা হয়েছিল সেই তুলনায় চ্যানেলটিতে কম পলি পড়ছে। তারপরও নাব্যতা ধরে রাখার জন্য মংলা-ঘাষিয়াখালী চ্যানেলের সঙ্গে সংযুক্ত ৮৩টি খাল খননের প্রকল্প গ্রহণ করেছে সরকার। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে মংলা-ঘাষিয়াখালী চ্যানেল সারা জীবনের জন্য চালু থাকবে।

যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে ড্রেজার বন্ধ থাকায় খননকাজ ব্যাহত হচ্ছে কি না, সে বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে বিআইডব্লিউটিএর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (ড্রেজিং) ফরহাদ উজ জামান বলেন, ‘খননকাজ তো কিছুটা ব্যাহত হচ্ছে। বর্তমানে বিআইডব্লিউটিএর চারটি ও বেসরকারি কয়েকটি ড্রেজার বন্ধ রয়েছে। মূলত দীর্ঘদিন লবণপানিতে কাজ করার কারণে ড্রেজারগুলোর বিভিন্ন যন্ত্রপাতি দুর্বল ও অকেজো হয়ে পড়েছে। এগুলোতে দেশীয় পার্টস লাগালে তা আবারও দ্রুত নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তাই বিদেশ থেকে ভালো পার্টস এনে লাগানোর জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে। কর্মকর্তারা ড্রেজিং এলাকায় অবস্থান না করে ঢাকায় অবস্থান করায় প্রকল্পের কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে-এই অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘টেন্ডারসহ বিভিন্ন কাজের কারণে ঢাকায় অবস্থান করতে হয়। তারপরও সেখানে প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় লোকজন থাকায় কাজের তেমন কোনো ক্ষতি হয় না।’