সর্বোচ্চ আদালতে নতুন তর্ক

সরকারি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করা অবস্থায় অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিরা আদালতে আইন পেশায় নিয়োজিত হতে পারবেন কি না, এ নিয়ে নতুন তর্কের সৃষ্টি হয়েছে।
অবসরপ্রাপ্ত একজন বিচারপতি বলছেন, সংবিধান তাঁকে প্র্যাকটিস করার অধিকার দিয়েছে। অপর পক্ষে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা বলছেন, এটি চরম নৈতিকতাবিরোধী।
আজ বুধবার সকালে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগে একটি মামলার শুনানি চলাকালে এ তর্কের সৃষ্টি হয়। এ সময় প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা সরকারি সুযোগ-সুবিধা নেওয়া অবস্থায় অবসরপ্রাপ্ত ও বর্তমান বিচারপতিদের আদালতের নিয়মকানুন ও প্রথা মেনে চলার আহ্বান জানান।
সম্প্রতি বেশ কয়েকটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিচার বিভাগে উত্তপ্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
এর মধ্যে গত ১৯ জানুয়ারি দায়িত্ব নেওয়ার এক বছর পূর্তি উপলক্ষে এক বিবৃতিতে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘বিচারপতিদের অবসরে গিয়ে রায় লেখা আইন ও সংবিধান পরিপন্থী। কোনো কোনো বিচারক রায় লিখতে অস্বাভাবিক বিলম্ব করেন, আবার কেউ কেউ অবসর গ্রহণের দীর্ঘদিন পর পর্যন্ত রায় লেখা অব্যাহত রাখেন, যা আইন ও সংবিধান পরিপন্থী।’
এ নিয়ে সরকারপক্ষ ও বিরোধীদের মধ্যে দ্বিমত দেখা দেয়। কেউ কেউ প্রধান বিচারপতির বক্তব্যকে সঠিক বলে মত দেন। অপরপক্ষের অভিমত, এ নিয়ম অনেক দিন ধরেই চলে আসছে।
এর মধ্যেই গত ৭ ফেব্রুয়ারি আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক অবসরের পর তাঁর লেখা পূর্ণাঙ্গ রায় গ্রহণ করতে প্রধান বিচারপতির কাছে দেওয়া চিঠি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের মূল ভবনের পাশে সংবাদ সম্মেলন করেন।
পরদিন ৮ ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের প্রশাসনের পক্ষ থেকে দেওয়া বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে এ ধরনের সংবাদ সম্মেলন নজিরবিহীন। প্রধান বিচারপতি আশা করেন, বর্তমান ও ভবিষ্যতে মাননীয় বিচারপতিরা কোর্টের পবিত্রতা ও মর্যাদা বজায় রাখার স্বার্থে এরূপ কার্য থেকে বিরত থাকবেন।’
এরপর প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের কাছে থাকা মামলার রায় ও নথি দেওয়ার কথা বলেন। প্রথমে রাজি না হলেও বিচারপতি শামসুদ্দিন পরে তা ফেরত দেন।
এদিন সুপ্রিম কোর্টের বাইরে মাজার গেটের পাশে রাস্তার ওপর আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বিচারপতি মানিক অবিলম্বে প্রধান বিচারপতির পদত্যাগ দাবি করেন। তিনি বলেন, ‘প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বিচারাঙ্গনকে বিতর্কিত করে চলছেন। রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়ে খালেদা জিয়ার এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছেন।’
প্রধান বিচারপতিকে কেন্দ্র করে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের দেওয়া বক্তব্যে এখনো বিচারাঙ্গন উত্তপ্ত। তার মধ্যেই আজ আবার নতুন করে আরেক তর্কের সৃষ্টি হলো।
প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন ওই আদালতে সকালে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত মীর কাসেম আলীর আপিলের শুনানি দ্বিতীয় দিনের মতো শুরু হয়। তখন মীর কাসেম আলীর পক্ষে শুনানির জন্য দাঁড়ান সম্প্রতি হাইকোর্ট থেকে অবসরে যাওয়া বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি অবসর-পরবর্তী ছুটিতে (পিআরএল) রয়েছেন।
গত ১০ ডিসেম্বর হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরী অবসর গ্রহণ করেন। বর্তমানে তিনি বিচারপতিদের বাসভবনে থাকেন। গাড়ি ও গানম্যানসহ সরকারি সব ধরনের সুবিধা ভোগ করেন।
এ সময় অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, ‘মাই লড, সদ্য অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিরা সরকারি বাড়ি-গাড়ি ব্যবহার করে প্র্যাকটিস করছেন যা শোভনীয় নয়।’
তখন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরীর উদ্দেশে বলেন, ‘দীর্ঘদিন চাকরি করার পর বিচারপতিরা এক বছর পর্যন্ত বাড়ি-গাড়ি ব্যবহার করতে পারেন। এটা তাদের প্রিভিলাইজ (সুযোগ)। আপনি এ বিষয়ে সতর্ক থাকবেন।’
এ মামলার শুনানি শেষে সাবেক বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরী ও অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম উভয়েই এ বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন করে নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরেন।
আদালতে শুনানির ঘটনার বর্ণনা দিয়ে সাবেক বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘মীর কাসেম আলীর আপিলের শুনানি চলাকালে অ্যাটর্নি জেনারেল আমার প্র্যাকটিসের বিষয়টি আদালতের নজরে আনেন। তখন প্রধান বিচারপতি সরকারি সুযোগ-সুবিধা নেওয়া অবস্থায় অবসরপ্রাপ্ত ও বর্তমান বিচারপতিদের আদালতের নিয়মকানুন মেনে চলার আহ্বান জানান।’
‘আমি তখন বলেছি, মাই লর্ড অতীতেও আমি এর অপব্যবহার করিনি, এখনো করছি না। আর কয়েক মাস আছি (সুবিধা নিতে পারব), আমি ভবিষ্যতেও এর অপব্যবহার করব না। আমি আইন মেনে আইন পেশায় কাজ করছি। সংবিধান আমাকে ক্ষমতা দিয়েছে’, যোগ করেন মীর কাসেমের আইনজীবী।
এর কিছুক্ষণ পরেই নিজ দপ্তরে সংবাদ সম্মেলন করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।
রাষ্ট্রের প্রধান এ আইন কর্মকর্তা বলেন, ‘নজরুল ইসলাম চৌধুরী একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি। তিনি সরকারি জাজেস কমপ্লেক্স, সরকারি গাড়ি, গানম্যানসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন। এ রকম সরকারি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে আইনজীবী হিসেবে প্র্যাকটিস করবেন তা চরম নীতি-নৈতিকতাবিরোধী।
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘আইনজীবীরা সরকারি অন্য কোনো সুযোগ-সুবিধা নিতে পারেন না। এটা সাধারণ পাবলিকের (মানুষের) কাজ। জাজ হিসেবে তিনি তা করতে পারেন না।’
এ সময় সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেন তাহলে কি সাবেক বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরী রাষ্ট্রবিরোধী কাজ করছেন? জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘বিষয়টি এমন না। এখানে নীতি- নৈতিকতার প্রশ্ন।’
আইনে কোনো বাধা আছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে মাহবুবে আলম বলেন, ‘আইন ও নৈতিকতা দুটি আলাদা বিষয়।’
রাষ্ট্রের প্রধান এ আইন কর্মকর্তা আরো বলেন, পত্রপত্রিকায় শুনেছি মীর কাসেম আলী জামায়াতে ইসলামীর অর্থের জোগানদাতা। এত বড় বড় আইনজীবী নিয়োগের মাধ্যমে তার প্রমাণ দেখলাম।
সংবিধানের ৯৯ অনুচ্ছেদের ২-এর (১) এ সম্পর্কে বলা আছে, ‘কোনো ব্যক্তি হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক পদে বহাল থাকলে উক্ত পদ হইতে অবসর গ্রহণের পর তিনি আপিল বিভাগে ওকালতি বা কার্য করিতে পারিবেন।’
তবে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ এ বিষয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘হাইকোর্টের বিচারক প্র্যাকটিস করতে সংবিধান অনুযায়ী বাধা নেই। তবে সরকারি সুযোগ-সুবিধা নেওয়া অবস্থায় তা নৈতিকতাবিরোধী।’