‘ট্রাফিক জ্যাম আমার কাছে ওয়ান্ডারল্যান্ড’
বাংলাদেশের ট্রাফিক জ্যাম তাঁর খুব পছন্দ! কারণ এ সময় যানজটে আটকে থাকে অনেক মানুষ। আর এই মানুষদেরই তাঁর ভীষণ ভালো লাগে। ভালো লাগে নানা রঙের, নানা বর্ণের মানুষদের নানা অভিব্যক্তি।
আর ভালো লাগে সাদা দাড়িতে মেহেদি দেওয়া মানুষদের। সেই প্রমাণও মিলল এমন একজন মানুষের সঙ্গে তাঁর সেলফি তোলা দেখে।
মানুষ ভালো লাগা এই মানুষটির নাম করিনা মারিয়া টমাশেট। মানুষ দেখতে সুদূর সুইজারল্যান্ড থেকে বাংলাদেশে ছুটে এসেছেন তিনি। গত ৩১ জানুয়ারি বাংলাদেশে আসার পর থেকে দেশের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়াচ্ছেন করিনা।
করিনা বললেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ খুব বন্ধুবৎসল। কিন্তু যেখানেই যাই সেখানেই কেউ না কেউ প্রশ্ন করে, বিয়ে করেছেন কি না, বাচ্চাকাচ্চা আছে কি না। যখনই শোনেন বিয়ে করিনি, বাচ্চাকাচ্চা নেই, তখনই এ দেশের মানুষ খুব দুঃখ প্রকাশ করেন।’
কিছুদিন আগে ফেসবুক গ্রুপ ‘বিন্দা.....স’-এর সঙ্গে সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরসহ বেশ কিছু স্থানে ভ্রমণের সময় পরিচয় হয় করিনা ও বাংলাদেশে তাঁর ফেসবুকবন্ধু ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্রী সাকিয়া হকের সঙ্গে। ঢাকায় ফিরে করিনা ও সাকিয়াকে আমন্ত্রণ জানানো হয় এনটিভি অনলাইনের কার্যালয়ে।
ঘোরাঘুরির চরম ব্যস্ততার এক ফাঁকে গত ১৭ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ৮টায় তাঁদের এনটিভি অনলাইনে নিয়ে আসেন নিউজ রুম এডিটর সেখ ফয়সাল আহমেদ।
করিনা ও সাকিয়াকে স্বাগত জানান এনটিভি অনলাইনের প্রধান ফকরউদ্দিন আহমেদ জুয়েল। সঙ্গে ছিলেন এনটিভি অনলাইনের বার্তা সম্পাদক রফিকুল রঞ্জু। কুশলাদি বিনিময়ের পর গল্পের ফাঁকে ফাঁকে কথা হয় বিভিন্ন বিষয়ে।
শুরুতেই করিনার কাছে জানতে চাওয়া হয় বাংলাদেশ ভ্রমণের কারণ।
‘চিকিৎসা বিষয়ে পড়াশোনা শেষে ভাবলাম দক্ষিণ এশিয়া ভ্রমণ করব। এ জন্য প্রথমেই ঠিক করি শ্রীলঙ্কা ঘুরে বেড়াব। তারপর বাংলাদেশ, নেপাল ও ভারত। এরপর দেশে গিয়ে চিকিৎসা পেশায় নিয়োজিত হব।’
‘কিন্তু বাংলাদেশ সম্পর্কে কিছুই জানি না। কারো সঙ্গে পরিচয়ও নেই। তাই প্রথমে ভাবলাম আগে বাংলাদেশ ঢুকি, তারপর দেশ সম্পর্কে জানি। এরপর ফেসবুক গ্রুপ ট্রাভলেটসে সাকিয়ার তোলা বাংলাদেশের ছবি দেখি,’ জবাব দেন করিনা।
পরের গল্প শোনান সাকিয়া হক। বললেন, ‘করিনার সঙ্গে পরিচয় ফিমেল সোলো ট্রাভেলারদের ফেসবুক গ্রুপ ট্রাভলেটসের মাধ্যমে। ওখানে বাংলাদেশের খুব একজন কেউ নেই। আমি রিক্যুয়েস্ট পাঠিয়ে সদস্য হই। পাঁচ-ছয় মাস আগে আমি চট্টগ্রামের একটি ছবি দেই। ছবিটা ছিল এ রকম- আকাশে অনেক মেঘ, নিচে পাহাড়। ছবিটি দেখে করিনাসহ বেশ কয়েকজন বাংলাদেশে আসতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। কিন্তু আমি প্রথমে খুব একটা পাত্তা দেইনি, এ জন্য যে এমনিই হয়তো বলছে। কিন্তু করিনা সত্যিই চলে এসেছে।’
‘করিনা গত ৩১ জানুয়ারি বাংলাদেশে আসে। ওর আগেই আসার কথা ছিল। কিন্তু কিছু পারিবারিক সমস্যা ছিল। আমারও কিছু প্রস্তুতি নেওয়া দরকার ছিল,’ বলছিলেন সাকিয়া।
এরই মধ্যে করিনা ও সাকিয়া ঘুরেছেন বরিশাল, পটুয়াখালীর কুয়াকাটা, খুলনা, বাগেরহাট, সুনামগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ, ঢাকার লালবাগ কেল্লা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। ঢাকার বাইরে সবগুলো ট্যুরেই করিনার সঙ্গে ছিলেন সাকিয়া। ২১ ফেব্রুয়ারি রাতে তাঁরা কক্সবাজার ও সেন্ট মার্টিনের উদ্দেশে রওনা হয়েছেন। সেখান থেকে ফেরার পর ২৫ ফেব্রুয়ারি যাবেন সুন্দরবন। এ ছাড়া ঢাকার কিছু কিছু স্থান করিনা একাই ঘুরেছেন যেমন শাহবাগে জাতীয় জাদুঘর, আহসান মঞ্জিল।
করিনাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল ঢাকা চিড়িয়াখানায় গিয়েছিলেন কি না। করিনার সাফ জবাব, তিনি খাঁচার ভেতরে প্রাণী আটকে রাখাটা পছন্দ করেন না। তিনি মনে করেন, পশু-পাখিসহ সব ধরনের প্রাণী আপন মনে স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াবে। তাকে বন্দি করে রাখাটা অন্যায়। এ কারণে তিনি চিড়িয়াখানা বিষয়টা পছন্দ করেন না।
বাংলাদেশের খাবার-দাবার কেমন লাগছে করিনার?
‘বাংলাদেশিরা খুব ঝাল খাবার খায়। আমি তো এক হাতে খাবার খাই। আর এক হাতে পানি খাই,’ অভিনয় করে দেখাচ্ছিলেন করিনা, ‘ঝাল খাবারের মধ্যেও পানি পুরি খেতে খুব ভালো লেগেছে।’
এ ছাড়া করিনার বিরিয়ানি ও ছোলা ভালো লেগেছে বলে জানান সাকিয়া। বরিশাল, কুয়াকাটা ভ্রমণের সময় লঞ্চযাত্রা অনেক ভালো লেগেছে করিনার। কিছু স্থানে বাসের ছাদে উঠেও ভ্রমণ করেছেন।
‘ঢাকায় হোটেলে থাকছেন, মাঝেমধ্যে বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, কোনো সমস্যা হয়নি তো?’ করিনার জবাব, ‘ঢাকায় আমি খুবই নিরাপদ বোধ করছি। আমার কোনো বাজে অভিজ্ঞতাও হয়নি।’
অন্যদের মতো এনটিভি অনলাইন থেকেও প্রশ্ন করা হয়, বিয়ে করছেন কবে?
‘এই প্রশ্নটি শুধু নারীদেরই করা হয়। পুরুষদের প্রশ্নটি করা হয় না। বাংলাদেশের মেয়েদের তাড়াতাড়ি বিয়ে হলেও সুইজারল্যান্ডের মেয়েদের বিয়ে হয় সাধারণত ২৯ থেকে ৩৫ বছর বয়সে। সাত বছর আগে আমি অন্তত বিয়ে করছি না,’ সাফ জবাব করিনার।
করিনা বলেন, ‘ট্রাফিক জ্যাম আমার কাছে ওয়ান্ডারল্যান্ড। ঢাকার রিকশা আমার খুব পছন্দ। রিকশার পেছনে থাকা এর শিল্পকর্ম আরো বেশি পছন্দ।’
কথা বলার ফাঁকে এবারের অমর একুশে বইমেলায় প্রকাশিত তিনটি বই করিনাকে উপহার দেওয়া হয়। এর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটি বই ছিল।
এই সময় সাকিয়া জানান, করিনাকে তিনি ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সব ইতিহাস জানিয়েছেন করিনাকে। রোববার ২১ ফেব্রুয়ারির দিন তিনি করিনাসহ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গিয়ে ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান।
করিনা বাংলাদেশে এসে এরই মধ্যে বেশ কিছু বাংলা শব্দ শিখেছেন। যেমন : দুধ চা, রং চা, কলা, বাচ্চা, কেমন আছেন, ভালো আছি ইত্যাদি। কোন ধরনের চা খাবেন জানতে চাইলে করিনা বলেন, দুধ চা।
এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে করিনা ইংরেজিতেই কথা বলেন। এ ছাড়া তিনি সুইজারল্যান্ডের সরকারি ভাষা জার্মান, ইটালি, ফরাসি ও রোমানস ভাষায় কথা বলতে পারেন বলে জানান।
করিনার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, বিদেশি পর্যটকদের জন্য সরকার কী করতে পারে? জবাবে করিনা জানালেন, বিশ্বের অন্য দেশগুলোর চেয়ে বাংলাদেশে অনেক সস্তায় আরামদায়ক ভ্রমণ করা যায়। তবে কিছু বিষয়, যেমন দূরত্ব নির্দেশনা। ধরুন কুয়াকাটা এত কিলোমিটার এই বিষয়টি ইংরেজিতে বড় করে থাকলে (অনেক জায়গায় নেই) বিদেশি পর্যটকদের জন্য সুবিধা হয়। বাংলাদেশের লোকজন যত্রতত্র ময়লা ফেলে। এটি তাঁকে ব্যথিত করেছে। এ জন্য দেশের প্রতিটি স্থান বিশেষ করে পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে ময়লা ফেলার জন্য যাতে নির্দিষ্ট স্থান থাকে এবং সবাই যেন সেখানে ময়লা ফেলে সে ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে সরকারের কাছে অনুরোধ জানান করিনা।
সবশেষে করিনা ও সাকিয়া দুজনই জানান, ভ্রমণ তাঁদের কাছে নেশার মতো। নেশার কারণ জানতে চাইলে করিনা বলেন, মানুষ মাত্রই কৌতূহলী হয়। কিন্তু তিনি বড় হওয়ার পরও এই কৌতূহল ধরে রেখেছেন। এই জন্য নানা রকম মানুষ তাঁর ভালো লাগে।
আলাপচারিতা শেষে করিনাকে এগিয়ে দিতে আমরা নামি বিএসইসি ভবনের নিচে। সেখানে সবাই মিলে করিনার সঙ্গে সেলফি তুলি। আর করিনা এগিয়ে যান নিচে প্রবেশপথে দায়িত্বরত ভবনের নিরাপত্তা প্রহরীর কাছে। তাঁর সাদা দাড়ির কিছু অংশ ছিল মেহেদি রাঙানো। করিনা অনুমতি নিয়ে তাঁর সঙ্গে সেলফি তোলেন। বললেন, দাড়িতে মেহেদি রাঙানো এই রকম মানুষ তাঁর খুব পছন্দ।