দেড় হাজার বছরের পুরোনো বিহারে খনন শুরু

Looks like you've blocked notifications!
নওগাঁর রানীনগর উপজেলার উজালপুর গ্রামে হাজার বছরের পুরাকীর্তি উদ্ধারে চলছে খননকাজ। ছবি : এনটিভি

নওগাঁর বদলগাছি উপজেলার পাহাড়পুরে বহু আগেই আবিষ্কৃত হয়েছে সোমপুর বৌদ্ধবিহার, হলুদ বিহার। ধামইরহাট উপজেলায় আছে ঐতিহাসিক জগদ্দল বিহার। এবার রানীনগর উপজেলার উজালপুরে প্রায় দেড় হাজার বছরের প্রাচীন আরো চারটি বৌদ্ধবিহারের সন্ধান পাওয়া গেছে।

গতকাল বুধবার রানীনগর উপজেলার একডালা ইউনিয়নের উজালপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, অনুসন্ধানী দল মনোযোগ দিয়ে বিহার আবিষ্কারের কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা জাদুঘরের সহকারী পরিচালক, প্রত্নতত্ত্ববিদ ও পিএইচডি গবেষক মোহাম্মদ আবু আল হাসানের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের একটি দল এই খননকাজ করে। 

গবেষক দল সূত্রে জানা যায়, দেড় বছর ধরে প্রত্নতত্ত্ব গবেষক মোহাম্মদ আবু আল হাসান পুরাকীর্তি নিদর্শন আবিষ্কারে ব্যাপক গবেষণা শুরু করেন। তাঁর গবেষণায় রানীনগর উপজেলার একডালা ইউনিয়নে রাজাপুর ঢিবি, দীঘিরপাড় দীপ, ঘোড়াপাতা ও উজালপুরে পাল বংশেরও আগের প্রায় দেড় হাজার বছরের প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন থাকার সম্ভাবনা উঠে আসে। এর পরই তথ্য অধিদপ্তরের অনুমতি নিয়ে ব্যক্তিগত অর্থায়নে জেলা-উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় গত রোববার থেকে শুরু হয় খননকাজ।
 
এ বিষয়ে আবু আল হাসান জানান, নওগাঁ জেলার বদলগাছি, ধামইরহাট, সাপাহার, নিয়ামতপুরসহ অন্য উপজেলাগুলোতে ঐতিহাসিক নিদর্শন রয়েছে। তবে জেলার রানীনগর ও আত্রাই এলাকায় অনেক উঁচু ঢিবি থাকলেও সেখানে কোনো অনুসন্ধান চালানো হয়নি। এমন চিন্তাধারা থেকে ওই সব এলাকা থেকে দেড় বছর ধরে অনুসন্ধান চালিয়ে রানীনগর উপজেলার ওই চারটি স্থানে পাল বংশ এবং তার আগের সময়ের প্রাচীন পুরাকীর্তির সন্ধান পাওয়া যায়। 

এর পর ২০১৫ সালের জুলাই থেকে উজালপুর গ্রামের ঈদগাহ মাঠের ঢিবির পরীক্ষা-নিরীক্ষায় প্রাথমিকভাবে ঐতিহাসিক নিদর্শন থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায়। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অনুমতি নিয়ে চলতি বছরের ১৭ এপ্রিল থেকে ব্যক্তিগত উদ্যোগে খননকাজ শুরু হয়। 

পাহাড়পুর বিহারের মতো অবকাঠামো
আবু আল হাসান বলেন, খননকালে পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারের আকৃতিতেই অবকাঠামো পাওয়া গেছে। পুরোপুরি নিশ্চিত না হলেও প্রাথমিকভাবে এটি বৌদ্ধদের কোনো জ্ঞানভিত্তিক প্রতিষ্ঠান বলেই প্রতীয়মান হয়েছে। খননকাজ করতে গিয়ে মাটির নিচে বিহারের অবকাঠামোই বলছে এটি বৌদ্ধদের ধর্মচর্চার একটি বিদ্যাপীঠ ছিল। কারণ, এই বিহারের সঙ্গে জেলার পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারের অবকাঠামোর যথেষ্ট মিল রয়েছে। তিনি বলেন, খননকাজ করতে গিয়ে চিনামাটির বদনা, বাটি ও মূর্তি পাওয়া গেছে। সেগুলো সমসাময়িক পাল রাজত্বকালের আগের ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। তবে পুরো খননকাজ শেষ না করা পর্যন্ত বিহারটি সম্পর্কে সঠিকভাবে কিছু বলা যাবে না। 

খননকাজ দেখতে ছুটে আসেন বরেণ্য গবেষক ড. পিনাকী ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, এই বিহারগুলো পুরোপুরি উন্মোচিত হলে জেলা তথা দেশের ইতিহাসে নতুন মাত্রা যোগ হবে। এ ধরনের আরো অনেক বিহার ছড়িয়ে আছে। তাই আরো ব্যাপক গবেষণার প্রয়োজন আছে।

পিনাকী বলেন, এ ধরনের বিহারের খনন অনেক ব্যয়বহুল। তাই ব্যক্তি উদ্যোগে খননকাজ চালিয়ে যাওয়া খুব কঠিন। সেই জন্য খননকাজ চালিয়ে যেতে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সহযোগিতা চান তিনি। 

আনন্দিত স্থানীয় লোকজন
ঐতিহ্যবাহী বিহার আবিষ্কারের খবরে খুশি স্থানীয় লোকজন। উজালপুর গ্রামের প্রবীণ আবদুল গণি (৬৫), আলহাজ তফছের আলী (৭০) ও এই প্রজন্মের কিশোর ওসমান গনির (১৭) ভাষ্য, শত শত বছর ধরে এই উঁচু ঢিবি এখানে অবস্থান করছিল। এটি কোনো ইতিহাস-ঐতিহ্যের নিদর্শন হতে পারে, তা তাঁদের ভাবনায় ছিল না। প্রাথমিকভাবে এই ঢিবির উচ্চতা ছিল ১৫ থেকে ১৭ ফুট পর্যন্ত। পরবর্তী সময়ে সরকারের ৪০ দিনের কর্মসৃজন কর্মসূচির আওতায় এখান থেকে মাটি কেটে ঈদগাহ হিসেবে ব্যবহার শুরু হয়। বছরে দুটি ঈদের জামাত পড়া শুরু হয়। বর্তমানে এটি কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে জেনে তাঁরা আনন্দিত। এ জন্য তাঁরা প্রত্নতত্ত্ববিদ আবু আল হাসানের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। 

স্থানীয় সাংসদের ভাষ্য
এ বিষয়ে কথা হয় স্থানীয় সাংসদ ইসরাফিল আলমের সঙ্গে। তিনি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর শুধু স্বপ্ন দেখায়, বাস্তবে কিছুই করে না। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত পতিসর, গান্ধী আশ্রম, পাহাড়পুরসহ জেলায় অসংখ্য ঐতিহাসিক নিদর্শন রয়েছে। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এসব নিদর্শন অধিগ্রহণ করলেও দৃশ্যমান কোনো সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এই পুরাকীর্তিগুলোতে অর্থ বরাদ্দ করে আন্তরিকতার সঙ্গে সংস্কারকাজ সম্পন্ন করতে পারলে একদিকে যেমন প্রাচীন ইতিহাস আজকের প্রজন্ম জানতে পারবে, তেমনি নওগাঁর পর্যটনশিল্পের দ্বারও খুলে যাবে।

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের বগুড়া অঞ্চলের সহকারী কাস্টডিয়ান মো. জায়েদ বলেন, উজালপুর গ্রামের ঢিবি খনন করে এখন পর্যন্ত ইটের আকৃতি, বিহারের অবকাঠামো দেখে মনে হচ্ছে এটি পাল সময় কিংবা তার আগের সময়ের নিদর্শন হতে পারে। তিনি বলেন, সরকারি উদ্যোগে আবিষ্কৃত ঢিবিগুলো খনন করা হবে কি না, তা এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি।