ঠিকাদারি ব্যবসার দ্বন্দ্বে খুন হন আ. লীগ নেতা টুকু!

Looks like you've blocked notifications!

ঠিকাদারি ব্যবসাকে কেন্দ্র করে পরিকল্পিতভাবে খুন করা হয়েছে রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ ও রাজশাহী চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সাবেক প্রশাসক জিয়াউল হক টুকুকে। এমনটিই দাবি করেছেন টুকুর ঘনিষ্ঠজনরা।

হত্যাকাণ্ডের পর কৌশলে পালিয়ে যাওয়া নয়ন নামের ঢাকার এক যুবক ফোনে হত্যাকাণ্ডের কথা স্বীকার করার পর ২৪ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও তাঁর হদিস পায়নি পুলিশ। ধরা পড়েনি হত্যাকাণ্ডের সময় সেখানে থাকা টুকুর বন্ধু তরিকুল ও তাঁর গাড়ির চালক। ফলে টুকুকে কেন খুন করা হয়েছে, সে রহস্য নগরবাসীর এখনো অজানা। তবে ঘটনার সময় টুকুর চেম্বারে থাকা টুকুর সঙ্গী রবিউল ও জসিম ঘটনার পর থেকে পুলিশের হেফাজতে রয়েছে।

এদিকে সোমবার বিকেলে নিহত জিয়াউল হক টুকুর স্ত্রী শামসুন্নাহার লতা বাদী হয়ে নগরীর বোয়ালিয়া মডেল থানায় হত্যা মামলা করেছেন।

বোয়ালিয়া মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহাদত হোসেন খান বলেন, পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ এনে নিহত টুকুর স্ত্রী শামসুন্নাহার লতা বিকেলে থানায় মামলা করেছেন। মামলায় টুকুর ব্যবসায়িক অংশীদার ঢাকার একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নয়ন, পুলিশের হাতে আটক রবিউল ইসলাম, জসিম উদ্দিন ও রাজশাহী নগরীর তরিকুল ইসলামসহ পাঁচজনকে আসামি করা হয়েছে।

টুকু হত্যাকাণ্ডের পর ঘটনার সময় টুকুর চেম্বারে থাকা নয়ন রোববার রাতে রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদ ও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটনকে ফোনে টুকুতে হত্যার কথা স্বীকার করে ঢাকার আদালতে আত্মসমর্পণের কথা বলেছিলেন। তবে নয়ন আওয়ামী লীগ নেতাদের ফোনে বলেছিলেন, ঘটনার সময় টুকুর লাইসেন্স করা পিস্তল নয়নের হাতে ছিল। ম্যাগাজিনটা পরীক্ষার সময় অসাবধানতাবশত গুলি বের হয়ে টুকুর বগলে লাগে। কিন্তু ময়নাতদন্তে নয়নের কথার সত্যতা মেলেনি। রোববার রাতে টুকুর লাশের ময়নাতদন্ত হয় রাজশাহী মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগে।

এ বিভাগের প্রধান ডা. এনামুল হক জানান, টুকুকে পেছন থেকে গুলি করা হলে রক্তক্ষরণে তাঁর মৃত্যু হয়েছে।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, টুকুর স্বঘোষিত কিলার নয়নের বিস্তারিত কোনো ঠিকানা তারা জানে না। সোমবার নিহত টুকুর স্ত্রী যে মামলা করেছেন, সেখানে এজাহারে নয়নের ঠিকানা উল্লেখ করা হয়েছে মতিঝিল, ঢাকা। দুই নম্বর আসামি তরিকুল নগরীর বোসপাড়া এলাকার ডা. সালাহ উদ্দিনের ছেলে। পুলিশ হেফাজতে থাকা রবিউলের বাড়ি নগরীর মহিষবাথানে ও জসিমের বাড়ি নিউমার্কেট এলাকায়।

মামলার আসামি হিসেবে যে অজ্ঞাত একজনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তাঁর কোনো ঠিকানা নেই। টুকু গুলিবিদ্ধ হওয়ার সময় এ পাঁচজন নগরীর নগর ভবনের সামনে টুকুর ব্যবসায়িক চেম্বারে উপস্থিত ছিলেন। মামলার ৫ আসামির মধ্যে রবিউল ও তরিকুল নিহত টুকুর সঙ্গে ঠিকাদারি ব্যবসা করতেন। বাকিরা কে কী করতেন সে সম্পর্কে কোনো তথ্য দিতে পারেনি টুকুর  স্ত্রী ও পরিবারের লোকেরা। 

টুকুর স্ত্রী শামসুন্নাহার লতা মামলার এজাহারে উল্লেখ করেছেন, রোববার বিকেলে তাঁর স্বামীর ব্যবসায়িক চেম্বারে বসে এই ৫ ব্যক্তি আলোচনা করছিলেন। এর মধ্যে নয়ন তাঁর স্বামীর লাইসেন্স করা অস্ত্রটি কেড়ে নিয়ে তাঁকে পেছন থেকে গুলি করেন। এর ফলে টুকু নিহত হয়। এজাহারে টুকুর স্ত্রী উল্লেখ করেছেন, হত্যাকারীরা ধরা পড়লে তাঁর স্বামী খুনের প্রকৃত কারণ ও রহস্য বের হয়ে আসবে।   

আওয়ামী লীগ নেতা টুকু হত্যায় জড়িত সন্দেহে আটক রবিউল ও জসিমকে জিজ্ঞাসাবাদ করে কী তথ্য পাওয়া গেছে তা তদন্তের স্বার্থে বলতে রাজি নয় পুলিশ।

বোয়ালিয়া মডেল থানার ওসি শাহাদাত হোসেন খান বলেন, আটক দুজনকে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। বাকিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। তিনি বলেন, নয়নের ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য চাওয়া হয়েছে। নয়নকে গ্রেপ্তার করতে পারলেই খুনের আসল রহস্য বেরিয়ে আসবে বলে জানান তিনি।

ঠিকাদারী ব্যবসার দ্বন্দ্বে খুন

জিয়াউল হক টুকুর হত্যাকাণ্ড নিয়ে চাঞ্চল্যকর কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। একাধিক সূত্র জানায়, সম্প্রতি বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) একটি কাজ পায় টুকুর ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান মেসার্স প্রমিনেন্ট কন্সট্রাকশন। এ কাজে তাঁর সঙ্গে পার্টনার হিসেবে যুক্ত হয় ঢাকার একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এ কাজ নিয়ে ঢাকার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে টুকুর দেনা পাওনা ছিল। এ নিয়ে কিছুদিন থেকে তাঁদের মধ্যে দ্বন্দ্বও চলে আসছিল। ১০ দিন আগে টুকু ঢাকায় গিয়ে তাঁর পাওনা পরিশোধের জন্য চাপ দেয় ঢাকার প্রতিষ্ঠানকে। এরপর দুইদিন আগে ওই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান থেকে নয়নকে রাজশাহীতে পাঠানো হয়। দুইদিন থেকে নয়ন রাজশাহীতেই অবস্থান করছিল।

হত্যাকাণ্ডের দিন রোববার দুপুরে নয়ন, টুকু, তরিকুল ও অজ্ঞাত একজন একত্রে টুকুর চেম্বারে বসে দুপুরের খাবার খায়। সেখানে টেবিলে থাকা টুকুর লাইসেন্স করা পিস্তল দিয়ে পেছন থেকে তাঁকে গুলি করা হয়। এ সময় টুকুর দুই বন্ধু জসিম ও রবিউল তিন কক্ষবিশিষ্ট চেম্বারের বাইরের কক্ষে থাকলেও নয়ন, তরিকুল ও অজ্ঞাত একজন টুকুর ঘরেই ছিলো।

সেখানে নাটক সাজিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে প্রচার করা হয়, টুকু তাঁর পিস্তল পরিষ্কার করতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ  হয়েছেন। এ তথ্য সাংবাদিকদেরও জানানো হয়। তবে সন্ধ্যার পর হত্যাকাণ্ডের রহস্য বেরিয়ে আসে। এরপর থেকেই আত্মগোপনে চলে যায় ঢাকার যুবক নয়ন, স্থানীয় তরিকুল ও অজ্ঞাত একজন।

টুকুর ঘনিষ্টরা জানায়, নয়ন পেশাদার খুনি। ব্যবসায়িক হিসাব- নিকাশ নিয়েই টুকুকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে।

জিয়াউল হক টুকুকে পেছন থেকে গুলি করার কথা বলেছেন রাজশাহী মেডিকেল কলেজের (রামেক) ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের ডা. এনামুল হকও। ময়নাতদন্ত শেষে তিনি জানান, টুকুকে পেছন থেকে গুলি করা হয়েছে। পিঠের দিকে যে ফুটো আছে তা তুলনামূলক ছোট। এছাড়া বুকের হাড়ের ভেতরের অংশে গুলির জখম পাওয়া গেছে। এ থেকে বিষয়টি বোঝা যায় যে, টুকুকে পিঠের সাইড থেকে গুলি করা হয়েছে। গুলি হাড়ের ভেতরের অংশ জখম করে অল্প ওপর দিয়ে বেরিয়ে যায়। গুলিতে টুকুর ফুসফুসের নিচের অংশ জখম হয়।

অধ্যাপক ডা. এনামুল হক জানান, ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন এখনো দেওয়া হয়নি। কয়েকদিনের মধ্যে টুকুর বিস্তারিত ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে। রোববার রাত ৮টার দিকে তাঁর ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়।

এদিকে টুকুসহ নগরীতে গত শুক্রবার থেকে রোববার পর্যন্ত তিন দিনে চার খুনের ঘটনায় উদ্বিগ্ন পুলিশ প্রশাসন কোনো খুনেরই কুল কিনারা করতে পারছে না। সোমবার দুপুরে রাজশাহী মহানগর পুলিশ (আরএমপি) কমিশনার নগরীর চার থানার ওসিসহ বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাদের নিয়ে জরুরি মিটিং করেছেন। এ সময় পুলিশ কমিশনার সাম্প্রতিক খুনের ঘটনাবলীতে দ্রুত অপরাধীদের গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেন সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের।

এদিকে সোমবার সকাল ১০টায় শহীদ কামারুজ্জামান চত্বরে টুকুর জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন রাজশাহী-২ আসনের সাংসদ ফজলে হোসেন বাদশা, রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন, রাজশাহী সিটি করপোরেশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত মেয়র নিযাম উল আযিম, রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদ, রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক জামাত খান প্রমুখ। বক্তারা টুকুর খুনিদের গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান। জানাজা শেষে হেতেম খাঁ গোরস্থানে টুকুর মরদেহ দাফন করা হয়েছে।

রোববার বিকেলে ৪টার দিকে নগর ভবনের সামনের ব্যবসায়িক চেম্বারে ব্যবসায়িক অংশীদার নয়নের হাতে থাকা পিস্তলের গুলিতে নিহত হন জিয়াউল হক টুকু। এ ঘটনায় নগরীতে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। পুলিশ চেম্বার থেকে পিস্তল ও কনস্ট্রাকশনের কাগজপত্রও জব্দ করেছে।