টেকনাফে আনসার ক্যাম্পে হামলা

গ্রেপ্তার নেই, অস্ত্র উদ্ধার হয়নি

Looks like you've blocked notifications!
ছবি : এনটিভি

কক্সবাজারের টেকনাফের নয়াপাড়া রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে আনসার কমান্ডার হত্যার ঘটনায় কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।  লুট হওয়া ১১টি আগ্নেয়াস্ত্র ও ৬৭০টি গুলি উদ্ধার করাও সম্ভব হয়নি।

আজ শুক্রবার রাত ১১টা পর্যন্ত সবশেষ এ তথ্য জানান টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল মজিদ।

গতকাল বৃহস্পতিবার দিনগত রাত আড়াইটার দিকে নয়াপাড়া রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পের অভ্যন্তরে শালবন আনসার ব্যারাকে এ হামলার ঘটনা ঘটে। হামলায় নিহত আনসার কমান্ডার হলেন টাঙ্গাইলের শফিপুরের আলী হোসেন (৫৫)।

এ ঘটনার পর আজ সকালে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক আলী হোসেন, বিজিবি সেক্টর কমান্ডার কর্নেল তানভীর আহমেদ, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) পরিচালক কর্নেল নুরুল আনোয়ার, ডিআইজি শফিকুল ইসলাম, পুলিশ সুপার শ্যামল কুমার নাথ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। সকাল থেকে বিপুলসংখ্যক পুলিশ, বিজিবি, র‌্যাব সদস্য আনসার ক্যাম্পের অভ্যন্তরে ও আশপাশে অবস্থান নেন। বিকেলে লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার ও হামলাকারীদের আটকে ক্যাম্পের পার্শ্ববর্তী পাহাড়ে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর আস্তানায় যৌথ অভিযান শুরু হয়েছে।

এ ঘটনায় এলাকায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। সরেজমিন পরিদর্শনে জানা যায়, নয়াপাড়া রেজিস্টার্ড রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পের অভ্যন্তরে ২৯ আনসার ব্যাটালিয়ন সদস্যদের তিনটি ব্যারাকে প্রায় ৭০ জনের মতো আনসার সদস্য দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। শরণার্থী ক্যাম্পের সর্ব দক্ষিণের ব্যারাকটি ছিল শালবন ব্যারাক। অনেকটা ক্যাম্পের বাইরে পাহাড়সংলগ্ন অরক্ষিত স্থানে অবস্থিত ব্যারাকটিতে ১৪ জন আনসার সদস্য দায়িত্বরত থাকলেও ঘটনার সময় নয়জন উপস্থিত ছিলেন। রাত ২টায় যখন সেন্ট্রি পোস্টে টহল বদল হয়ে একজন দায়িত্বে অপরজন বিশ্রামে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, এমন সময় হামলার ঘটনা ঘটে। ব্যারাকের বাকি সদস্যরা এ সময় ঘুমে ও বিশ্রামে ছিলেন। 

রাত ২টার পর টহল পোস্টে আসা সিপাহি অজিত বড়ুয়া জানান, ব্যারাকের পাশ দিয়ে তিনজন লোককে হেঁটে যেতে দেখে জিজ্ঞেস করলে তারা সামাজিক বনায়নের পাহাড়ে যাচ্ছেন বলে জবাব দেন। এর সঙ্গে সঙ্গে পেছন থেকে অপর চারজন এসে তাঁকে মাথায় অস্ত্র তাক করে হাত-পা বেঁধে ফেলে। এ সময় তাঁর চিৎকারে আনসার কমান্ডার আলী হোসেন ব্যারাকের বাইরে এলে দুর্বৃত্তদের সঙ্গে তার হাতাহাতি হয়। একপর্যায়ে অস্ত্রের মুখে ব্যারাকের নয়জন আনসার সদস্যকে তারা জিম্মি করে ফেলে। পরে অস্ত্রাগার ভেঙে দুটি এসএমজি, পাঁচটি রাইফেল, চারটি এমটু রাইফেল ও ৬৭০টি গুলি লুট করে সটকে পড়ে। সশস্ত্র ডাকাতদল সংখ্যায় ২০ থেকে ২৫ জন এবং তাদের প্রত্যেকের হাতে রিভলবার-জাতীয় ছোট অস্ত্র ছিল বলে আনসার সদস্যরা জানান।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এদের মধ্যে অর্ধেকের মুখোশ ছিল, বাকি ৮-১০ জনের মুখোশ ছিল না। আনসার সদস্যরা জানান, তাদের কখনো ক্যাম্পে দেখা যায়নি। সশস্ত্র ব্যক্তিরা যাওয়ার পর আনসার কমান্ডার আলী হোসেনকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় উদ্ধার করে স্থানীয় ক্লিনিকে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। দুপুরের দিকে আলী হোসেনের মৃতদেহ ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে পাঠানো হয়। ঘটনার পর সশস্ত্র জঙ্গিরা ক্যাম্পের দক্ষিণ দিক দিয়ে পাহাড়ের দিকে চলে যায়। পরে তাদের একটি দলকে নয়াপাড়া এলাকা দিয়ে নাফ নদীর বেড়িবাঁধ পর্যন্ত যেতে দেখেছে স্থানীয়রা।

এদিকে সশস্ত্র ব্যক্তিরা গ্রামের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় স্থানীয় আবদুল আমিন নামে এক যুবকের সঙ্গে বাদানুবাদ হয়। এ সময় জঙ্গিরা তার মাথায় ছুরিকাঘাত করে। বর্তমানে আহত ব্যক্তি কক্সবাজার সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এ সময় তিনি রফিক নামে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এক ডাকাতকে চিনতে পারেন বলে জানা গেছে। 

এদিকে, এ ঘটনার পর রোহিঙ্গা ক্যাম্পসহ আশপাশের গ্রামে চরম আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। তা ছাড়া প্রকৃতপক্ষে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আনসার ব্যারাকে হামলা চালিয়ে আনসার কমান্ডারকে হত্যা করে অস্ত্র লুট করে।

এ নিয়ে স্থানীয় লোকজন বলছেন, এটি সাধারণ কোনো ডাকাতির ঘটনা নয়। সাধারণত ডাকাতদের লক্ষ্যই থাকে আর্থিক বিষয়ের ওপর। এ ক্ষেত্রে তা ঘটেনি।

টেকনাফ উপজেলা আনসার-ভিডিপি অফিসার মোস্তফা কামাল জানান, টেকনাফের হ্নীলা নয়াপাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের শালবাগানে দায়িত্বরত ২৯তম ব্যাটালিয়ানের আনসার ব্যারাকে ১৫ জন আনসার সদস্য থাকার কথা। ঘটনার রাতে ছিল নয়জন। লুট হওয়া অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে দুটি এসএমজি, ৯টি রাইফেল এবং ৬৭০টি গুলি।

এ ব্যাপারে নয়াপাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আনসার ইনচার্জ আলমগীর হোসেন বাদী হয়ে টেকনাফ মডেল থানায় মামলা দায়ের করেছেন। তিনি জানান, লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধারে যৌথ অভিযান শুরু হয়েছে।

বছর খানেক আগে নয়াপাড়া রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে আনসার সদস্যদের সঙ্গে সশস্ত্র রোহিঙ্গা ডাকাতদলের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছিল। ওই ঘটনায় রোহিঙ্গা ডাকাতসর্দার আবদুল হাফেজ আনসার সদস্যদের গুলিতে নিহত হন। সেদিনের ঘটনায় আহত হয়েছিল রফিক নামে অপর এক রোহিঙ্গা ডাকাত। সে নয়াপাড়া শরণার্থী ক্যাম্পের ডি ব্লকের বাসিন্দা। গতকালকের হামলার ঘটনায় এই রফিকও ছিল বলে চিনতে পেরেছেন স্থানীয় আবদুল আমীন।

স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হামলায় স্থানীয় রোহিঙ্গা ডাকাতদের সাথে উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পের ফেরারি দুর্বৃত্তরা অংশ নিয়েছিল। কারণ হামলার সময় মুখোশ না পরা যে ৮-১০ ব্যক্তি ছিল তারা বাইরের। কেননা ক্যাম্পের আনসার সদস্যরা তাদের দেখে ও চিনতে পারেনি।

স্থানীয়রা জানায়, উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পে কিছুদিন ধরে অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে বেশ কয়েকটি হত্যার ঘটনা ঘটে। এসব হত্যাকাণ্ডের ফেরারি দুর্বৃত্তরা এর পর থেকেই নয়াপাড়া ক্যাম্পে ও আশপাশের পাহাড়ে অবস্থান করছিল। এ ছাড়া টেকনাফের গহিন পাহাড়ে অবস্থান করা রোহিঙ্গা জঙ্গি আবদুল হাকিম বেশ কিছুদিন ধরে নয়াপাড়া ক্যাম্পসংলগ্ন পাহাড়ে আস্তানা গেড়েছিল বলে জানা গেছে।

নয়াপাড়া ক্যাম্পের সাধারণ শরণার্থীরা অভিযোগ করেছেন, ক্যাম্পের অভ্যন্তরে দায়িত্বরত পুলিশ ক্যাম্পের সদস্যদের সঙ্গে রোহিঙ্গা অপরাধীদের রয়েছে গভীর সখ্য।