অদম্য সবুজ

Looks like you've blocked notifications!
শারীরিক অক্ষমতাকে ছাপিয়ে প্রতিষ্ঠিত হতে চান সাতক্ষীরার সবুজ। ছবি : এনটিভি

‘বাসে উঠতে গেলে শিশু বলে পাত্তা দেয় না কেউ। কোনো কাজে সহায়তা চাইলেও ছোট মানুষ বলে অবজ্ঞা করে অনেকে। অথচ আমি একজন পরিপূর্ণ মানুষ, এ কথাটা কেউ মানতেই চায় না।’

কথাগুলো বলছিলেন সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ উপজেলার মথুরেশপুর ইউনিয়নের নিত্যানন্দপুর গ্রামের রেজাউল করিম সবুজ। ২৫ বছর বয়সী সবুজের উচ্চতা মাত্র তিন ফুট সোয়া তিন ইঞ্চি। ওজন ১৯ কেজি।

সবুজরা চার ভাইবোন। সবার ছোট বোন তাসনিমা পারভীন এবার এসএসসি পাস করেছে। ছোট ভাই হাবিবুর রহমান তাঁর মতোই খাটো। ওজন ২০  কেজি।

হাবিবুর এইচএসসি পাস করে ডিগ্রিতে ভর্তি হয়েছেন। আর সবার বড় ভাই রবিউল ইসলাম অ্যাকাউন্টিংয়ে অনার্স করে ঢাকায় ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স করছেন। সবুজের বাবা আবদুল জব্বার গাজী একজন রাজমিস্ত্রি। মা ফিরোজা বেগম গৃহবধূ।

১৯৮২ সালে পরিবারের সবাইকে নিয়ে বান্দরবানে সরকারের দেওয়া ১৫ একর পাহাড় কাটা জমিতে পরিবার নিয়ে বসবাস করতে শুরু করেন সবুজের বাবা। ওইসব এলাকায় ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব বেশি। গর্ভাবস্থায় সবুজের মায়ের ম্যালেরিয়া দেখা দেয়। এর প্রভাব পড়েছে সবুজের শরীরেও। একই অবস্থা তাঁর ছোট ভাই হাবিবুরেরও। অবশেষে সবুজের বাবা বিষয়টি বুঝতে পেরে ১৩ বছর পর পরিবারের সবাইকে নিয়ে ফিরে যান গ্রামের বাড়ি সাতক্ষীরায়।

সবুজের ভাষ্য, ‘আমরা খুব গরিব। জমিজমা নেই। মাত্র ১০ কাঠা জমির ওপর আমার বাবা, এক চাচা ও এক ফুফুর  পরিবারের বসবাস। জমিজমা নেই । দারিদ্র্য লেগেই আছে।’

সবুজের হার্টে ব্লক আছে। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এত বড় রোগের চিকিৎসা করানো খুবই দুরূহ। সাতক্ষীরায় ডাক্তার দেখিয়েছি। এখন চিকিৎসা নিচ্ছি কলকাতার হোমিও ডাক্তার পি ব্যানার্জির। এখন সুস্থ।’

কোনো কঠিন পরিশ্রম করতে পারেন না সবুজ। ভারি কোনো কাজ তো নয়ই, ভারি বস্তু বহনও নিষেধ করেছে ডাক্তার।

সবুজের মা ফিরোজা বেগম জানান, সবুজ আর সাথী ছিল আমার যমজ সন্তান। জন্মের কিছুদিন পর সাথী মারা যায়। এর পর থেকে সবুজের শরীরের কোনো বৃদ্ধি লক্ষ্য করা যায়নি।

শিক্ষাজীবন

শরীরের এত অক্ষমতা নিয়েও দমে যাননি সবুজ। এখন তিনি ডিগ্রি ক্লাসের ছাত্র। নিজ গ্রাম হরিতলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পাস করার পর ২০১১ সালে উজ্জীবনী ইনস্টিটিউট থেকে বি গ্রেডে এসএসসি পাস করেন সবুজ। এরপর কাটুনিয়া ডিগ্রি কলেজ থেকে ২০১৪ সালে এইচএসসি পাস করেন এ গ্রেডে। এখন সবুজ শ্যামনগর সরকারি মহসিন ডিগ্রি কলেজের বিএ ক্লাসের ওল্ড ফার্স্ট ইয়ারের  ছাত্র।

নানা প্রতিভার সবুজ

সবুজ ক্রিকেট খেলেন, ব্যাডমিন্টন, ফুটবল, গাদন সবই খেলেন। বড়দের দলে, ছোটদের দলে নয়। রেসিংয়েও ভালো তিনি।

কালীগঞ্জের রেডিও নলতার মথুরেশপুর ইউনিয়ন প্রতিনিধি। নিয়মিত খবর পাঠান সেখানে। কয়েক মাস সাতক্ষীরার বুশরা হাসপাতালে চাকরিও করেছেন। কিন্তু রোগীদের রক্ত আর দেহের কাঁটাছেড়া দেখলে তার শরীর খারাপ লাগে, তাই ছেড়ে দিয়েছেন। এখন বাড়িতে থাকেন, নিয়মিত কলেজে যান। কখনো সাইকেলে, আবার কখনো বন্ধুদের মোটরসাইকেলে। তবে নিজে সাইকেল চালাতে পারেন না। বন্ধুরাই তাঁকে নিয়ে যায়।

সবুজের ইচ্ছে

অদম্য সবুজ মানুষের কল্যাণে কাজ করতে চান। তাইতো তার আশা পাড়াশোনা করে সরকারি চাকরি করার। সেই সঙ্গে সাংবাদিকতায়ও তাঁর আগ্রহ। আর তাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করতে চান।

“আমি একজন প্রতিবন্ধী। আমার কষ্টের সাথে অন্য প্রতিবন্ধীদের কষ্টও ভাগাভাগি করে নিতে চাই। তাদের কল্যাণে কাজও করতে চাই আমি। আমার বাসনা সাতক্ষীরায় ‘ বঙ্গবন্ধু প্রতিবন্ধী স্কুল ’ গড়ে তোলা”, বলেন সবুজ।

‘প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাই আমি। আমার বিশ্বাস প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করে একটু কথা বলার সুযোগ পেলে তিনি নিশ্চয়ই আমাকে সহযোগিতা করবেন’ যোগ করেন সবুজ।

সবুজের মা ফিরোজা বেগম বলেন, ‘ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করাতে অনেক টাকার দেনা আমাদের। তার ওপর দুটি সন্তান অসুস্থ। তাদের চিকিৎসা করানোর সাধ্য আমার পরিবারের নেই।  কেউ যদি একটু সাহায্যের হাত বাড়াত, তবে  দুটি প্রতিবন্ধী ছেলে নিয়ে আমার ভোগান্তি কিছুটা হলেও কমত।’