আনিসুল হকের চেয়ে স্ত্রীর আয় বেশি

বাড়ি নেই, পরিবারের কারো গাড়িও নেই

Looks like you've blocked notifications!
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র পদপ্রার্থী আনিসুল হক। ফাইল ছবি

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র পদপ্রার্থী আনিসুল হকের নিজের নামে কোনো বাড়ি, ফ্ল্যাট, দোকান নেই। তাঁর নিজের বা পরিবারের কোনো সদস্যের গাড়িও নেই।

নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হলফনামায় এই মেয়র পদপ্রার্থী ব্যবসায়ী যেসব তথ্য দিয়েছেন, তাতে এমনটাই দেখা গেছে। হলফনামায় বাস, ট্রাক, মোটরগাড়ি, লঞ্চ, স্টিমার, বিমান ও মোটরসাইকেল ইত্যাদির বিবরণী লেখার যে ঘরটি আছে, সেটি রেখা টেনে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ আনিসুল হক, তাঁর স্ত্রী, পুত্র ও দুই কন্যার কারোরই কোনো ধরনের গাড়ি নেই। 

২০০৫ সালে হাইকোর্টে আবদুল মোমেন চৌধুরী বনাম বাংলাদেশ মামলার রায়ে নির্বাচনের প্রার্থীদের হলফনামায় নিজেদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, পেশা, মামলার বিবরণী এবং নিজেদের ও নির্ভরশীলদের আয়-ব্যয়, সম্পদ এবং দায়-দেনার তথ্য মনোনয়নপত্রের সঙ্গে জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়। 

হলফনামায় বলা হয়েছে, স্থাবর-অস্থাবর মিলিয়ে আনিসুল হকের মোট সম্পত্তি প্রায় সাড়ে ২৬ কোটি টাকার। এর মধ্যে নগদ অর্থ এক কোটি ৯৫ লাখ টাকা।

হলফনামায় আনিসুল হক জানান, তাঁর অস্থাবর সম্পত্তি ২৩ কোটি টাকার। এর মধ্যে নগদ অর্থ এক কোটি ৯৫ লাখ টাকা। এফডিআর (স্থায়ী আমানত) হিসেবে বিনিয়োগ রয়েছে তিন কোটি ৫৩ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। বন্ড, ঋণপত্র ও শেয়ার রয়েছে ১১ কোটি ৪৮ লাখ ৪৫ হাজার টাকার। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা করা অর্থ ছয় লাখ ৫৮ হাজার টাকা। স্বর্ণ, মূল্যবান ধাতু ও অলংকার ১১ লাখ ১২ হাজার টাকা। ‘অন্যান্য (ঋণ প্রদান)’ হিসেবে পাঁচ কোটি ৩৬ লাখ ৮৩ হাজার টাকার অস্থাবর সম্পদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে হলফনামায়। তাঁর আসবাব রয়েছে ১৪ লাখ ২৪ হাজার টাকার।

আনিসুল হকের স্থাবর সম্পত্তি রয়েছে সাড়ে তিন কোটি টাকার। হলফনামায় তিনি ২২টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করেছেন। তাঁর বার্ষিক আয় ৭৫ লাখ ৮০ হাজার টাকা। এর মধ্যে ৪৫ লাখ ৮৯ হাজার টাকা আসে এফডিআরের মুনাফা থেকে, ব্যবসায় পারিতোষিক হিসেবে পান ২৫ লাখ ৯২ হাজার টাকা, ‘বাড়ি/অ্যাপার্টমেন্ট/দোকান বা অন্যান্য ভাড়া’ থেকে তাঁর বার্ষিক আয় দুই লাখ ৪০ হাজার টাকা। বাকি আয় আসে শেয়ার, সঞ্চয়পত্র ও ব্যাংক আমানত থেকে।

আওয়ামী লীগ সমর্থিত এই প্রার্থীর স্থাবর সম্পদ (অকৃষি জমি) তিন কোটি ৫৭ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা।

স্ত্রীর আয় বেশি

হলফনামা অনুযায়ী, আনিসুল হকের ‘ওপর নির্ভরশীল’ তাঁর স্ত্রী রুবানা হক ব্যবসার পারিতোষিক পান স্বামীর সমান। টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ ২৫ লাখ ৯২ হাজার টাকা।

রুবানা হকের বার্ষিক আয় ৮৪ লাখ ৯৩ হাজার টাকা, যা আনিসুল হকের চেয়ে প্রায় ৯ লাখ টাকা বেশি। এফডিআর থেকে রুবানার আয় ৪০ লাখ ৪৪ হাজার টাকা, ব্যবসায় পারিতোষিক হিসেবে পান স্বামীর সমান, বাড়িভাড়া থেকে আয় ১৮ লাখ টাকা, বাকি আয় আসে শেয়ার সঞ্চয়পত্র থেকে।

রুবানা হকের অস্থাবর সম্পত্তির পরিমাণ পাঁচ কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে নগদ অর্থ ৩৩ লাখ ৫৬ হাজার টাকা। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা অর্থ ২৮ লাখ ২৪ হাজার টাকা। স্থায়ী আমানত চার কোটি ২৫ লাখ ৩৭ হাজার টাকা। অলংকার ৫০ হাজার টাকা, আসবাব ২০ হাজার টাকার। তাঁর স্থাবর সম্পদ রয়েছে (বাড়ি/অ্যাপার্টমেন্ট) ৭০ লাখ ৬১ হাজার টাকার।

সম্পদের ছয় গুণ ঋণ

বিভিন্ন ব্যাংক থেকে আনিসুল হকের নেওয়া ঋণের পরিমাণ ১৬৬ কোটি ৬২ লাখ টাকা, যা তার মোট স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের চেয়ে বেশি। যেসব ব্যাংক এখনো তাঁর কাছে টাকা পাবে সেগুলো হলো—সিটি ব্যাংক, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক, প্রিমিয়ার ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংক।

এ ছাড়া আনিসুল হকের দায়-দেনা রয়েছে পাঁচ কোটি ২৯ লাখ ৪৭ হাজার টাকা।

পারিতোষিকে বাবা-মাকে ছাড়িয়েছেন ছেলে

আনিসুল হকের ছেলে নাভিদুল হক তাঁদের ব্যবসা থেকে বছরে পারিতোষিক পান ২৮ লাখ ৭২ হাজার টাকা। তাঁর মা-বাবা পারিতোষিক পান ২৫ লাখ ৯২ হাজার টাকা। এ ছাড়া লভ্যাংশ থেকে বছরে তাঁর আয় ৩৭ হাজার টাকা।

নাভিদুল হকের স্থায়ী আমানত রয়েছে ৩১ লাখ ৪৯ হাজার টাকার; বন্ড, ঋণপত্র, শেয়ার রয়েছে ৫০ লাখ ২৫ হাজার টাকার। নগদ রয়েছে এক লাখ ৮৭ হাজার টাকা। তাঁর স্থাবর সম্পত্তির মধ্যে রয়েছে ৩ দশমিক ৮৫ কাঠা, যা তাঁকে হেবা করে দেওয়া হয়েছে।

দুই মেয়ের ২০ হাজার টাকার গয়না

আনিসুল হকের দুই মেয়ে ওয়ামিক উমায়রা ও তানিশা ফারিয়া মান হকের মোট গয়না রয়েছে ২০ হাজার টাকার। হলফনামা অনুযায়ী, তাঁরা দুজনেই আনিসুল হকের ‘ওপর নির্ভরশীল’। তাঁদের দুজনের রয়েছে ১০ হাজার টাকার করে গয়না।

মেয়ে ওয়ামিক উমায়রা ব্যবসা থেকে বছরে পারিতোষিক পান দুই লাখ ১৫ হাজার টাকা। এ ছাড়া তাঁর নামে শেয়ার, সঞ্চয়পত্র বা ব্যাংক আমানত রয়েছে এক লাখ ৯৭ হাজার ৪৬০ টাকার। এ ছাড়া এফডিআরের মুনাফা পান ১৬ লাখ টাকা।

ওয়ামিক উমায়রার অস্থাবর সম্পদের মধ্যে নগদ রয়েছে ২০ লাখ ৬৫ হাজার ২২৯ টাকা। ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিকপ্রতিষ্ঠানে তাঁর জমা রয়েছে ৪০ লাখ ৯২ হাজার ৫৫১ টাকার; বন্ড, ঋণপত্র, স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত ও তালিকাভুক্ত নয় এমন কোম্পানির শেয়ার রয়েছে তিন লাখ ২৩ হাজার টাকার।

ওয়ামিক উমায়রা পোস্টাল, সেভিংস সার্টিফিকেটসহ বিভিন্ন ধরনের সঞ্চয়পত্র বা স্থায়ী আমানতে বিনিয়োগ করেছেন এক কোটি ৫৩ লাখ টাকা। স্বর্ণ ও অন্যান্য মূল্যবান ধাতু ও পাথরনির্মিত অলংকার রয়েছে ১০ হাজার টাকার। আসবাব রয়েছে ২০ হাজার টাকার।

আনিসুল হকের এই মেয়ের স্থাবর সম্পত্তির পরিমাণ ৩ দশমিক ৮৫ কাঠা, যা তাঁর নামে হেবা করা হয়েছে।

আনিসুল হকের আরেক মেয়ে তানিশা ফারিয়া মান হক ব্যবসা থেকে পারিতোষিক পান বছরে এক লাখ ৯৬ হাজার টাকা। তাঁর অস্থাবর সম্পদের মধ্যে রয়েছে ১১ লাখ ২২ হাজার ৪৫০ টাকা; বন্ড, ঋণপত্র, স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত ও তালিকাভুক্ত নয় এমন কোম্পানির শেয়ার রয়েছে দুই লাখ ২৩ হাজার টাকার। আর স্বর্ণ ও অন্যান্য মূল্যবান ধাতু ও পাথরনির্মিত অলংকার রয়েছে মাত্র ১০ হাজার টাকার। তানিশার স্থাবর সম্পত্তির পরিমাণ ৩ দশমিক ৮৫ কাঠা। এটি তাঁর নামে হেবা করা হয়েছে।

আনিসুল হকের বিরুদ্ধে কোনো ফৌজদারি মামলা নেই বলে হলফনামায় উল্লেখ করা হয়েছে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নিতে গত রোববার নির্বাচন কমিশনে গিয়ে মনোনয়নপত্র জমা দেন ব্যবসায়ী আনিসুল হক।

আনিসুল হকের বক্তব্য

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা উত্তরের মেয়র পদপ্রার্থী ও মোহাম্মদী গ্রুপের চেয়ারম্যান আনিসুল হক এনটিভি অনলাইনকে বলেন, গ্রুপের অধীনে ২২টি কোম্পানি আছে। যেখানে প্রায় ১৫ হাজার লোক কাজ করে। এসব প্রতিষ্ঠানের সাধারণ কর্মকর্তাও সব সময়ের জন্য গাড়ি পান। চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি কোম্পানি থেকে সব সময়ের জন্য একাধিক গাড়ির সুবিধা পান। সারা জীবনের সব উপার্জন দিয়েই এসব কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছেন বলেও জানান এ ব্যবসায়ী নেতা। 

বাড়ির ব্যাপারে এ মেয়র পদপ্রার্থী বলেন, ‘রাজধানীর বনানীর ২৩ নম্বর রোডের ৮০ নম্বর বাড়িটিতে আমি থাকি। বাড়িটি বছরখানেক আগে তিন সন্তানের নামে লিখে দিয়েছি।’

আনিসুল হক আরো জানান, যেহেতু পরিবারের সবাই এক বাড়িতে থাকেন তাই স্ত্রী ও দুই মেয়েকে ‘তাঁর ওপর নির্ভরশীল’ বলা হয়েছে। তাঁর স্ত্রী মোহাম্মদী গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এবং মেয়ে ওয়ামিক উমায়রা জেনেভায় আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থায় (আইএলও) কাজ করেন।