প্রাণশঙ্কায় দেশ ছাড়ার চিন্তা হুমায়ুন আজাদের ছেলের
বরেণ্য লেখক হুমায়ুন আজাদের ছেলে অনন্য আজাদ জানিয়েছেন, ২০১৩ সালে গণজাগরণ মঞ্চের সঙ্গে কাজ করার সময় থেকেই নানা রকম হুমকি পেয়ে আসছেন। বিভিন্ন সময়ে নানাভাবে তাঁকে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে গত দুই মাসে লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায় এবং ওয়াশিকুর রহমান বাবুর হত্যাকাণ্ডের পর নিজের জীবন নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন তিনি। এমন অবস্থায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ ছেড়ে যাওয়ার চিন্তা করতে বাধ্য হয়েছেন বলে জানালেন অনন্য।
আজ রোববার এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে এক টেলিফোন আলাপে নিজের জীবন নিয়ে উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন তরুণ লেখক অনন্য আজাদ। তবে এসব হুমকির বিষয়ে পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে কোনো অভিযোগ করেননি অনন্য। নিরাপত্তা চেয়ে থানায় সাধারণ ডায়েরিও করেননি তিনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অনন্য বলেন, ‘২০১৩ সালে গণজাগরণ মঞ্চে কাজ করার সময় আমি যখন হুমকি পাই, তখন সে বিষয়ে জানত গোয়েন্দা সংস্থা। এমনকি হুমকির কারণে তারা আমার কয়েকটি ব্লগও মুছে দেয়। তবে হুমকি নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে পুলিশকে কিছু কখনো জানানো হয়নি।’
কিছুদিন আগে ভয়েস অব আমেরিকা তাঁর কাছে বাংলাদেশের লেখকদের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জানতে চায়। সেখানেই কথা প্রসঙ্গে উঠে আসে তাঁর বিরুদ্ধে অব্যাহত হুমকির কথা। ভয়েস অব আমেরিকা ও এপিকে দেওয়া তাঁর সাক্ষাৎকারটি বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ পায়।
আন্তর্জাতিক অনেক ব্লগার ও মানবাধিকারকর্মী অনন্যের জীবনের নিরাপত্তা বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়ে তাঁকে বার্তা পাঠিয়েছেন বলেও জানান তিনি। জীবন নিয়ে নানা আশঙ্কার কারণে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়া পর্যন্ত দেশের বাইরে যাওয়ার পরামর্শও দিয়েছেন অনেকে। নিজের মনেও এমন ভাবনা এসেছে বলে জানান অনন্য।
এ প্রসঙ্গে অনন্য বলেন, ‘আমি বা আমার বাবা কখনোই দেশ ছাড়ার কথা চিন্তাও করিনি। কিন্তু এখন যে পরিস্থিতি তাতে মনে হচ্ছে, কিছুদিন দেশের বাইরে গিয়ে কাটিয়ে এলে হয়তো ভালো হবে। কারণ, অভিজিৎ রায়ের ওপর হামলা হয়েছে। এর পর আমার ওপরও যদি হামলা হয়, তাহলে বাংলাদেশের মানুষ হয়তো জীবনের ভয়ে স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করতেই চাইবে না। কারণ তারা ভাববে, অজয় রায় বা হুমায়ুন আজাদের পরিবারের মানুষরাই যেখানে নিরাপদ নয়, সেখানে তাদের জীবনের নিরাপত্তা কোথায়?’
এর আগে সংবাদ সংস্থা এপিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অনন্য আজাদ বলেছিলেন, ‘যেকোনো সময় তাঁরা আমাকে বা আমার সমমনা বন্ধুদের আঘাত করতে পারে। তাদের নিজেদের বিশ্বাসের দোহাই দিয়ে আমাকে মেরে ফেলতে তাঁরা একটুও দ্বিধা করবে না। ধর্মান্ধদের জন্য আমি খুব সহজ লক্ষ্য।’
বার্তা সংস্থা এপি জানায়, অব্যাহত হুমকির মুখে ২৫ বছর বয়সী এই লেখক ও ব্লগার সংবাদপত্রে কলাম লেখার কাজ ছেড়ে দিয়েছেন। গত কয়েক মাসে তিনি কোনো ব্লগও লেখেননি। তার পরও ফেসবুকে তাঁর বিভিন্ন পোস্টে সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতে এখন দিনের বেশির ভাগ সময় ঘরে বন্দী অবস্থাতেই কাটাচ্ছেন তিনি।
এপির ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মুসলমানপ্রধান দেশ বাংলাদেশে বেশ কয়েক বছর ধরেই রক্ষণশীল ইসলামী দল ও ধর্মনিরপেক্ষ ব্লগারদের মধ্যে একটা দূরত্ব প্রকট হয়েছে। বিভিন্নভাবেই এ দুই দলের মধ্যে ভেদরেখা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। যখন দেশটির প্রগতিশীল ব্লগাররা চান ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হোক, ঠিক তখনই ইসলামপন্থীরা চান ব্লাসফেমি আইন কার্যকর করতে। যাতে করে কেউ ইসলাম, মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) কিংবা ইসলামের মূল স্তম্ভগুলো নিয়ে কোনো বিরূপ মন্তব্য করতে না পারে।
১৬ কোটি জনসংখ্যার দেশ বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্ষমতা দখলের জন্য বেশ সহিংস হয়ে উঠেছে। এমনিতেই পরিস্থিতি অশান্ত। তার ওপর ধর্ম নিয়ে বিতণ্ডা এ পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলবে বলে অনেকেই আশঙ্কা করছেন।
বাংলাদেশের ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ হলেও ব্রিটিশ শাসনের উত্তরাধিকার হিসেবে পাওয়া যে সাধারণ আইনে বাংলাদেশ সরকার দেশ চালায়, তা ‘ধর্মনিরপেক্ষ’। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবারই বলেছেন যে, তিনি কোনোভাবেই ধর্মীয় উগ্রবাদকে প্রশ্রয় দেবেন না। কিন্তু প্রায় এক দশক ধরে ইসলামী চরমপন্থা দেশটিতে ধীরে ধীরে নিজের অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে।
বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল আবদুর রশীদ বলেন, ‘এসব হামলা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। তারা পরিকল্পনামাফিক এসব কাজ করেছে। এবং বাংলাদেশের ভবিষ্যৎকে নিয়ন্ত্রণ করতে এসব ঘটনা ঘটানো হচ্ছে।’
নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করে দেশের মানুষের মধ্যে বিভক্তি রেখা টানতে ইসলামিক দলগুলো সুবিন্যস্তভাবে এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে বলে মনে করেন আবদুর রশীদ।
এপি বাংলাদেশের গণমাধ্যমের বরাত দিয়ে জানিয়েছে, চরমপন্থী ইসলামী দলগুলো দেশটিতে ধর্ম বা ইসলামের বিরুদ্ধে লেখালেখি করা ব্লগারদের একটি তালিকা তৈরি করেছে। এ তালিকায় অনন্য আজাদের নাম আছে।