উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় ঝিনাইদহের মানুষ
ঝিনাইদহের ছয় থানায় মামলার জট বাড়ছে। বিভিন্ন সময়ে লোমহর্ষক হত্যা, চাঞ্চল্যকর ডাকাতি, চুরি, ছিনতাই, ভাঙচুর মামলার তদন্ত এগোচ্ছে না। এর মধ্যে সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা সামাল দিতে বেগ পেতে হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে।
চলমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ক্রমশ বাড়ছে। পাড়া-মহল্লায় ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে আতঙ্ক।
একের পর এক খুন
চলতি বছরের শুরু থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ঝিনাইদহে একের পর এক খুন হয়েছে। এতে করে ঝিনাইদহ ‘খুনের নগরী’তে পরিণত হয়েছে।
চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি ঝিনাইদহ সদর উপজেলার কালুহাটী গ্রামের বেলেখাল বাজারে খুন হন বর্ষীয়ান হোমিও চিকিৎসক সমির বিশ্বাস ওরফে সমির খাজা। নিজ চেম্বারে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করা হয় তাঁকে। সমির খাজা এলাকায় খ্রিস্টান ধর্মের মতবাদ প্রচার করতেন বলে জানা যায়। তবে তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে এ খবর অস্বীকার করা হয়।
সমির খাজা খুনের রেশ না কাটতেই ১৪ মার্চ কালীগঞ্জ শহরের নিমতলার খামিনী হোমিও হলের মালিক পল্লী চিকিৎসক আবদুর রাজ্জাককে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। তিনি এলাকায় শিয়া মতবাদ প্রচার করতেন বলে তথ্য রয়েছে। পরে এই দুই খুনের দায় স্বীকার করে বিবৃতি দেয় জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস)।
তবে চলতি মাসে পুরোহিত আনন্দ গোপাল গাঙ্গুলী নিহত হওয়ার দিনে ঘটনাস্থল পরিদর্শনের সময় খুলনা রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) এস এম মনিরুজ্জামান এই দাবি অস্বীকার করেন। তিনি এসব হত্যাকাণ্ডের জন্য জামায়াতে ইসলামী-ছাত্রশিবিরসহ জঙ্গি গোষ্ঠীকে সরাসরি দায়ী করেন ।
বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, হোমিও চিকিৎসক আবদুর রাজ্জাক খুনের পর গত ১৮ মার্চ দুপুরের দিকে কালীগঞ্জ উপজেলা শহরের চাপালী গ্রামের ইসলাম আলীর ছেলে যশোর এমএম কলেজের অনার্সের ছাত্র আবুজার গিফারীকে (২২) আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয় দিয়ে তুলে নেওয়া হয়। ২৪ মার্চ বিকেলে একই উপজলোর বাকুলিয়া গ্রামের রুহুল আমিনের ছেলে ঝিনাইদহ সরকারি কলেজের অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্র শামীম হোসনকে (২০) একই কায়দায় তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।
১৩ এপ্রিল যশোরের কোতোয়ালি থানার লাউতলা গ্রামের মাঠের একটি পুকুরপাড় থেকে গিফারী ও শামীমের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করা হয়।
আবু জার গিফারী ছাত্রশিবিরের কালীগঞ্জ পৌর কমিটির সভাপতি ছিলেন এবং শামীম হোসেন কর্মী ছিলেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়।
এ ছাড়া গত ২০ এপ্রিল কালীগঞ্জের ঈশ্বররা গ্রামের মহসিন আলীর ছেলে স্থানীয় শহীদ নূর আলী কলেজের মানবিক বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র সোহানুর রহমান (১৬)-এর লাশ পাওয়া যায় পাশের জেলা চুয়াডাঙ্গার গুলটের মাঠে।
এর আগে ১৭ এপ্রিল স্থানীয় প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে সোহানের বাবা মো. মহসিন আলী বলেন, ১০ এপ্রিল বিকেল ৫টার দিকে চারজন লোক তাঁর ছেলেকে ইজিবাইকে করে তুলে নিয়ে যায়।
কালীগঞ্জ থানার ওসি আনোয়ার হোসেনের কাছে এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে পরিবারের এ দাবি অস্বীকার করেন তিনি।
এর আগে খ্রিস্টান ধর্মের প্রচারক হোমিও চিকিৎসক সমীর বিশ্বাস ওরফে সমীর খাজা নিহত হওয়ার ঘটনায় ঢাকার গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) দুজন তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) বিষেশজ্ঞ ঝিনাইদহে যান। তাঁরা তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে কঠোর গোপনীয়তার মধ্য দিয়ে হত্যাকারী দলটিকে ধরার জন্য নানা চেষ্টা করেন।
ঝিনাইদহ সদর থানার ওসি হাসান হাফিজুর রহমানের দেওয়া তথ্যমতে, সমীর খাজা নিহত হওয়ার চারদিন পর গত ১১ জানুয়ারি রোববার গভীর রাতে এ খুনের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁরা হলেন ঝিনাইদহ সদর উপজেলার নারায়ণপুর গ্রামের নুর ইসলামের ছেলে মো. মিলন হোসেন (২৭) ও একই উপজেলার রামনগর গ্রামের তাইজেলের ছেলে শফিকুল ইসলাম কাজল (২২)। তাঁদের দুদিনের রিমান্ড নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়।
জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) মো. আলতাফ হোসেন গত রোববার ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসকের সম্মেলনকক্ষে অনুষ্ঠিত আইনশৃঙ্খলা কমিটির নিয়মিত মাসিক সভায় জানান, সমীর খাজার খুনের ঘটনায় এ পর্যন্ত ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। দুজন আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
গত ৪ মার্চ জেলার হরিণাকুণ্ডু উপজেলার হিঙ্গেরপাড়া-মুর্তজাপুর গ্রামের মাঠ থেকে কালো কাপড়ে চোখ ও হাত-পা বাঁধা অবস্থায় ঝিনাইদহ কামিল মাদ্রাসার ছাত্র ও সদর উপজেলার কালুহাটি গ্রামের খলিল মণ্ডলের ছেলে হাফেজ জসিম উদ্দিনের (২৩) লাশ পাওয়া যায়।
এ বিষয়ে ঝিনাইদহ সদর থানার ওসি হাসান হাফিজুর রহমান জানান, নিহত এই ব্যক্তি সমীর খাজা হত্যাকাণ্ডের প্রধান সন্দেহভাজন ছিলেন।
১৯ মার্চ আরো একজন মাদ্রাসাশিক্ষকের লাশ পাওয়া যায়। তিনি সদর উপজেলার কালুহাটি গ্রামের জামায়াত নেতা আবু হুরায়রা। তিনিও এই খুনের সন্দেহভাজন ছিলেন।
নিহত এ দুজনের পরিবারের দাবি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরিচয় দিয়ে তাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয় এবং পরে লাশ পাওয়া যায় তাদের। তবে আগে থেকেই পুলিশের পক্ষ থেকে পরিবারের এ ধরনের দাবি অস্বীকার করা হয়েছে।
সর্বশেষ গত ৭ জুন খুন হন ঝিনাইদহ সদর উপজেলার করাতিপাড়ার হিন্দু পুরোহিত আনন্দ গোপাল গাঙ্গুলী (৭০)। এ খুনের পরে দেশ-বিদেশের গণমাধ্যমে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। সরকারের মন্ত্রীরা একে একে ছুটে যান ঝিনাইদহে।
সর্বশেষ হত্যাকাণ্ডের পরের পরিস্থিতি
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সদর পৌরসভার মেয়র সাইদুল করিম মিন্টু জানান, আজ মঙ্গলবার দুপুর ১২টার দিকে ১৪ দলের সমন্বয়ক মোহাম্মদ নাসিম, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুসহ গুরুত্বপূর্ণ নেতারা ঝিনাইদহে আসছেন। বেলা পৌনে ১২টার দিকে ঝিনাইদহ বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান স্টেডিয়ামে হেলিকপ্টারে নামবেন তাঁরা। সেখান থেকে যাবেন নিহত পুরোহিত আনন্দ গোপাল গাঙ্গুলীর বাড়িতে। এরপর দুপুরে ১৪ দল আয়োজিত স্থানীয় করাতিপাড়া প্রাইমারি স্কুল মাঠে এক সমাবেশে চলমান পরিস্থিতি নিয়ে নেতারা গুরত্বপূর্ণ বক্তব্য দেবেন।
এর আগে গত ১১ জুন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নির্দেশে দলটির কেন্দ্রীয় আইনবিষয়ক সহসম্পাদক নিতাই রায় ও জয়ন্ত কুমার কুণ্ডুর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল নিহত পুরোহিত আনন্দ গোপালের বাড়িতে যান। এ ছাড়া হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ ও বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের কেন্দ্রীয় নেতারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।
ঘটনার পরের দিন অর্থাৎ ৮ জুন ভারতীয় দূতাবাসের দুই কর্মকর্তা ফার্স্ট সেক্রেটারি (পলিটিক্যাল অ্যান্ড ইনফরমেশন) রমাকান্ত গুপ্ত ও ফার্স্ট সেক্রেটারি (ভিসা) রাজেশ উসিয়া ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। একই দিন তাঁরা পুলিশ সুপারের দপ্তরে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময়ও করেন।
এ ছাড়া গত ১২ জুন, রোববার বেলা ১২টার দিকে জেলা প্রশাসকের সম্মেলনকক্ষে অনুষ্ঠিত জেলা আইনশৃঙ্খলা উন্নয়ন কমিটির সভায় ঝিনাইদহের পুলিশ সুপার মো. আলতাফ হোসেন বলেছেন, পুরোহিত আনন্দ গোপাল হত্যার সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নত করা হয়েছে। নির্মম এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতরা বিদেশে পালিয়েও রক্ষা পাবে না। যারা এ হত্যার ঘটনায় জড়িত তাদের আত্মীয়স্বজনদের অর্থ, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, সম্পদের তালিকা করা হয়েছে। কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে তাদের বিরুদ্ধে।
এ সভায় পুলিশ সুপার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে বলেছেন, যেকোনো মূল্যে ঘাতকদের গ্রেপ্তার করা হবে।
জেলা প্রশাসক মো. মাহবুব আলম তালুকদারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ সভায় অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য দেন জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি তৈয়ব আলী জোয়ারদার, আবদুর রশীদ, পিপি ইসমাইল হোসেন, জেলা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি নারায়ণ চন্দ্র, সদর থানা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি প্রফুল্ল কুমার সরকার প্রমুখ।
এ সময় জেলা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি জেলার কালীগঞ্জ মন্দিরে হামলার আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, জেলা শহরের কাঁঠালবাগানে মধু ঠাকুরের বাড়িতে পরপর দুদিন ইটপাটকেল ছোড়া হয়েছে। সদর উপজেলার নবদোহা মন্দিরের পুরোহিতকে হুমকি দেওয়া হয়েছে।
এ সভায় নিহত পুরোহিত আনন্দ গোপালের স্মরণে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
পুলিশের ভাষ্য
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের একটি সূত্র জানায়, এ জেলার মহেশপুর ও কোটচাঁদপুরের এক ডজন জঙ্গির নামসহ তালিকা রয়েছে তাঁদের হাতে। এই জঙ্গিরা ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গুপ্তহত্যা, খুনসহ নাশকতার সঙ্গে জড়িত বলে প্রমাণ পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। শনাক্ত করা ওই জঙ্গিদের ধরতে অভিযান চলমান রয়েছে।