গম সংগ্রহ অভিযান, কোটি কোটি টাকা ভাগাভাগির অভিযোগ!

Looks like you've blocked notifications!
গম সংগ্রহ অভিযানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের লোকজন জড়িত বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ছবি : এনটিভি

পঞ্চগড় জেলায় সরকারিভাবে গম সংগ্রহে ‘সর্বদলীয় ঐকমত্যের’ ভিত্তিতে সাত কোটি টাকা ভাগাভাগির অভিযোগ উঠেছে। সরকারি খাদ্যগুদামে সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে গম সংগ্রহ করার কথা থাকলেও গম দিয়েছে একটি সিন্ডিকেট।

জেলার পাঁচটি উপজেলার মধ্যে আটোয়ারী, তেঁতুলিয়া ও পঞ্চগড় সদর উপজেলার কৃষকদের ন্যায্যমূল্য দিতে সরকারের পরিকল্পনা থাকলেও এই চক্রের কারণে তা ভেস্তে গেছে।

খাদ্য সংগ্রহ কমিটি ও খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তা, বিভিন্ন স্তরের জনপ্রতিনিধি, আওয়ামী লীগ, জাসদ, বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা ও ব্যবসায়ীরা এ চক্রে রয়েছে বলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে। যৌথভাবে তারা গম সংগ্রহ অভিযান শেষ করেছেন। এবার গম সংগ্রহ অভিযানে কৃষকের খাতায় নাম লিখিয়েছে উপজেলা প্রশাসনও। অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে গম সংগ্রহ অভিযানে ওই চক্রটি হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা।

জেলা খাদ্য বিভাগ সূত্র জানায়, চলতি মৌসুমে পঞ্চগড় জেলায় গম সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ১১ হাজার ৯৬৮ টন। এর মধ্যে তেঁতুলিয়া উপজেলায় তিন হাজার ২৮৩ টন, পঞ্চগড় সদর উপজেলায় দুই হাজার ৯২৩ টন, আটোয়ারী উপজেলায় দুই হাজার ৩৩৫ টন, বোদা উপজেলায় এক হাজার ৭৮৯ টন এবং দেবীগঞ্জ উপজেলায় এক হাজার ২৭৫ টন। পঞ্চগড় জেলায় গত ১ এপ্রিল থেকে ৭ জুন পর্যন্ত গম সংগ্রহ অভিযান পরিচালিত হয়।

সংগ্রহ অভিযান শুরুর আগেই অধিকাংশ ক্ষুদ্র কৃষক তাদের উৎপাদিত গম বিক্রি করে দেন। বিশেষ কারণে স্থানীয় খাদ্যগুদাম মে মাসের শেষের দিকে গম সংগ্রহ শুরু করায় প্রকৃত কৃষকদের পরিবর্তে খাদ্যগুদামে গম সরবরাহ করেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আটোয়ারী উপজেলার দুটি খাদ্যগুদামে দুই হাজার ৩৩৫ মেট্রিক টন গমের বিপরীতে এই সিন্ডিকেট চক্র হাতিয়ে নিয়েছেন প্রায় দেড় কোটি টাকা।

তেঁতুলিয়া উপজেলার দুটি খাদ্যগুদামে তিন হাজার ২৮৩ মেট্রিক টন গমের বিপরীতে স্থানীয় সিন্ডিকেট চক্র হাতিয়ে নিয়েছেন প্রায় দুই কোটি টাকা, পঞ্চগড় সদর উপজেলার দুই হাজার ৯২৩ টন গমের বিপরীতে স্থানীয় সিন্ডিকেট চক্রটি হাতিয়ে নিয়েছে প্রায় পৌনে দুই কোটি টাকা।

বোদা ও দেবীগঞ্জ উপজেলায় স্থানীয় সাংসদ অ্যাডভোকেট নুরুল ইসলাম সুজন সরাসরি কৃষকদের হাতে কার্ড সরবরাহ করায় এই দুই উপজেলায় রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা ও ব্যবসায়ীদের কোনো সিন্ডিকেট হয়নি। এই দুই উপজেলার খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তারা কাজের সম্মানী হিসেবে বস্তাপ্রতি ৫০ থেকে ১০০ টাকা করে হাতিয়েছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি সূত্র জানায়, বাজারে প্রতি কেজি গম বিক্রি হয়েছে ২০ থেকে ২২ টাকা। আর সরকারিভাবে কৃষকদের প্রতি কেজি গম কেনা হয়েছে ২৮ টাকা। বাজার থেকে সরকারি ক্রয়কেন্দ্রের প্রতি কেজির মূল্য বেশি ছয় টাকা। বাজার মূল্যের চেয়ে সরকারিভাবে ক্রয়কৃত প্রতি কেজি গমের দাম ছয় টাকা বেশি হলে প্রতি টনে লাভ ছয় হাজার টাকা। এ হিসেবে জেলায় গম সংগ্রহ করা হয়েছে ১১ হাজার ৯৬৮ টন। এতে ওই সিন্ডিকেট ও ব্যবসায়ীরা প্রায় সাত কোটি ১৯ লাখ টাকা পকেটস্থ করেছেন।

আটোয়ারী, তেঁতুলিয়া ও সদর উপজেলার বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের প্রতিনিধি, মুক্তিযোদ্ধা, জনপ্রতিনিধি ও কৃষকদের অভিযোগ, স্থানীয় সংসদ নাজমুল হক প্রধান, আটোয়ারী উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা ও গম সংগ্রহ কমিটির আহ্বায়ক আবু রাফা মো. আরিফ, তেঁতুলিয়া উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা ও গম সংগ্রহ কমিটির আহ্বায়ক শেখ মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন ও সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা ও গম সংগ্রহ কমিটির আহ্বায়ক লায়লা মুনতাজেরী দীনা, আওয়ামী লীগ, জাসদ, বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের নেতা ও গম ব্যবসায়ীরা সরাসরি এই চক্রের সঙ্গে জড়িত।

ওই সূত্রটি আরো জানান, ওই চক্র কৃষকদের ৫০০ থেকে এক হাজার টাকা দেন। বিনিময়ে কৃষকদের চেকে সই করিয়ে নেন এবং জাতীয় পরিচয়পত্র সংগ্রহ করেন। পরে তাঁদের নামে বরাদ্দ দেখিয়ে খাদ্য বিভাগ এবং গুদাম কর্মকর্তাদের যোগসাজশে গম সংগ্রহ সম্পন্ন করেন।

আটোয়ারী উপজেলার মির্জাপুর ইউনিয়নের নলপুখরী গ্রামের কৃষক সহিমদ্দিন আহাম্মেদ, তোড়িয়া ইউনিয়নের মকবুল হোসেন, রমজান আলী, আবদুল খালেক (৫৫), বলরামপুর ইউনিয়নের ইদ্রিস আলীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা গম উৎপাদন করে বাজারে বিক্রি করেছেন। কিন্তু সরকারি-বেসরকারি কোনো তালিকাতেই তাঁদের নাম নেই। কারো কাছ থেকে কোনো কার্ডও পাননি। পাঁচ বিঘা জমিতে গম করেও কোনো কার্ড পাননি।

কৃষককের নামের বরাদ্দ করা গম ভাগাভাগি করেছে ওই চক্র বলে অভিযোগ করেছেন আটোয়ারী উপজেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি আবু তাহের।

তেঁতুলিয়া উপজেলার তীরনইহাট ইউনিয়নের ডেমগছ এলাকার কৃষক রিয়াজুল মোল্লা ও একই ইউনিয়নের সরকারপাড়া গ্রামের কৃষক নজরুল ইসলাম ও তেঁতুলিয়া ইউনিয়নের সরদারপাড়া এলাকার কৃষক মো. শাহজাহান, মো. শামুল ও মো. আনিছ বড় কৃষক। তাঁরা ৫০ থেকে ২০০ মণ গম উৎপাদন করেন। তাঁরা কেউই গমের কার্ড পাননি।

আটোয়ারী উপজেলার মির্জাপুর ইউনিয়নের সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা মির্জা নুরুল ইসলাম হেলাল গম উৎপাদন করে তিনি বিভিন্ন দপ্তরে ঘুরেও একটি কার্ড পাননি।  তিনি জানান, সরকারি খাদ্যগুদামে গম সরবরাহে কৃষকদের নামে স্থানীয় সাংসদ নাজমুল হক প্রধান, উপজেলা চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যানসহ গম ব্যবসায়ীরা গম সরবরাহ করেছেন। 

বস্তাপ্রতি টাকা নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে বোদা উপজেলা খাদ্যগুদাম কর্মকর্তা মো. মজলু হোসেন বলেন, ‘কৃষকরা গম দিয়েছে আমরা তাদের হিসাব নম্বরে টাকার চেক জমা দিয়েছি। টাকা নেওয়ার প্রশ্নই আসে না।’

তেঁতুলিয়া খাদ্যগুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আমজাদ হোসেন ও মির্জাপুর খাদ্যগুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সাজেদুর রহমান রুবেল বলেন, ‘স্থানীয় চক্র নাকি দলীয় নেতা-এমপি-মন্ত্রী জড়িত তা আমরা বলতে পারব না। নিজ নিজ উপজেলা সংগ্রহ কমিটির তালিকা অনুযায়ী কৃষকদের গম সংগ্রহ করা হয়েছে।’

আটোয়ারী উপজেলা গম সংগ্রহ কমিটির প্রধান ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার আবু রাফা মো. আরিফ জানান, খাদ্য সংগ্রহ কমিটি অনুমোদিত তালিকা অনুযায়ী খাদ্যগুদাম কর্মকর্তারা কৃষকদের কাছ থেকে গম সংগ্রহ করছেন। তাঁদের ব্যাংক হিসাবে টাকা পরিশোধ করা হচ্ছে। এখানে অনিয়মের কোনো সুযোগ নেই।

জেলা গম সংগ্রহ কমিটির উপদেষ্টা ও পঞ্চগড়-১ আসনের সাংসদ নাজমুল হক প্রধান জানান, গম যারা দিয়েছে টাকা তারাই পেয়েছে। গম দেবে একজন টাকা নেবে আরেকজন এটা কী কখনো হয়। সিন্ডিকেটের বিষয়ে তাঁর জানা নেই।

কৃষকদের ব্যাংক হিসাব খোলার ক্ষেত্রেও ব্যাংক কর্তৃপক্ষ হাতিয়ে নিয়েছে অতিরিক্ত টাকা।