দি ইকোনমিস্টের বিশ্লেষণ

বাংলাদেশের রাজনীতি কেন বিধ্বস্ত

Looks like you've blocked notifications!

রাজনৈতিক অস্থিরতা ও লাগাতার অবরোধ-হরতালের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বের প্রভাবশালী সব গণমাধ্যমে গুরুত্বের সঙ্গে স্থান পাচ্ছে বাংলাদেশ পরিস্থিতি। সোমবার যুক্তরাজ্যভিত্তিক সাময়িকী ‘দি ইকোনমিস্ট’ বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে এক বিশ্লেষণ হাজির করেছে। এর হুবহু অনুবাদ দেওয়া হলো : 

প্রায় ১৬ কোটি মানুষের বাংলাদেশ এক মাস ধরে পঙ্গু হয়ে আছে। বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়া রাজধানী ঢাকার একটি দলীয় কার্যালয়ে অবরুদ্ধ হয়ে আছেন। তাঁর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) দেশজুড়ে সড়ক, রেল ও জলপথ অবরোধ করছে। গত বছর ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনের বর্ষপূর্তিতে প্রতিবাদ করার অনুমতি না পেয়েই অসন্তোষের শুরু। বিরোধীদের বয়কট করার সুবাদে ওই নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ পুনরায় নির্বাচিত হয়। এর মধ্যেই প্রায় ৫০ জন নিহত হয়েছেন এবং বিরোধীদের ১০ হাজারের বেশি নেতা-কর্মী গ্রেপ্তার হয়েছেন। বিএনপির বেশিরভাগ নেতা এখন কারাগারে, নির্বাসিত অথবা আত্মগোপনে। এসব নেতার নামে মামলা চলছে যা আগামী নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ক্ষেত্রে বাধা হতে পারে। এ সপ্তাহের ঘটনাপ্রবাহ এক চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। সরকার খালেদা জিয়ার কার্যালয়ের বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট সংযোগ সাময়িকভাবে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এ কারণে চলমান অবরোধের পাশপাশি ফেব্রুয়ারির প্রথম দিন থেকে আরো তিন দিনের  হরতালের ডাক দেন তিনি। কেন রাজনৈতিক অধঃপতন এই বিশৃঙ্খলায় এসেছে? 

বাংলাদেশ ভুগছে অকার্যকর দ্বিদলীয় ব্যবস্থায়, যেখানে দুই দলের প্রধান, ‘কলহরত বেগমদের’  ব্যক্তিগত শত্রুতার মূল্য দিতে হচ্ছে দেশকে। ১৯৯১ সাল থেকে একজনের পর আরেকজন ক্ষমতায় বসেছেন। দুই দলই জানে যে অপর দল ভোটে কারচুপি করবে, তাই অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়। তবে অপর দলটি ভোট কারচুপি করবে। ২০০৬ সালে বেগম জিয়ার দলও এ ব্যবস্থা নষ্ট করার চেষ্টা করে। সেনাবাহিনী নেমে এসে ‘অনির্বাচিত’ একটি সরকারকে সমর্থন দেয়, যারা দুই বছর ক্ষমতাসীন ছিল। এ সরকারে অধীনে এক নির্বাচনে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। আওয়ামী লীগ এ নিরঙ্কুশ জয়কে ক্ষমতা আরো শক্ত করার ব্যাপারে কাজে লাগায়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল, দলের নেতাদের হয়রানি করা ও প্রকাশ্যে ইসলামকে ভিত্তি করায় জোটের অন্যতম শরিক জামায়াতে ইসলামীকে ‘নিষিদ্ধ’(প্রকৃতপক্ষে নিষিদ্ধ নয়) করার মাধ্যমে বিএনপিকে কখনো নির্বাচনে জয়ী না হতে দেওয়ার পদক্ষেপ নেয় তারা। এখন সরকার দাবি করছে, তারা বিএনপির ভাঙচুর ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে লড়ছে। বিরোধীদের অভিযোগ, দেশকে একদলীয় রাষ্ট্রে পরিণত করা হচ্ছে। উভয় পক্ষেই যুক্তি আছে। 

দুই নেত্রীর মধ্যে ব্যক্তিগত বিরোধের কারণেই জয়ীরাই সব পাবে- এমন এক রাজনৈতিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, যেখানে ভোট কারচুপির অভিযোগ আনা বিরোধীদের স্থান হয় রাজপথে। উভয় দলেরই দেশজুড়ে প্রভাব আছে। অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তাদের প্রতিপক্ষ করতে ‘তৃতীয় শক্তির’ উত্থানের প্রচেষ্টা হলেও তা বিফলে যায়। বাংলাদেশের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনে হস্তক্ষেপ করতে সম্ভবত অনিচ্ছুক ও অসমর্থ। এত কিছুর পরও দেশটির উন্নয়নে সফলতা পরিষ্কার অব্যাহত আছে। চীনকে বাংলাদেশে বড় ভূমিকা রাখতে দেওয়ার ইচ্ছা এবং ইসলামিক জঙ্গিগোষ্ঠীর প্রতি নমনীয়তা, এ দুয়ের কারণে ভারত ও পশ্চিমা বিশ্ব খালেদা জিয়াকে অবিশ্বাস করে। তাঁর আমলে বাংলাদেশে বড় কোনো সন্ত্রাসী হামলা হয়নি এবং অন্য কেনো স্থানের কোনো হামলার সঙ্গে দেশের বড় সংযুক্তি নেই- এই বিষয়গুলো জানাতে পছন্দ করেন শেখ হাসিনা। 

যাহোক, বিএনপির অবরোধের শিকার মানুষ দিয়ে হাসপাতালগুলোর বার্ন ইউনিট ভরে উঠতে থাকায়, দমনের পরিস্থিতিও আরো খারাপের দিকে যেতে থাকায়, সেনাবাহিনী হস্তক্ষেপ করার চাপ বোধ মনে করতে পারে। সুনামের কারণে (এবং জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী হিসেবে লোভনীয় দায়িত্ব পালন) সরাসরি অভ্যুত্থানের বিষয়ে তারা সতর্ক থাকবে। কিন্তু বর্তমান অস্থিতিশীলতাকে রাজনৈতিক সংকট হিসেবে বিবেচনা করার ব্যাপারে সরকারকে বুঝিয়ে নতুন নির্বাচন দেওয়া অসম্ভব বলেই মনে হচ্ছে। তাই জেনারেলদের মনে হতে পারে, কোনো পক্ষই জয়ী হবে না- এমন রাজনৈতিক বিবাদে ‘সময় শেষ’ বলা ছাড়া তাদের অন্য কোনো পথ নেই,  যেমনটি তারা করেছিল আট বছর আগে।