‘ইংল্যান্ডেই তো ধরতে পারে, নোটিশ কেন’
বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে গ্রেপ্তার করতে তাঁর নামে ‘রেড নোটিশ’ জারি করেছে ইন্টারপোল। আজ মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থাটির ওয়েবসাইটে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে নোটিশ জারি করা ‘পলাতক’ ব্যক্তিদের তালিকার একেবারে শেষে তাঁর নাম দেখতে পাওয়া যায়। সেখানে তাঁর শারীরিক গঠন, চোখ, চুলের রং, কয়টি ভাষা জানেন সেসব তথ্যও দেওয়া হয়েছে।
লন্ডনে অবস্থানরত তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে আনতে বেশ আগে থেকেই চেষ্টা করছে সরকার। এ বছরের শুরুতেও এক দফা উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। ওই সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে একটি চিঠি দেন। এতে তারেকের বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা থাকার কথা উল্লেখ করা হয়। বলা হয়, লন্ডনে অবস্থান করেও বিভিন্ন ধরনের উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে ও নির্দেশনা দিয়ে তিনি বাংলাদেশের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করে তুলছেন।
এই চিঠি পাঠানোর প্রায় তিন মাস পর তারেক রহমানকে গ্রেপ্তারে রেড নোটিশ জারি করল ইন্টারপোল। সংস্থাটির বাংলাদেশ শাখা ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরোর (এনসিবি) প্রধান পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মাহবুবুর রহমান ভূঁইয়া এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আমরা তিন-চার মাস আগেই ইন্টারপোলে রিকোয়েস্ট (অনুরোধ) পাঠিয়েছিলাম।’
তারেক রহমানের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি হওয়ার বিষয়ে প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘খবরটা আমি বিভিন্ন টেলিভিশনের স্ক্রলে দেখেছি। বিষয়টা আমার কাছে অ্যাবসার্ড (অযৌক্তিক) মনে হচ্ছে। সে তো ইংল্যান্ডেই আছে। ধরতে চাইলে সেখান থেকেই তাকে ধরতে পারে। তাকে ধরতে ইন্টারপোলকে কেন নোটিশ দিতে হবে? আমার কাছে পুরো বিষয়টাই ফলস বলে মনে হচ্ছে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। তাই এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে পারব না।’
ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল পুলিশ অর্গানাইজেশন বা ইন্টারপোল একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা, যার প্রধান কাজ আন্তর্জাতিক পুলিশকে সহায়তা করা। সংস্থাটিতে ১৮৮টি দেশের পুলিশ নিজেদের মধ্যে গুরুতর অপরাধ-সংক্রান্ত তথ্য আদান-প্রদান করে। এ-সংক্রান্ত বিভিন্ন নোটিশ ইন্টারপোলের সাধারণ সচিবালয়ের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। সংস্থাটি আট রকমের নোটিশ জারি করে, রেড (লাল), ইয়োলো (হলুদ), ব্লু (নীল), ব্ল্যাক (কালো), গ্রিন (সবুজ), অরেঞ্জ (কমলা), ইন্টারপোল-জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ বিশেষ নোটিশ ও পারপল (হালকা বেগুনি)।
ইন্টারপোলের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, রেড নোটিশের মাধ্যমে ওয়ান্টেড ব্যক্তিদের অবস্থান জানা এবং গ্রেপ্তারের চেষ্টা করা হয়। আর এর লক্ষ্য থাকে ওই ব্যক্তিরা যে দেশে দোষী সাব্যস্ত, সেই দেশে প্রত্যর্পণ বা এ ধরনের আইনি ব্যবস্থা নেওয়া।
তবে সংস্থাটির গঠনতন্ত্রের ৩ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘কোনো রাজনৈতিক, সামরিক, ধর্মীয় অথবা জাতিগত ব্যক্তিত্বের (ক্যারেকটার) ক্ষেত্রে এ সংস্থার কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ বা কার্যক্রম চালানো কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।’
সে ক্ষেত্রে তারেক রহমানের মতো রাজনৈতিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে রেড নোটিশ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
এ প্রসঙ্গে তারেক রহমানের আইনজীবী অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘অনেক সময় সরকার জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য এ রকম করে থাকে। তবে পুরো বিষয় নিয়ে জেনেশুনে আগামীকাল বিস্তারিত মতামত জানাতে পারব।’
ইন্টারপোলের গঠনতন্ত্রের তিন নম্বর অনুচ্ছেদের বিষয়ে জানতে চাইলে এনসিবির প্রধান মাহবুবুর রহমান ভূঁইয়া বলেন, ‘ইন্টারপোল যাচাই-বাছাই করে, সবকিছু ক্লিয়ার (স্পষ্ট) পেয়ে, তারপরই নোটিশ জারি করে। এটা তাদের এখতিয়ার। তাদের নিজস্ব লিগ্যাল অ্যাডভাইজার বডি (আইনি পরামর্শ শাখা) আছে, তারা যাচাই বাছাই করেই কারো বিরুদ্ধে নোটিশ জারি করে। এটা শুধু তারেক রহমানের ক্ষেত্রে নয়, সবার ক্ষেত্রেই এটা করা হয়।’
ইন্টারপোল বেশকিছু দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় প্রত্যর্পণ (এক্সট্র্যাডিশন) চুক্তির মাধ্যমে আসামি গ্রেপ্তারের জন্য আনুষ্ঠানিক মাধ্যম (চ্যানেল) হিসেবে স্বীকৃত। দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় প্রত্যর্পণ চুক্তিগুলোর মধ্যে রয়েছে ইউরোপিয়ান কনভেনশন অন এক্সট্র্যাডিশন, দ্য কমিউনিটি অব ওয়েস্ট আফ্রিকান স্টেটস কনভেনশন অন এক্সট্র্যাডিশন এবং ইউনাইটেড ন্যাশনস মডেল ট্রিটি অন এক্সট্র্যাডিশন।
অনেকে মনে করছেন, সরকার দীর্ঘদিন ধরে তারেক রহমানকে লন্ডন থেকে দেশে ফেরানোর চেষ্টা করে পারেনি। এখন ইন্টারপোলের মাধ্যমে এসব চুক্তির অধীনে ফেরানোর চেষ্টা করছে।
বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান ও দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ২১ আগস্ট গেনেড হামলা, মানি লন্ডারিং, রাষ্ট্রদ্রোহসহ বিভিন্ন অভিযোগে অন্তত ১৫টি মামলা রয়েছে। তবে ইন্টারপোলের নোটিশে শুধু আওয়ামী লীগের জনসভায় হ্যান্ড গ্রেনেড বিস্ফোরণ ও হত্যা মামলার অভিযোগের কথা বলা হয়েছে।
২০০৮ সালে চিকিৎসা নিতে বাংলাদেশ ছাড়েন তারেক রহমান। এর পর থেকে তিনি যুক্তরাজ্যে বসবাস করছেন। সেখানে ভিসার মেয়াদ শেষ হলেও রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে পরিবারসহ সেখানেই রয়েছেন তিনি। তবে বিভিন্ন সময়ে যুক্তরাজ্য বিএনপির নানা অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিয়ে সমালোচিতও হয়েছেন কয়েকবার।
এসবের পরিপ্রেক্ষিতে যতদিন তারেক রহমান আইনের দৃষ্টিতে ‘পলাতক’ হিসেবে থাকবেন ততদিন তাঁর বক্তব্য, বিবৃতি প্রচারে সংবাদমাধ্যমসহ যে কোনো প্রচারমাধ্যমের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেন হাইকোর্ট। গত ৭ জানুয়ারি এক রিট আবেদনের শুনানি শেষে বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি আবু তাহের মো. সাইফুর রহমানের বেঞ্চ এই আদেশ দেন।