৫০ কোটি টাকা আমানত নিয়ে উধাও!

Looks like you've blocked notifications!
আমানতের টাকা না পেয়ে আপ্রকাশি মাল্টিপারপাসের প্রধান কার্যালয় থেকে কাঁদতে কাঁদতে বের হচ্ছেন এক ব্যক্তি। ছবি : এনটিভি

নওগাঁ, বগুড়ার সান্তাহারসহ আশপাশের বিভিন্ন উপজেলার সাধারণ মানুষের আমানতের প্রায় ৫০ কোটি টাকা ফেরত না দিয়ে আমরা প্রত্যেকে কাজ শিখি (আপ্রকাশি) মাল্টিপারপাসের নির্বাহী পরিচালক এস এম জুয়েল উধাও হয়ে গেছেন।

এদিকে আমানতের টাকা ফেরত না পেয়ে শত শত গ্রাহক সান্তাহারে অবস্থিত আপ্রকাশি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ কার্যালয় বন্ধ করে দিয়েছেন। একই সময় নির্বাহী পরিচালক এস এম জুয়েলের বাবা ওসমান গনির মালিকানাধীন হোটেল স্টারেও তালা ঝুলিয়ে দিয়েছেন তাঁরা।

ঘটনার পর চারদিন অতিবাহিত হলেও গ্রাহকদের টাকা ফেরত দেওয়ার কোনো সিদ্ধান্ত না হওয়ায় প্রতিদিন সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত সান্তাহারে বাড়ছে নারী-পুরুষ আমানতকারীদের ভিড়। তালাবদ্ধ করে রাখা স্টার হোটেল, স্টার আবাসিক ও আপ্রকাশি মাল্টিপারপাসের তালার ওপর তালা মারছেন আমানতকারীরা। সর্বশেষ পুলিশ প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতাদের হস্তক্ষেপে আজ শনিবার সকাল থেকে হোটেল স্টার, স্টার আবাসিক ও আপ্রকাশির প্রধান কার্যালয় খোলা হয়েছে। আর খোলার পর থেকে শত শত নারী-পুরুষ তাদের আমানতের টাকা ফেরত নেওয়ার জন্য ভিড় করছেন ওই প্রতিষ্ঠানে।  

গত বুধবার দুপুরের দিকে সান্তাহার শহরের স্টেশন রোডে স্টার হোটেল, মুক্তিযোদ্ধা মার্কেটের আপ্রকাশি মাল্টিপারপাসের প্রধান কার্যালয়ে হামলা ও লুটপাটের ঘটনা ঘটলেও গত চারদিনে এ ব্যাপারে থানায় কোনো অভিযোগ দায়ের করেনি আপ্রকাশি বা হোটেল স্টারের কর্তৃপক্ষ। আদমদীঘি থানায় গত চারদিনে টাকা উদ্ধার করে দেওয়ার জন্য পুলিশের কাছে লিখিত ও মৌখিক আবেদন জানিয়েছেন অর্ধশতাধিক নারী-পুরুষ।

বৃহস্পতিবার দুপুরে আদমদীঘি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শওকত কবির বলেন, পুলিশের পক্ষ থেকে আপ্রকাশি মাল্পিপারপাস ও স্টার হোটেলের মালিকপক্ষকে অতিসত্বর বিকল্প ব্যবস্থায় সাধারণ মানুষের আমানতের টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য চাপে রাখা হয়েছে।

আমানতকারী ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়, ২০০৩ সালে বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার সান্তাহার শহরে এস এম জুয়েল আপ্রকাশি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ নামের একটি ঋণদান কার্যালয় খোলেন। এই সংস্থা ঋণদান কর্মসূচি ও গ্রাহকের কাছে থেকে আমানত গ্রহণের কার্যক্রম শুরু করে। প্রতি লাখ টাকা জমা রাখার বিনিময়ে মাসে গ্রাহকদের দুই হাজার টাকা করে মুনাফা দেয় সংস্থাটি। এতে এলাকার মানুষ বেশি মুনাফার আশায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে। কয়েক বছরে গ্রাহকের সংখ্যা গিয়ে প্রায় আড়াই হাজারে দাঁড়ায়। এই সময়ে গ্রাহকের আমানতের টাকার পরিমাণ প্রায় ৫০ কোটিতে গিয়ে ঠেকে।

চলতি বছরের জানুয়ারি মাস থেকে হঠাৎ করে সংস্থাটি মুনাফার টাকা দেওয়া বন্ধ করে দেয়। গত কয়েক বছরে আমানতকারীদের কাছে থেকে উচ্চ মুনাফা দেওয়ার নামে হাতিয়ে নেওয়া কোটি কোটি টাকা দিয়ে আখের গোছান এস এম জুয়েল। নওগাঁ সদর উপজেলার বোয়ালিয়া গ্রামে ১৩০ শতক জমির ওপর গড়ে তোলেন আপ্রকাশি খামারবাড়ি, ছাতিয়ানগ্রামে গড়ে তোলেন বাগানবাড়ি। নওগাঁ সদর, মহাদেবপুর ও পত্নীতলায় গোপনে ব্যক্তিগত ও পরিবারের নামে শত শত বিঘা জমি কেনেন। পরিবারের সদস্যদের নামে বিভিন্ন ব্যাংকে গচ্ছিত রাখে কোটি কোটি টাকা।

এদিকে, চলতি বছরের জানুয়ারি মাস থেকে হঠাৎ করে সংস্থাটি মুনাফার টাকা দেওয়া বন্ধ করে দেওয়ায় মুনাফার টাকাসহ মূল টাকা ফেরত চেয়ে কয়েক মাস ধরে গ্রাহকরা আপ্রকাশি কার্যালয়ে ধরনা দিতে থাকেন। কিন্তু এস এম জুয়েল কোনো টাকা না দিয়ে গ্রাহকদের হয়রানি শুরু করে। একপর্যায়ে তিনি ২০ জুলাই থেকে গ্রাহকের টাকা ফেরত দেওয়ার কথা বলে কার্যালয়ে নোটিশ টাঙিয়ে দেন। কিন্তু ২০ জুলাই কোনো টাকা ফেরত না দিলে কয়েকশ গ্রাহক সান্তাহার শহরের মুক্তিযোদ্ধা মার্কেটে অবস্থিত সংস্থার মূল কার্যালয়ে হামলা চালান। এ সময় ওই কার্যালয় থেকে টিভি ও সোফাসেট ও ফ্যান লুটপাট করেন ক্ষুব্ধ গ্রাহকরা। একপর্যায়ে বিক্ষুব্ধ গ্রাহকরা একই এলাকায় অবস্থিত শহরের নাম করা হোটেল স্টারে তালা ঝুলিয়ে দিয়ে বিক্ষোভ করতে থাকেন। পরে পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে।

সেখানে উপস্থিত গ্রাহক জয়দেব চক্রবর্তী বলেন, তার চার লাখ ২৬ হাজার টাকা জমা রয়েছে। সে দিনের পর দিন ঘুরেও কোনো টাকা পাচ্ছেন না।

সান্তাহার পৌরসভার সাবেক মেয়র গোলাম মোরশেদ বলেন, তিনিসহ তাঁর তিন ভাই এই সংস্থায় প্রায় ১৮ লাখ টাকা রেখেছেন কিন্তু কাউকে টাকা দেওয়া হচ্ছে না।

সান্তাহার শহরের ব্যবসায়ী জালাল উদ্দিন বলেন, তাঁর নিজের, পরিবারের, মেয়ে জামাইয়ের প্রায় ৪৪ লাখ টাকা উচ্চ মুনাফার আশায় রেখেছেন। আওয়ামী লীগ নেতা মো. আবদুল জলিলের পরিবারের ১২ লাখসহ মো. আজিজার মোল্লা, সোলাইমান আলী শেখ, হামিদুর রহমান, যুবলীগ নেতা মরহুম শফিকুল ইসলাম, মো. আবদুর রহিম প্রায় দুই কোটি টাকা আমানত হিসেবে রেখেছেন ওই সংস্থায়। কিন্তু আট-নয় মাস ধরে মুনাফা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। এখন মুনাফা বা আসল টাকা ফেরত দেওয়ার কোনো নামই নেই।

এভাবে এক লাখ থেকে ৭৫ লাখ টাকা পর্যন্ত উচ্চ মুনাফার লোভ দেখিয়ে নওগাঁ, আদমদীঘি, সান্তাহারসহ আশপাশের বিভিন্ন উপজেলার প্রায় আড়াই হাজার আমানতকারীর প্রায় ৫০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে।

প্রায় নয় মাসে বারবার আমানতকারীদের টাকা ফেরত দেওয়ার কথা বলে শুধু সময়ক্ষেপণ করা হয়েছে বলে ভুক্তভোগী আমানতকারীরা অভিযোগ করেছে। মুনাফা বন্ধের প্রথম দিকে আপ্রকাশির মালিক মোবাইলে গ্রাহকদের সঙ্গে কথা বললেও এখন আর কারো মোবাইল তিনি রিসিভ করেন না। নওগাঁ সদর উপজেলার বোয়ালিয়া ইউনিয়নের আলিশান বাড়িতে থাকলেও কারো সঙ্গে দেখা করেন না।

আমানতকারীদের টাকা ফেরত না দেওয়ার ব্যবস্থা না করে প্রায় ৫০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে আড়াই হাজার পরিবারকে পথে বসিয়ে আত্মগোপনে চলে গেছেন এস এম জুয়েল। এতে আমানতকারীদের ক্ষোভ বিক্ষোভে পরিণত হচ্ছে। আমানতকারীদের ৫০ কোটি টাকার এই ঘটনা নিয়ে সান্তাহারে যেকোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনার আশঙ্কা করছেন পৌরবাসী।

এ বিষয়ে আপ্রকাশি মাল্টিপারপাসের নির্বাহী পরিচালক এস এম জুয়েলের দুটি মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা করা হলে তিনি ফোন ধরেননি।