‘পুরো বিষয়টা দেশের জন্য খারাপ’
বাংলাদেশে গোয়েন্দা কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে নিউজিল্যান্ড। আজ নিউজিল্যান্ড হেরাল্ড পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য জানানো হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থার (এনএসএ) সাবেক ঠিকাদার এডওয়ার্ড স্নোডেনের দেওয়া নথির ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, গোয়েন্দা তৎপরতা থেকে পাওয়া তথ্য তারা বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাকে দিচ্ছে। বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী সেই সব গোয়েন্দা তথ্যের অপব্যবহার করছে বলেও অভিযোগ করা হয়েছে।
পুরো বিষয়টা বাংলাদেশের ভাবমূর্তির জন্য খারাপ বলে মনে করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন। এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে টেলিফোন আলাপে তিনি বলেন, ‘প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে যে, ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্টেও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কমপ্লেইন করা হয়েছে। শুধু ইন্টারনাল ইন্টারফেয়ারান্স (অভ্যন্তরীণ হস্তক্ষেপ) তো না, একটা বিদেশি কান্ট্রি আমাদের সরকারকে ইনফরমেশন দিচ্ছে। এখন এটা নিয়ে তাদের দেশে (নিউজিল্যান্ডে) পলিটিক্যাল সমস্যা শুরু হয়েছে। অথচ নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে বাংলাদেশের সে রকম কোনো সম্পর্ক নেই। নিউজিল্যান্ড থেকে দেওয়া তথ্য বাংলাদেশে মিসইউজ (অপব্যবহার) হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর বদনাম হচ্ছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে।’
সাবেক এই নির্বাচন কমিশনার বলেন, এসব যদি সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে বাংলাদেশ সরকারকে অবশ্যই এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে হবে। কারণ, পুরো বিষয়টাই বাংলাদেশের জন্য খারাপ। এখন সরকার কী করে সেটাই দেখার বিষয়।
নিউজিল্যান্ড হেরাল্ডের প্রতিবেদন ও ফাঁস করা নথিপত্রের ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল কিছুই জানেন না বলে জানিয়েছেন। নিউজিল্যান্ডের সরকারি তথ্য নিরাপত্তা ব্যুরো (জিসিএসবি) গুপ্তচরবৃত্তি করে দেওয়া তথ্য বাংলাদেশকেও দিচ্ছে বলে হেরাল্ডের প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে -এ বিষয়ে সরকারের অবস্থান জানতে চাইলে আজ সন্ধ্যায় প্রতিমন্ত্রী এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমার কিছুই জানা নেই। আমি জেনে তারপর বলতে পারব।’
এ বিষয়ে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) গণমাধ্যম শাখার প্রধান কমান্ডার মুফতী মাহমুদ খান এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমরা কিছুই জানি না। কোথায় প্রতিবেদনটি প্রকাশ হয়েছে তা দেখি, কী নথি তা দেখি। সেগুলো কতটুকু অথেনটিক (যথার্থ), সেটা দেখেই এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করা যাবে।’
যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে নিউজিল্যান্ডের গুপ্তচরবৃত্তির প্রসঙ্গে সাখাওয়াত হোসেন বলেন, নিউজিল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট একটি চুক্তি আছে। সেই চুক্তির আওতায় তারা এই গোয়েন্দাগিরি করে থাকতে পারে। অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ANZUS নামে একটি চুক্তি ছিল। সেই চুক্তি অনুযায়ী প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলো আঞ্চলিক নিরাপত্তা সহযোগিতা দেবে। সেই চুক্তির আওয়ায় নিউজিল্যান্ড যুক্তরাষ্ট্রকে সহযোগিতা দিতে পারে।
একই বিষয়ে জানতে চাইলে তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য-সচিব আনু মুহাম্মদ এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘এটা খুব নতুন ঘটনা না। বাংলাদেশ, ভারত বা পাকিস্তানে মার্কিন গোয়েন্দা তৎপরতা সব সময়ই বেশি ছিল। নিউজিল্যান্ডের গোয়েন্দাগিরির যে তথ্য, সেটা ওদের (মার্কিনিদের) একটা কৌশলেরই অংশ।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের এ শিক্ষক আরো বলেন, ‘অনেক সময় দেখা যায়, বিভিন্ন দেশে ওরা কখনো নিজেরা সরাসরি না করে অন্য কোনো দেশের মাধ্যমে গোয়েন্দাগিরি করে। এতে ক্যামোফ্লেজ (ধূম্রজাল) করতে সুবিধা হয়।’
ফাঁস হওয়া নথিগুলো থেকে জানা গেছে, নিউজিল্যান্ডের সরকারি তথ্য নিরাপত্তা ব্যুরো (জিসিএসবি) বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে তথ্যবিনিময় করত। একই সঙ্গে সংস্থাটি র্যাবের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগও তদারকি করত।
জিসিএসবির ২০০৯ সালের প্রতিবেদনের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার ক্ষেত্র হিসেবে বাংলাদেশ অংশে লেখা হয়েছে, সিগনাল ইন্টেলিজেন্স ডেভেলপমেন্টের লক্ষ্যমাত্রার ক্ষেত্র নিয়ে কাজে সব সময়ই অগ্রগতি লক্ষ করা যায়। এ ক্ষেত্রে টেলিযোগাযোগের পরিবেশে সব সময়ই যে কোনো ধরনের প্রাসঙ্গিক তথ্য যুক্ত হতে থাকে। বাংলাদেশ বিষয়ে সাম্প্রতিক সময়ে নতুন করে তথ্য প্রকাশ হয়েছে।
বাংলাদেশ বিষয়ে অনেক ধরনের নতুন তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সময়ের প্রযুক্তিগত উন্নয়ন। এসব নিয়ে কোন কোন স্তরে কাজ করা যায় সেদিকে বিশেষ মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে।
‘ঢাকা সার্ভে’ শিরোনাম দিয়ে জিসিএসবির প্রতিবেদনটিতে আরো বলা হয়েছে, বাংলাদেশের র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পর্কে সাম্প্রতিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, তারা কীভাবে কাজ করে। এটা সিগনাল ইন্টেলিজেন্সকে বাংলাদেশের টেলিকমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক কীভাবে কাজ করে তা বুঝতে সাহায্য করেছে। এসব উল্লেখিত ব্যাপক ভূতাত্ত্বিক তথ্য, টেলিকমিউনিকেশনের চলাচলের পথ এবং সিগনালের বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণের কাজে লাগে। সমান্তরালভাবে ‘এফ ৬’ র্যাবের ব্যক্তিগত আওয়াজকে র্যাবের সদর দপ্তর থেকে বিভিন্ন ইউনিটে পাঠাতে সহায়তা করেছে। এটা র্যাব সদর দপ্তর থেকে র্যাব ৩-এর কার্যালয়ের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমেও দেখা গেছে।
ওই প্রতিবেদনে কয়েক বছর ধরে র্যাবকে জিসিএসবি সক্রিয় টার্গেট গ্রুপ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। এবং এসব তথ্য বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি মোকাবিলায় কাজে লাগবে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকারকে তো আমরা কখনো জাতীয় স্বার্থরক্ষা ও নিজেদের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় মনোযোগী হিসেবে পাইনি। সে ক্ষেত্রে এটাও ব্যতিক্রম নয় কিংবা খুব আকস্মিকও নয়।’
এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘হেরাল্ডের প্রতিবেদন অনুযায়ী, নিউজিল্যান্ডের সরকারি তথ্য নিরাপত্তা ব্যুরো (জিসিএসবি) বাংলাদেশকেও বিভিন্ন তথ্য প্রোভাইড (সরবরাহ) করছে। তার মানে এসব বিষয়ে সরকার জানে। সরকার জানে যে, এসব ইনফরমেশনের বেসিসেই (তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই) টর্চার সেলে নির্যাতন করা হচ্ছে, এক্সট্রা জুডিশিয়াল কিলিং (বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড) হচ্ছে।’
বাংলাদেশে গোয়েন্দাগিরিতে জিসিএসবির সম্পৃক্ততা প্রসঙ্গে নিউজিল্যান্ডের গ্রিন পার্টির নেতা ড. রাসেল নরম্যান গণমাধ্যমে বলেছেন, বাংলাদেশের যেসব গোয়েন্দা সংস্থার কাছে জিসিএসবি তথ্য পাচার করত, সেগুলোর বিরুদ্ধে বিভিন্ন সম্প্রদায়, ধর্মীয় সংখ্যালঘু, রাজনৈতিক বিরোধী, সাংবাদিক ও শ্রমিক সংগঠনের নেতাসহ নিরীহ লোকজনকে লক্ষ্য বানানো, নির্যাতন ও হত্যার অভিযোগ আছে। তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী জন কি সব সময়ই জিসিএসবির পক্ষে দাঁড়িয়ে বলেন যে, ব্যুরো ভালো মানুষকে রক্ষা করে। কিন্তু এই নথিপত্র প্রকাশ করেছে যে, তারা খারাপ মানুষকে সহায়তা করছে।’
বিদেশে বাংলাদেশের বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে ওঠা এমন অভিযোগকে দেশের জন্য খারাপ বলে উল্লেখ করেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। তিনি বলেন, ‘কেউ যদি মানবাধিকার লঙ্ঘন করে, তাহলে সে খবর তো বাইরে প্রকাশ হবেই। যারা লঙ্ঘন করছে, তারাই প্রধান অপরাধী। তবে এটাও ঠিক যে অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থা নিজেদের স্বার্থরক্ষায়ও অনেক কাজ করে থাকে। এখন দেশে বহুজাতিক পুঁজিবাদী বিভিন্ন সংস্থা আছে। এরা অনেক সময় নিজেদের স্বার্থরক্ষায় নানাভাবে জনগণের ভেতরে একটা আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করতে চায়।’ তিনি বলেন, ‘আমরা নিজেরা এখন একটা অগণতান্ত্রিক দেশে বাস করছি। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, খুন এগুলো অহরহই হচ্ছে। যদিও সরকারের ব্যাখ্যা হচ্ছে, এগুলো বন্দুকযুদ্ধ। তবে আসল ঘটনা কী তা তো পত্রপত্রিকায় প্রকাশ হচ্ছে।’
‘সরকারকে অবশ্যই এটার ব্যাখ্যা করতে হবে। আমাদের দেশের সংস্থা নিয়ে বাইরের দেশে খবর প্রকাশিত হচ্ছে। এটার দায়-দায়িত্ব সরকার এড়াতে পারে না,’ উল্লেখ করেন আনু মুহাম্মদ।
এ প্রসঙ্গে অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাখাওয়াত হোসেন যোগ করেন, ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বাংলাদেশের এই সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে নালিশ করা হয়েছে। ইট ইজ ব্যাড ফর দ্য কান্ট্রি। বিশ্বদরবারে আমাদের দেশের ভাবমূর্তি এমনিতেই তো নষ্ট, এসবের কারণে আরো নষ্ট হচ্ছে।’