ভোটার তালিকায় নাম উঠছে না সাবেক ছিটমহলের মানুষের

Looks like you've blocked notifications!
পুরোনো ছবি

ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করতে পারছেন না পঞ্চগড় জেলার দেবীগঞ্জ, বোদা ও সদর উপজেলার বিলুপ্ত ৩৬টি ছিটমহলের কয়েক হাজার নাগরিক।

সম্প্রতি জেলা নির্বাচন অফিস ছিটমহলগুলোতে ভোটার তালিকা হালনাগাদের কাজ শুরু করেছে। ২০১১ সালে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ হেডকাউন্টিংয়ে (মাথা গণনা) যেসব ব্যক্তির নাম বাদ পড়েছে, নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত মোতাবেক সেসব ব্যক্তির নাম ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে না।

অপরদিকে, হেডকাউন্টিংয়ে যেসব অবিবাহিত পুরুষের নাম অন্তর্ভুক্ত ছিল, সম্প্রতি যারা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন, তাঁদের স্ত্রীদের নামও ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে না।

জীবন-জীবিকার তাগিদে ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় কাজের জন্য বাইরে থাকায়, আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে ২০১১ সালের হেডকাউন্টিংয়ে এসব ব্যক্তির নাম বাদ পড়ে। ২০১৫ সালের হেডকাউন্টিংয়ের সময় এসব ব্যক্তি উপস্থিত থাকলেও ২০১১ সালের তালিকা অনুযায়ী হেডকাউন্টিং করায় সেবারও এসব ব্যক্তির নাম তালিকাভুক্ত করা হয়নি। নাম নেই এমন ব্যক্তিদের তথ্য সংগ্রহ ও ছবি তোলার জন্য রেজিস্ট্রেশন না করায় তারা রেজিস্ট্রেশন কেন্দ্র, ছিটমহলের নেতৃবৃন্দ, ইউনিয়ন পরিষদ ও উপজেলা পরিষদের জনপ্রতিনিধিসহ নিজ নিজ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের কাছে ধরনা দিয়েও কোনো সুবিধা করতে পারছেন না।

বাদ পড়া ব্যক্তিদের মাঝে ক্ষোভ ও হতাশা বাড়ছে। পঞ্চগড় জেলার দেবীগঞ্জ, বোদা ও সদর উপজেলায় গিয়ে জানা গেছে, দেবীগঞ্জ উপজেলার দেবীগঞ্জ ইউনিয়ন, টেপ্রিগঞ্জ ও চিলাহাটি ইউনিয়নের হাজীপাড়া, বালাপাড়া, দহলা খাগড়াবাড়ি, ওকরাবাড়ি, কোর্টভাজনি, নাটকটোকা, বেহুলাডাঙ্গা, কাজলদিঘী, শালবাড়ি ছিটমহলে বোদা উপজেলার বড়শশী, কাজলদিঘী কালিয়াগঞ্জ ও ময়দানদিঘী ইউনিয়নের নাজিরগঞ্জ, দইখাতা ও পুটিমারী ছিটমহলে এবং পঞ্চগড় সদর উপজেলার হাড়িভাসা ও হাফিজাবাদ ইউনিয়নের গাড়াতি ছিটমহলগুলোতে নির্বাচন অফিস গত ১০ থেকে ১৬ জুলাই পর্যন্ত তথ্য সংগ্রহের কাজ এবং গত ১৭ জুলাই থেকে ছবি তোলার জন্য রেজিস্ট্রেশনের কাজ শুরু করে। এসব এলাকার কয়েক হাজার মানুষ ২০১১ সালের হেডকাউন্টিংয়ে নাম বাদ পড়েছেন। ২০১৫ সালেও এসব ব্যক্তিদের নাম উত্তোলন করা হয়নি। ফলে চলতি বছরের জুলাই মাসে ছবি তোলার জন্য রেজিস্ট্রেশন শুরু হলে বাদ পড়া ব্যক্তিদের ভোটার তালিকায় নাম উত্তোলন বা ছবি তোলার জন্য তাঁদের ডাকা হচ্ছে না।

দেবীগঞ্জ উপজেলার চিলাহাটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. শহিদুল ইসলাম, বোদা উপজেলার কাজলদিঘী কালিয়াগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আলহাজ ফজলার রহমান, সদর উপজেলার হাফিজাবাদ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. শাহাদাত হোসেনসহ ছিটমহল এলাকার লোকজন জানান, দেবীগঞ্জ উপজেলায় দেড় থেকে দুই হাজার, বোদা উপজেলায় প্রায় এক হাজার ও সদর উপজেলায় দুই শতাধিক ব্যক্তির নাম ২০১১ সালের হেডকাউন্টিংয়ে বাদ পড়েছে।

২০১১ সালের হেডকাউন্টিংয়ে দই খাতা ছিটমহলের বাবুল চন্দ্র ও তাঁর মেয়ের নাম অন্তর্ভুক্ত হলেও বাবুল চন্দ্রের স্ত্রী শোভা রানীর নাম অন্তর্ভুক্ত হয়নি। একই ছিটমহলের নিমো বালা (৭০) নামে এক বৃদ্ধার নাম না উঠলেও তাঁর দুই ছেলে ও ছেলের পরিবারের সবার নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। একই এলাকার সুশীলের নাম না উঠলেও বাবা-মাসহ পরিবারের অন্য সবার নাম উঠেছে।

নাজিরগঞ্জ ছিটমহলের জসিমউদ্দিন সবুজের নাম ২০১১ সালের হেডকাউন্টিংয়ে উঠলেও ২০১১ সালের পরে বিয়ে করেন সবুজ। কিন্তু তাঁর স্ত্রী হুসনেয়ারার নাম না থাকায় তিনিও ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করতে পারছেন না। এসব ছিটমহলের রাজেন্দ্রনাথ রায়, মালেকা, বাছিরন, বেবি, লাকী, রমিছা, জেসমিন, আদরী, সুরাইয়া, ওমেছা, আমিনা, খালেদা বেগমসহ অনেকেরই নাম ২০১১ সালের হেডকাউন্টিংয়ে নেই। 

বেহুলাডাঙ্গা ছিটমহলের আমিনপাড়া এলাকার আতাউল ইসলাম (৪০) বলেন, ‘চট্টগ্রামে কাজ করতে গিয়েছিলাম। সে সময় হেডকাউন্টিং চলেছিল। আমি জানতাম না, আসতেও পারিনি। কেউ আমার নামও বলেনি। এ কারণে আমার নাম নেই। আমি এখন ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করতে পারছি না।’ একই অবস্থা বেহুলাডাঙ্গা সিরাজনগর এলাকার টিপি খাতুনের, হাজীপাড়া এলাকার মমিনুল ও দহলাখাগড়াবাড়ি এলাকার নুরিনা বেগমেরও।

ছিটমহলে জন্ম, জমিজমা সংসার সবই ছিটমহলে, দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছেন ছিটমহলে তবুও ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করতে পারছেন না দইখাতা ছিটমহলের রাজেন্দ্রনাথ রায়। তাঁর পরিবারের ছয়জনের কারো নাম না থাকায় কেউই ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করতে পারছেন না।

নাজিরগঞ্জ ছিটমহলের বাসিন্দা ডিগ্রি পরীক্ষার্থী শামীমা আক্তার ববি বলেন, ‘কলেজ থেকে এসে শুনি হেডকাউন্টিং শেষ। সে সময় আমার নাম আর হেডকাউন্টিংয়ে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। আমি কি ভিনদেশ থেকে এখানে এসে বসবাস করছি?’

নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ কমিটি বাংলাদেশ ইউনিটের নেতা মো. মফিজার রহমান ও মো. সিরাজুল ইসলাম ছিটমহলে জন্ম, ছিটমহলে বসবাসকারী যেসব নাগরিকের হেডকাউন্টিংয়ে নাম বাদ পড়েছে তাঁদের বাংলাদেশি হিসেবে ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করার জন্য নির্বাচন কমিশনসহ সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

নাম পড়া এসব ব্যক্তিদের ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করার জন্য ছিটমহলের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরা নির্বাচন অফিস ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার শরণাপন্ন হয়েছেন। নির্বাচন অফিস ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা বাদ পড়া ব্যক্তিদের নামের তালিকা তৈরি করে রাখতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন। 

বোদা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আবু আউয়াল জানান, নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০১১ সালে যাদের হেড কাউন্টিংয়ে নাম রয়েছে তাদের ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। বাদ পড়া ব্যক্তিদের নামের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘এ তালিকা আমরা নির্বাচন কমিশনে পাঠাব। নির্বাচন কমিশন সিদ্ধান্ত দিলে তাদেরও ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করা হবে।’

জেলা নিবাচন কর্মকর্তা দেওয়ান মো. সারওয়ার জাহান জানান, নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, যাদের ২০১১ সালের হেডকাউন্টিংয়ে নাম রয়েছে, তারাই শুধু ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করতে পারবে।

২০১১ সালের হেডকাউন্টিংয়ে নাম থাক আর না থাক, ছিটমহলে বসবাসকারী সবার নাম বাংলাদেশি হিসেবে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হোক এ দাবি ছিটমহলবাসীর।