বীর প্রতীক, প্রথম শহীদসহ ৬৯ মুক্তিযোদ্ধার সনদ স্থগিত

Looks like you've blocked notifications!
ভৈরবে ৫০ জন মুক্তিযোদ্ধার সমাধিস্থলে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় ২৯ নম্বরে আশুরঞ্জন দে এবং ৩৩ নম্বরে মো. আমির হোসেনের নাম। ছবি : এনটিভি

ভৈরবের একমাত্র বীর প্রতীক, প্রথম শহীদ, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও ক্যাম্প প্রশিক্ষকসহ ৬৯ জনের মুক্তিযোদ্ধা সনদ স্থগিত করে পুনরায় যাচাই-বাছাইয়ের নির্দেশ দিয়েছে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা)। 

ভৈরবে গেজেটভুক্ত মোট মুক্তিযোদ্ধা ৪৪৯ জন। এর মধ্যে ৬৯ জনের নাম ‘স্থগিতকৃত গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধার তালিকায়’ অন্তর্ভুক্ত করে তা যাচাই-বাছাইয়ের জন্য গত ২ ও ৯ মার্চ জামুকার সহকারী পরিচালক (উন্নয়ন, পরিকল্পনা, এস্টেট ও কল্যাণ) মোসা. জেসমিন আক্তার এবং সার্টিফিকেট সহকারী নয়ন দেবনাথের যৌথ স্বাক্ষরিত চিঠি কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক এ এম আলমের কাছে পাঠানো হয়।

পরে জেলা প্রশাসক সেটি ভৈরব মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জেসমিন আক্তারের কাছে পাঠান। স্বীকৃত, জাতীয়ভাবে ও সমাজে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত এমন ব্যক্তিদের সনদ স্থগিতের নির্দেশে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তাঁদের পরিবারের সদস্য ও সহযোদ্ধারা। কী কারণে এ ধরনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তারও কারণ জানতে চান তাঁরা।

ইউএনও জেসমিন আক্তার এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘স্থগিতকৃত গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধার তালিকায়’ জাতীয়ভাবে স্বীকৃত কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার নাম রয়েছে। ভালো করে প্রচার চালিয়ে সবার উপস্থিতিতে যাচাই-বাছাই করে সঠিক তালিকা প্রণয়ন করা হবে।’

সনদ স্থগিতের তালিকায় থাকা নামের মধ্যে আছে ভৈরবের একমাত্র বীর প্রতীক সিপাহি মো. আমির হোসেন বীর প্রতীক (মুক্তিযোদ্ধার আইডি নং- ০৩০৬১৩০১০৩), প্রথম শহীদ আশুরঞ্জন দে (মুক্তিযোদ্ধার আইডি নম্বর ০৩০৬১৩০০০২) এবং কমান্ডার আবদুর রউফ (মুক্তিযোদ্ধার আইডি নম্বর ০৩০৬১৩১০০০) নামও রয়েছে।

আমির হোসেন বীর প্রতীকের এলাকার যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মো. রহমত উল্লাহ এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ১৯৭৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় (গেজেট নোটিফিকেশন নম্বর ৮/২৫/ডি-১/৭২-১৩৭৮) উপাধিপ্রাপ্ত ৪২৬ জন মুক্তিযোদ্ধার তালিকা প্রকাশ করে। ওই তালিকার ১৫৫ নম্বর হলেন ভৈরবের মুক্তিযোদ্ধা মো. আমীর হোসেন বীর প্রতীক।

রহমত উল্লাহ জানান, পুলিশ বাহিনীর সদস্য আমীর হোসেন ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন রাজারবাগ পুলিশ লাইনে। ২৫ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনী রাজারবাগ আক্রমণ করলে তাঁরা প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। প্রতিরোধ ব্যর্থ হলে তিনি পালিয়ে চলে আসেন ভৈরবের তাঁর নিজগ্রাম কালিকাপ্রসাদ ইউনিয়নের আদর্শপাড়ায়। জুনের প্রথম দিকে চলে যান ভারত। যোগদেন মুক্তিবাহিনীতে। তাঁকে ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। প্রথমে তিন নম্বর সেক্টরে, পরে এস ফোর্সের অধীনে যুদ্ধ হন তিনি। 

১৯৭১ সালে ৪ ডিসেম্বর আখাউড়ার আজমপুর রেলস্টেশন এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে আমীর হোসেন শহীদ হন। সেখানেই তাঁকে সমাহিত করা হয়। স্বাধীনতার পর তাঁকে মরণোত্তর বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করে তৎকালীন বঙ্গবন্ধু সরকার। 

মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন ইতিহাস ও মুক্তিযোদ্ধাদের দেওয়া ভাষ্যমতে, ভৈরবের প্রথম শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হলেন আশুরঞ্জন দে। তিনি ভারতের উত্তর প্রদেশের দেরাদুনের তান্দুয়া ট্রেনিং সেন্টার থেকে ট্রনিং নেন। ১৯৭১ সালের ২৪ অক্টোবর ২৮৩ জন মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সীমান্ত অতিক্রম করে কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কের নন্দনপুর দিয়ে ভৈরব আসার পথে দলটি পাকিস্তানি বাহিনীর অ্যামবুশে পড়ে। 

সেই দলের সদস্য ভৈরব পৌরসভার সাবেক মেয়র অ্যাডভোকেট ফখরুল আলম আক্কাছ ও রফিকুল ইসলাম মহিলা অনার্স কলেজের প্রতিষ্ঠাতা আলহাজ মো. রফিকুল ইসলাম এনটিভি অনলাইনকে বলেন, পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে যুদ্ধে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ধরা পড়েন আশুরঞ্জন। দু-তিনদিন পর তাঁকে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে অমানবিক নির্যাতনে হত্যা করে এলাকার একটি খালে ফেলে দেওয়া হয়। পরে তাঁর মৃতদেহ কসবার কোল্লাপাথর নামক স্থানে সৎকার করা হয়। ওই স্থানে এখনো শহীদ আশুরঞ্জনের নামসংবলিত স্মৃতিসৌধ রয়েছে। ১৯৭২ সালে তাঁর স্মরণে ভৈরবের পৌর শহরের টিনবাজারের একটি সড়কের নামকরণ হয় ‘শহীদ আশুরঞ্জন সড়ক’।

আশুরঞ্জন দের মুক্তিযোদ্ধা সনদ স্থগিত করাকে সুগভীর ষড়যন্ত্র হিসেবে আখ্যা দিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে তাঁর দুই সহযোদ্ধা বলেন, ‘এমন ঘৃণ্য কাজে যারা জড়িত তাদের খুঁজে বের করে কঠিন শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।’

মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবদুর রউফের চাচাতো ভাই, ভৈরব প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক এবং মুক্তিযোদ্ধা আবদুল খালেক কালা মিয়ার ছেলে, বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামন ফারুক এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘এ তালিকা প্রণয়নের আগে আমাদের কাছে প্রমাণাদি দেখতে চাওয়া উচিত ছিল। এটি করে মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি তাঁদের পরিবারের সদস্যদের সমাজে ছোট করা হয়েছে।’ তিনি এর প্রতিকার চেয়ে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন।

বাংলা একাডেমির চরিতাভিধান দ্বিতীয় সংস্করণে কমান্ডার আবদুর রউফ সম্পর্কে বলা হয়েছে, ১৯৬৮ সালের ১৭ জানুয়ারি একটি মামলায় মুক্তি দেওয়ার পর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের গেট থেকে বঙ্গবন্ধুকে আবার গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁকে প্রধান আসামি করে ৩৫ জনের বিরুদ্ধে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ দায়ের করা হয়। মামলার অভিযোগে বলা হয়েছিল, ‘অভিযুক্তরা ভারতীয় অর্থ ও অস্ত্রের সাহায্যে সশস্ত্র সংঘর্ষ ঘটিয়ে কেন্দ্র থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের ষড়যন্ত্র করেছিলেন।’ ওই মামলার একজন অন্যতম অভিযুক্ত হলেন ভৈরবের আবদুর রউফ। তিনি তখন নৌবাহিনীর কর্মকর্তা ছিলেন।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে বামপন্থী তরুণদের নিয়ে যে বিশেষ গেরিলা বাহিনী গঠন করা হয়েছিল, আবদুর রউফ ছিলেন সেই গেরিলা বাহিনীর তিন সদস্য পরিচালকমণ্ডলীর অন্যতম সদস্য। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর নৌবাহিনীর কমান্ডার আবদুর রউফকে গ্রেপ্তার করে চাকরিচ্যুত করা হয়। পরে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমস্ত ভাতাসহকারে অবসর দিয়ে তাঁর সম্মান ফিরিয়ে দেন। চলতি বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি তিনি সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে মারা যান। রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর মৃত্যুতে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে শোক জানান। প্রখ্যাত এ মুক্তিযোদ্ধাকে যথাযথ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হয়।

‘স্থগিতকৃত গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধার তালিকার’ ৬৯ জনের মধ্যে অনেকেরই এ রকম বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে বলে জানান স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা।