যাদের নেতৃত্বে খালেদা জিয়ার গাড়িতে হামলা
রাজধানীর বাংলামোটর এলাকায় গতকাল বুধবার বিকেলে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার গাড়িতে যে হামলার ঘটনা ঘটেছে, তাতে নেতৃত্ব দেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির অন্তত দুজন নেতা। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরাও।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য, ভিডিও ফুটেজ ও ছবি দেখে কয়েকজনের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে। বাকিদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।
হামলার আগে-পরের ছবি ও ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সাদা পাঞ্জাবি ও হালকা নীল জিন্সের প্যান্ট করা এবং কমলা রঙের লাঠি হাতে হামলায় একজন নেতৃত্ব দেন। এই ব্যক্তির নাম মশিউর রহমান রুবেল। তিনি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক।
ছবি ও ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, রুবেল অন্য নেতা-কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে লাঠি দিয়ে খালেদা জিয়ার একজন ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষীকে পেটাচ্ছেন। এর মধ্যে এক যুবককে এলোপাতাড়ি লাথি মারতে দেখা যায়। তাঁর পরিচয় এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
হামলার বিষয়ে আজ বৃহস্পতিবার মশিউর রহমান রুবেলের বক্তব্য জানতে এনটিভি অনলাইনের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়। তিনি বলেন, ‘আমরা নির্বাচনী প্রচারণার কাজ করছিলাম। এর মধ্যে কখন খালেদা জিয়ার গাড়ি আসছে খেয়াল করি নাই। দেখলাম কিছু মানুষের ভিড়, জনগণ বিভিন্ন রকম স্লোগান দিচ্ছিল। সিগনাল ছাড়ার পর সিএসএফের গাড়ি আমাদের দুজন কর্মীর গায়ের ওপর উঠায়ে দিছে, সেখান থেকে গুলিও করেছে। এতে আমাদের দুই নেতা-কর্মী লিটন ও জাকের হোসেনের মেরুদণ্ড আর দুই পা ভেঙে গেছে। ওরা এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে।’
রুবেল বলেন, ‘আমাদের লোকজন আহত হওয়ার পর আমরা আঘাত করছি। এর আগে তো কিছু হয় নাই। তা ছাড়া জনগণও তো খালেদা জিয়ার ওপর ক্ষ্যাপা। সে কত মানুষকে পুড়ায়ে মেরে ফেলছে।’
‘তা ছাড়া যেখানে দুই-চারশো মানুষকে পুড়ায়ে মারছে, সেখানে এই রকম দুই-তিনজনকে আহত করাটাকে তো আমি বেশি কিছু বলে মনে করি না। এইটাকে বড় কোনো বিষয় বলে আমি মনে করি না। সবাই দেখতেছে আমরা মারছি, কিন্তু সে যে কত মানুষকে পুড়াইসে সেইটা কেউ দেখতেছে না,’ বলেন রুবেল।
তাঁদের প্রত্যেকের হাতেই কমলা রঙের লাঠির প্রসঙ্গ টেনে এই হামলা কি পূর্বপরিকল্পিত কি না, তা জানতে চাইলে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় এই নেতা বলেন, ‘না না কোনো পরিকল্পনা ছিল না। আমরা তো ইলেকশনের কাজ করতেছিলাম। আমাদের লোক আহত হওয়ার পরেই আমরা ওখানে গেছি।’
ভিডিও ফুটেজ ও ছবিতে দেখা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের পরিকল্পনা ও কর্মসূচিবিষয়ক সম্পাদক আশিকুল পাঠান সেতুও সিএসএফ সদস্যকে মারপিটে অংশ নেন। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আমি গতকাল এক ছোট ভাইয়ের সঙ্গে বাইকে করে কারওয়ান কাজারে একটা প্রচারণায় যাচ্ছিলাম। সে সময় রাস্তায় জ্যাম দেখে থামছি। দেখি খালেদা জিয়ার গাড়িবহর। হঠাৎ দেখি খালেদা জিয়ার একজন নিরাপত্তারক্ষীকে কয়েকজন মিলে মারতেছে। সেখানে আমার ক্যাম্পাস ও অন্যান্য জায়গার কিছু পরিচিত মুখ দেখি।
ভাবলাম, একজন নিরাপত্তারক্ষীকে কেনো মারবে? তা ছাড়া সেখানে অনেকগুলা ক্যামেরা আছে। তাই তাদেরকে (যারা মারছিলেন) ওইখান থেকে সরায়ে দিতে আমি বাইক থেকে নেমে ওইখানে যাই। পরিচিত ছেলেগুলা যেন ওই সিএসএফ সদস্যকে না মারে আমি সেই চেষ্টা করছিলাম।’
ভিডিও ফুটেজে গোলাপি-নীল-সাদা রঙের চেক শার্ট পরিহিত সেতুকেও ওই সিএসএফ সদস্যকে মারতে দেখা যাওয়ার কথা জানালে তিনি বলেন, ‘এই রকম তো থাকার কথা না। কারণ আমি ওই সদস্যকে যেন অন্যরা না মারতে পারে সেটা দেখছিলাম। তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করছিলাম। যে পরিচিত ছেলেগুলো ছিল ওদের সঙ্গে দুই-একটা কথা বলে আমি সেখান থেকে চলে আসি।’
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মেহেদী হাসানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এনটিভি অনলাইনকে জানান, আশিকুল পাঠান সেতু সম্পর্কে বা এই ঘটনায় তাঁর উপস্থিতি সম্পর্কে তাঁর কাছে কোনো তথ্য নেই। তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কিছুই জানি না।’
একই স্থানে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির উপ-ক্রীড়া সম্পাদক গোলাম বাকী চৌধুরীকেও ওই সিএসএফ সদস্যকে লাথি মারতে দেখা যায়। নীল রঙের যে টি-শার্টটি পরে তিনি ওই হামলায় অংশ নেন, সেই একই টি-শার্ট পরিহিত অবস্থায় তাঁকে তাঁর ফেসবুক অ্যাকাউন্টে পোস্ট করা কিছু ছবিতেও দেখা যায়।
এসব বিষয়ে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি এইচ এম বদিউজ্জামান সোহাগের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও ফোন ধরেননি তিনি।
গতকাল বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে কারওয়ান বাজার পার হয়ে খালেদা জিয়ার গাড়িবহরটি বাংলামোটর পৌঁছালে হঠাৎই লাঠিসোটা নিয়ে গাড়িবহরে হামলা করা হয়। হামলাকারীরা স্লোগান দিচ্ছিলেন ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বিএনপির চেয়ারপারসনের গাড়িবহরটি বাংলামোটরে আসার পরপরই হামলার ঘটনা ঘটে। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা এ হামলা করেন।
একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা আগে থেকেই সেখানে অবস্থান করছিলেন। সবার হাতেই ছিল কমলা রঙের লাঠি।
হামলাকারীরা বিএনপির চেয়ারপারসনকে বহনকারী গাড়ি লক্ষ্য করে একাধিক লাঠি ছুঁড়ে মারে। একটি লাঠির আঘাতে গাড়ির জানালার কাচ ভেঙে যায়। বহরে থাকা একটি গাড়ির প্রায় সব কাচ লাঠি দিয়ে আঘাত করে ভেঙে ফেলা হয়। ওই গাড়িতে খালেদা জিয়ার নিরাপত্তায় নিয়োজিত সিএসএফের সদস্যরা ছিলেন। ছাত্রলীগের কর্মীরা সিএসএফের একাধিক সদস্যকে গাড়ির বাইরে এনে লাঠি দিয়ে পেটান। একপর্যায়ে মারতে মারতে লাঠি ভেঙে ফেলেন। ট্রাফিক পুলিশ ও সার্জেন্টের সামনেই ছাত্রলীগকর্মীরা সিএসএফ সদস্যদের ওপর এ রকম হামলা চালান।
গুরুতর আহত সিএসএফ সদস্য সামিউল ইসলামকে ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আরেকজনকে ভর্তি করা হয়েছে একটি ক্লিনিকে। হামলায় বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুল কাইয়ুমও আহত হন। এ সময় গণমাধ্যমের কয়েকটি গাড়িও ভাঙচুরের শিকার হয়।