আবার দায়িত্বে তারানকো, নতুন মোড়ে রাজনীতি!
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্বনেতাদের জোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। জাতিসংঘের পক্ষ থেকে চিঠি দিয়ে, টেলিফোন করে রাজনৈতিক অস্থিরতা সমাধানের চেষ্টা চলছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশও নানা তৎপরতা চালাচ্ছে।
এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল শুক্রবার দুপুরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফোন করেন জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি-মুন। সম্প্রতি হয়ে যাওয়া তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অনিয়মের কথা জাতিসংঘ জানতে পেরেছে মন্তব্য করে মহাসচিব প্রধানমন্ত্রীকে জানান, সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে সংস্থার সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি-মুনের টেলিফোন বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন মোড় তৈরি করতে পারে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন। ২০১৩ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো সফল না হলেও এবার সফল হবেন বলে মনে করছেন তাঁরা।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘এবার আলোচনা ফলপ্রসূ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। কারণ দুই নির্বাচনের মধ্যে একটা পার্থক্য আছে, সেটা হলো ৫ জানুয়ারি কিন্তু সব দল অংশ নেয়নি। তবে এবার সিটি নির্বাচনে নিয়েছে। এই নির্বাচনে দেখা গেছে, একটি পক্ষ নির্বাচন বয়কট করার পরে অনিয়ম শুরু হয়েছে। তাই যদি হয়ে থাকে, তাহলে যে কাঠামোর মধ্যে নির্বাচন হয়েছে, সে কাঠামোতে বদল আনতে হবে। এ ক্ষেত্রে তারানকোর জন্য কিছুটা সুবিধা হবে অন্য ধরনের ফর্মুলা আনতে।’
তবে অধ্যাপক ইমতিয়াজ মনে করেন, ‘সরকার হয়তো শুরুতে রাজি হবে না। কিন্তু সবাই যেহেতু বলছে, তাকে একসময় রাজি হতেই হবে। আমি বারবারই বলছি, জনগণের সম্পৃক্ততা ছাড়া হয়তো বেশ অনেকটা সময় ক্ষমতায় থাকা যায়, কিন্তু দীর্ঘদিন থাকা যায় না। কারণ রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ কখনোই জনবিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার মতো কোনো কাজ করবে না। স্বাভাবিকভাবেই সরকার চাইবে, তাদের যেন একটা পপুলার ম্যান্ডেট থাকে। তাই পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটবে বলে আশা করি।’
আলোচনায় কোনো সমাধান না হলে দেশে সামরিক হস্তক্ষেপের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের শুনানিতে যে আলোচনা উঠেছে, সে প্রসঙ্গে ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘ইতিহাস দেখে মনে হয় যে, রাজনৈতিক দলগুলো যখন পেরে ওঠে না, তখন বিভিন্ন ফোর্স আসে। তবে যে-ই আসুক, ঘুরেফিরে জনগণের সম্মতি নিতেই হবে। সামরিক অভ্যুত্থানের আশঙ্কা তো সব সময়ই থাকে। তবে এগুলো কোনো সমাধান নিয়ে আসে না। কারণ ওই যে, একসময় না একসময় জনগণের কাছে ফিরে যেতেই হবে। তা না হলে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে।’
‘আর তা ছাড়া রাজনীতিবিদরা তো দেশে থাকার জন্য বা দেশের উন্নতি করার জন্যই রাজনীতি করে থাকেন। তাঁরাও তো সমাধানের ব্যাপারে যথেষ্ট সজাগ। এক মাস আগেও কেউ আশা করেনি যে মেয়র ইলেকশন হবে। যদিও এটা ত্রুটিপূর্ণভাবে শেষ হয়েছে, কিন্তু নির্বাচনটা তো শেষমেশ হয়েছে,’ যোগ করেন অধ্যাপক ইমতিয়াজ।
চট্টগ্রামের ইস্ট ডেলটা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও অর্থনীতিবিদ ড. সিকান্দার খান বলেন, ‘জঙ্গিবাদী দেশ হতে সময় লাগবে। কারণ, দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের কারো স্বার্থেই জঙ্গিবাদ কাম্য নয়। সে ক্ষেত্রে জঙ্গিবাদকে দুই দল এনকারেজ করবে এটা বিশ্বাস করা কঠিন। আর সেনাবাহিনী কেন আসবে? এখন সেনাবাহিনী যে অবস্থায় আছে, তাতে তাদের এসব করার কোনো কারণ নেই বা সেই ইচ্ছা আছে বলেও মনে হচ্ছে না। তবে এ রকম পরিস্থিতি চলতে থাকলে দেশে আমরা একটা ভয়ানক ল’লেসনেসের (নৈরাজ্যের) মধ্যে পড়ে যেতে পারি।’
তবে জাতিসংঘের উদ্যোগকে স্বাগত জানাতে বললেন অর্থনীতিবিদ ড. সিকান্দার খান। তিনি বলেন, ‘এখন যে সংকটটা চলছে, সেটা আরো ঘনীভূত হবে বলে মনে হচ্ছে। তবে শেষটা কেমন হবে তা তো আর পরিষ্কার করে দেখা যায় না। এটুকু বোঝা যাচ্ছে যে, এভাবে চলতে থাকলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটবে। এরই মধ্যে বিশ্লেষকরা বলছেন, শেয়ারবাজারে বেশ দরপতন হয়েছে, এই ইনডিকেটরগুলো তো ভালো না। তবে যেমনই হোক জাতিসংঘের এই উদ্যোগকে রাজনৈতিক দলগুলোর স্বাগত জানানো উচিত।’
তবে তারানকোর আলোচনার মাধ্যমে সব ঠিক হয়ে যাবে এমনটা মনে করেন না রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক। জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব তারানকোর প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এটা তো আকস্মিক নয়। সেই ১৯৮০ সাল থেকেই দেশের একশ্রেণির বুদ্ধিজীবী ও সুশীলসমাজের প্রতিনিধিরা ক্ষমতায় আসতে বিশেষ করে পশ্চিমা দূতাবাসগুলোতে দৌড়াদৌড়ি করে আসছেন। একবার কমনওয়েলথ সেক্রেটারি বাংলাদেশে এসেছিলেন। এক মাস পাঁচদিন ধরে আলোচনা করেও তিনি কোনো সমাধান করতে পারেননি। আমি মনে করি, এসব করে আরো খারাপ অবস্থা সৃষ্টি হবে।’
বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে সংশোধনী না আনতে পারলে পরিস্থিতির উত্তরণ সম্ভব নয় বলেও মনে করেন প্রবীণ এই অধ্যাপক। তিনি বলেন, ‘আসলে বাংলাদেশের রাজনীতির অবস্থা যে খুব খারাপ, তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে বাইরের বিভিন্ন দেশ ও জাতিসংঘের এসব কথা থেকে। এসব টেলিফোন, চিঠি বা আলোচনা থেকে অবস্থার উন্নতি হয়ে যাবে তা মনে করার কোনো কারণ নেই। কারণ দেশের রাজনৈতিক দলগুলো যদি ভেতর থেকে ভালো না হয়, তাহলে এ পরিস্থিতি থেকে কোনোভাবেই উত্তরণ সম্ভব নয়। দেশে গণতন্ত্রের চর্চা বাড়ানো এবং রাজনৈতিক চরিত্র উন্নত করা দরকার। তাহলেই বাংলাদেশের পরিস্থিতিতে পরিবর্তন আসবে।’
বিশিষ্ট এই শিক্ষাবিদ বলেন, ‘পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে আমাদেরই চেষ্টা করতে হবে। নতুন নেতৃত্ব আনতে সাধারণ মানুষকে চাপ দিতে হবে। সেটা আওয়ামী লীগ বা বিএনপি থেকেও আসতে পারে। তবে দেশে মধ্যবিত্তদের যে ছোট ছোট সংগঠনগুলো আছে, শ্রমিকদের যে সংগঠনগুলো আছে, তাদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে চাপ দিতে হবে। সমস্যা হলো, এই চাপ দেওয়ার কাজগুলো চলে গেছে সিভিল সোসাইটির দখলে। পশ্চিমা দেশগুলোর পক্ষ থেকে সিভিল সোসাইটি চাপ দিচ্ছে। ভারতেরও একটা চাপ আছে। তবে এসব দিয়ে হবে না। আমাদের উন্নতির জন্য দরকার নতুন রাজনৈতিক নেতৃত্ব। শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে ছাড়া চলবে না, এই বদ্ধমূল ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে হবে।’
‘ছোট ছোট সংগঠন যদি ঐক্যবদ্ধ হয়ে নতুন নেতৃত্বের জন্য চাপ সৃষ্টি করতে পারে, তাহলে দেশের রাজনীতি ভালোর দিকে এগোবে। মোটকথা জাতির মধ্যে ঐক্য আনতে হবে। কারণ বিভিন্নভাবে ধীরে ধীরে জাতির মধ্যকার এই ঐক্যটা নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। এটা পশ্চিমা শক্তিগুলো তাদের নিজেদের কর্তৃত্ব বজায় রাখার প্রয়োজনে করেছে,’ বলেন অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক। তিনি আরো বলেন, ‘আমরা নামে স্বাধীন, কাজে স্বাধীন নই। জাতিসংঘের মেম্বারশিপ পেলেই স্বাধীন হওয়া যায় না। টাকা খরচ করে বুদ্ধিজীবী আর সিভিল সোসাইটিকে কিনে নিয়ে পশ্চিমারা আমাদের একটা বলয়ে ফেলে দিয়েছে। সেখান থেকে আমাদের জাতিকে বের হতে হবে।’
জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার এ প্রয়াসে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকার কথা বললেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী শান্তনু মজুমদার। তিনি বলেন, ‘যে কোনো দেশে সুধী সমাজ থাকলে জনগণের ক্ষমতায়নের সুবিধা হয়। এখন যেমন রাজনৈতিক নেতারা জেনে গেছেন যে, জনগণ তার ক্ষমতা প্রয়োগের মতো অবস্থায় নেই। তাই তাঁরা নিজেদের ইচ্ছামতো কাজ করতে পারছেন। এসব ক্ষেত্রে এই স্বাধীন বুদ্ধিজীবী মহল জনগণকে নিজেদের ক্ষমতা সম্পর্কে বোঝাতে এবং সচেতন করতে কাজ করতে পারেন।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক দেলাওয়ার হোসেন এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে আলাপচারিতায় বলেন, ‘পুরো বিষয়টি সমাধানের দায়িত্ব আসলে রাজনৈতিক দল ও জনগণের। এর আগেও বিভিন্ন সংকটের মুহূর্তে তারাই আন্দোলন করে পরিবর্তন আনতে পেরেছে। এখনো তাদেরই এই সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব নিতে হবে।’
বাংলাদেশের সমস্যা মেটাতে বাইরের বিশ্বের আসলেই তেমন কিছু করণীয় নেই জানিয়ে দেলাওয়ার হোসেন বলেন, ‘আমার কাছে মনে হয়, বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে বহির্বিশ্বের যে আগ্রহ নিশ্চিতভাবেই সেটি এক ধরনের অতিরঞ্জিত ব্যাপার। তবে এটাও ঠিক যে, বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যে সংকট আছে, তাতে হয়তো এই নির্বাচনের কিছুটা গুরুত্ব ছিল। বর্তমানে দেশে যে রাজনৈতিক অবস্থা কন্টিনিউ করছে, সেটাতে আসলে যুক্তরাষ্ট্র-জাতিসংঘসহ বাইরের বিশ্বের ভূমিকা রাখার কোনো সুযোগ নেই। কারণ তারা অনেক চেষ্টা করেছে। বেশি অতীতের দিকে যদি নাও যাই, তারপরও দেখি যে তারা প্রতিবারই ব্যর্থ হয়েছে।’
তবে জাতিসংঘের সম্পৃক্ততা নিয়ে এখনো আশাবাদী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক শান্তনু মজুমদার। তিনি এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আমি মনে করি, জাতিসংঘের কিছু শুভ ভূমিকা এখনো অবশিষ্ট আছে। তাই বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে তাদের এই যে যুক্ত হওয়া, তাকে আমি ইতিবাচক বলেই মনে করি। তবে এ চেষ্টা কতটা ফলপ্রসূ হবে সে ব্যাপারে আমি অনেক কম আশাবাদী। আমাদের যে রাজনৈতিক সমস্যা তা দুর্বোধ্য কোনো সমস্যা নয়, যেটা বাংলাদেশের দলগুলো বা এর নেতারা সমাধান করতে পারেন না। এখানে আসল কথা হলো ক্ষমতায় টিকে থাকা এবং যেকোনো প্রকারে হোক না কেন ক্ষমতায় আসার চিন্তা করা। এ চিন্তার পরিবর্তন করতে হলে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির মানের উত্তরণ ঘটাতে হবে। বিদেশ থেকে কেউ এসে বলবে তারপর সমাধান হয়ে যাবে, বিষয়টা এমন নয়। তবে এই রাজনৈতিক সংস্কৃতির মানের উন্নয়ন ঘটাতে দলীয় বুদ্ধিজীবী কিংবা এনজিও-কেন্দ্রিক সিভিল সোসাইটি কিছু করতে পারবে না। এ জন্য দেশে স্বাধীন বুদ্ধিজীবীদের পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।’
স্বাধীন বুদ্ধিজীবী কারা সে প্রসঙ্গে শান্তনু মজুমদার বলেন, ‘একটা বিষয় খেয়াল করে দেখেন, ১৯৯০ সালের পর থেকে যাঁরা সিভিল সোসাইটির দেবতা হিসেবে গণমাধ্যমে উঠে এসেছেন, তাঁরা কারা? আপনি দেখবেন যাঁদের একটা লম্বা ইতিহাস আছে বাংলা সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করার, সামরিক-বেসামরিক শাসনকাল নিয়ে লেখালেখি করার, তাঁরা দুই দশক ধরে কিছুটা ডার্কে (অন্তরালে) আছেন। আর যাঁরা বিদেশ থেকে ডিগ্রিধারী, একটা সাকসেসফুল ক্যারিয়ার আছে, যাঁরা ভেবেছেন এই সাকসেসফুল ক্যারিয়ার শেষ হওয়ার পর কিছু একটা করতে হবে তাঁরা এসে এখন সিভিল সোসাইটির ধারক ও বাহক হয়ে গেছেন। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির যে অবনমন ঘটেছে, তার ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য এমন এনজিও ডোনার সার্কেলের বাইরে থেকে কথা বলতে পারবেন এমন বুদ্ধিজীবী দরকার। যাঁরা রাজনীতিকে রাজনৈতিকভাবেই বুঝবেন, যাঁরা এই সমস্যার অরাজনৈতিক ও বিরাজনৈতিকভাবে সমাধানের চেষ্টা করবেন।
‘যে যাই করুক গণতন্ত্রে ফিরতেই হবে’
তারানকোর আলোচনা বা সংকট উত্তরণের বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আসলে তারানকো সমাধান করবেন কি না জানি না। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর যে সংকট শুরু হয়েছিল, সে সংকটটা এখনো রয়ে গেছে। অনেকে ভেবেছিলেন, মেয়র ইলেকশনের মাধ্যমে হয়তো সংকট কেটে যাবে। তবে সংকট তো কাটেইনি বরং আরো ঘনীভূত হয়েছে। একটা জিনিস বোঝা যাচ্ছে যে, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের যে মডেল তৈরি করা হয়েছিল, সে ফর্মুলায় নির্বাচন করতে মনে হয় না বিরোধী দল রাজি হবে। আবার আগের কেয়ারটেকার সরকারের সিস্টেমও ফিরিয়ে আনা সম্ভব না। অর্থাৎ এখন একটা তৃতীয় ফর্মুলা দরকার। আর সেই ফর্মুলাটা যাঁরা রাজনীতি করেন, তাঁরা নিয়ে আসবেন কি না তা বোঝা যাচ্ছে না।’
সব সরকারই চেষ্টা করে ক্ষমতায় থাকার। তবে সেটাতে জনগণের সত্যিকার সম্মতি না থাকলে তা একসময় ভেঙে পড়ে মন্তব্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক বলেন, ‘তখন আরো ভয়াবহ অবস্থা হয়। যে যাই করুক, মূল গণতন্ত্রে তাকে ফিরতেই হবে।’
‘বিরোধী দলের কৌশলটাই দেখার বিষয়’
সিটি নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে বিএনপি কী ধরনের আন্দোলনের কৌশল হাতে নেয় সেটাই দেখার বিষয় বলে মনে করেন অধ্যাপক দেলাওয়ার হোসেন। তিনি বলেন, ‘মূলত সমস্যাটা সরকার ও বিরোধী দলের (বিএনপি) মধ্যে। বিএনপি যে রকম নির্বাচন চাইছিল সে রকম একটি নির্বাচন হয়নি। এখন পরবর্তী নির্বাচন কখন হবে বা নির্বাচন নিয়ে সরকারের অবস্থান যাই থাকুক না কেন, সরকার তখনই নির্বাচন দিতে বাধ্য হবে, যখন বিরোধী দলের যে আন্দোলন চলছে, তা ফলপ্রসূ হবে। ফলে এই আন্দোলনের ব্যাপারেই আমার মনে হয়, তাদের বেশ ভাবতে হবে।’
‘তাদেরকেই চাপ সৃষ্টি করার কৌশল সৃষ্টি করতে হবে। অবশ্য এ ক্ষেত্রে বিএনপি বেশ একটা শক্ত অবস্থানে আছে। কারণ বহির্বিশ্বের একটা সমর্থন এই মুহূর্তে তাদের আছে,’ বলেন অধ্যাপক দেলাওয়ার। তিনি আরো বলেন, ‘আসলে দুই পক্ষের কাছেই দুই পক্ষের বিরুদ্ধে বলার মতো অনেক ব্যাপার আছে। ফলে আমি এখানে বহির্বিশ্বের ভূমিকা বা গুরুত্বের কিছু দেখি না। এগুলো আসলে তাদের আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব। এখন দেশে সিটি নির্বাচন-পরবর্তী পরিস্থিতিতে বিরোধী দল কী ধরনের কর্মসূচি দেয় তার ওপরেই অনেক কিছু নির্ভর করছে। আন্দোলন নিয়ে তাদের কৌশলটা কী হয় সেটাই এখন দেখার বিষয়।’
২০১২ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রথম বাংলাদেশ সফরে আসেন জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো। বাংলাদেশে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় সরকারের সঙ্গে সমন্বয় করতে তাঁকে দায়িত্ব দেন বান কি-মুন। এরপর ২০১৩ সালের মে মাসে আবারও বাংলাদেশে আসেন তারানকো। সেবার সফরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে আলাদা বৈঠক করেন তিনি। তবে সেবারও আশানুরূপ কোনো ফলাফল না পেয়েই ফিরে যান তিনি। এরপর একই বছর ডিসেম্বরে পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধিদল নিয়ে আবারও বাংলাদেশে আসেন জাতিসংঘের এই দূত। সেবার ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে সুশীলসমাজসহ আবারও শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি।
অবশ্য বান কি-মুন ও অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর সব ধরনের আলোচনা ও উদ্যোগের পরেও ২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে কোনো সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়নি। এ ছাড়া বিএনপি নির্বাচন বর্জন করলে সে বছর নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। এর পরের বছর অর্থাৎ ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের বর্ষপূর্তির দিনে ঢাকায় সমাবেশ আহ্বান করেন বিএনপির চেয়ারপারসন। সে সমাবেশে যোগ দিতে বাধা দেওয়া হলে পরদিন থেকেই লাগাতার অবরোধের ডাক দেন তিনি। সেই সঙ্গে ছুটির দিন ছাড়া চলতে থাকে হরতাল।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে অবরোধ-হরতালে চলা নাশকতার মধ্যে সংলাপের মাধ্যমে পরিস্থিতির শান্তিপূর্ণ সমাধানের আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে চিঠি দেন বান কি-মুন। সেখানেও তিনি উল্লেখ করেন, প্রয়োজনে আলোচনা শুরু করতে তারানকোর সহায়তাও নিতে পারে বাংলাদেশ।