খননে মিলল হাজার বছরের পুরোনো দুই মন্দির
বাংলাদেশে খোঁজ মিলেছে হাজার বছরের পুরোনো মন্দিরের। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা দিনাজপুরের বোচাগঞ্জে খনন করে মন্দির দুটির সন্ধান পেয়েছেন।
খননকারী দলের পরিচালক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. স্বাধীন সেন জানিয়েছেন, বোঁচাগঞ্জের রণগাঁও ইউনিয়নের বাসুদেবপুরের ইটাকুড়া ঢিবিতে খননের পর সেখানে একটি বৌদ্ধমন্দির খুঁজে পাওয়া গেছে। এটি আনুমানিক অষ্টম-নবম শতাব্দীতে নির্মিত হয়েছিল বলে অনুমান করা যায়। অন্যদিকে, একই উপজেলার ছাতৈল ইউনিয়নের মাহেরপুরে স্থানীয় লোকজনের খননের ফলে একটি স্থাপত্যকাঠামো উন্মোচিত হয়।
ওই স্থাপনাটিকে আনুমানিক খ্রিস্টাব্দ দশম-একাদশ শতকে নির্মিত হিন্দু মন্দির হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে।
সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আর্থিক অনুদানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সৈয়দ মোহাম্মদ কামরুল আহছানের তত্ত্বাবধানে এবং ড. স্বাধীন সেনের পরিচালনায় এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে এই খননকাজ শুরু হয়েছে।
বাসুদেবপুরে সন্ধান পাওয়া মন্দির
বাসুদেবপুরে খনন করে সন্ধান পাওয়া মন্দিরটি অনন্য নির্মাণশৈলীর বলে মন্তব্য ড. স্বাধীন সেন। তিনি বলেন, মূল মন্দিরটি উত্তর-দক্ষিণে ৩০ মিটার আর পূর্ব-পশ্চিমে ৪৫ মিটার পরিমাপের একটি দুই মিটার উঁচু প্লাটফরমের ওপরে অবস্থিত। প্লাবন সমভূমির নরম পলির ওপরে ইটের টুকরা ও মাটি দিয়ে মেঝে তৈরি করে তার ওপরে মাটি ও ইট দিয়ে উঁচু করা হয়েছে। এর ওপরে ২০-৩০ সেন্টিমিটার পুরু একটি মেঝে তৈরি করে কাঠামোটি নির্মাণ করা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় স্থাপনাটি ইটের তৈরি ভিত্তির ওপরে নির্মিত। যদিও খনন এখনো চলমান, তবে এখন পর্যন্ত উন্মোচিত স্থাপনা দেখে অনুমান করা যাচ্ছে যে, মূল স্থাপনাটি পর পর দুটি বেষ্টনী প্রাচীর দিয়ে ঘেরা ছিল। ঢিবির পশ্চিমে ও পূর্বে বেষ্টনী প্রাচীরের বাইরে চারটি বৃত্তাকার ইটনির্মিত কাঠামো পাওয়া গেছে। এগুলো নিবেদন স্তূপ বলে অনুমান করা হচ্ছে। বৌদ্ধ স্থাপত্যে বিশেষ উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য বা পুণ্য লাভ করার জন্য নিবেদন স্তূপ নির্মাণের প্রচলন ছিল তৎকালীন সময়ে। সে কারণে এই মন্দির বৌদ্ধমন্দির হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
খননের সময় বেশ কয়েকটি পোড়ামাটির চিত্রফলক পাওয়া গেছে। এসব পোড়ামাটির চিত্রফলকে উট, মানুষ/বানর, বেজি-সাপের পাশাপাশি দেবতা ও দেবীদের চিত্র দেখা গেছে। একটি ফলক দেখে প্রাচীন দক্ষিণ এশিয়ার শিল্পকলার ওপরে বিশেষজ্ঞ ঐতিহাসিক ক্লদিন বুদজে পিক্রো এটিকে শৈলীগতভাবে খ্রিস্টাব্দ অষ্টম শতক বা তার পরবর্তী সময়ের বলে চিহ্নিত করেছেন। খননে পাওয়া মৃৎপাত্রের টুকরা ও পোড়ামাটির ফলকের শৈলীগত সময়কাল থেকে খননদলের পরিচালক অনুমান করেছেন যে, এই বৌদ্ধমন্দির অষ্টম-নবম শতকে নির্মিত।
খনন দলের সদস্য ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সাবিকুন নাহার সিঁথি বলেন, ‘খননের সময় বিভিন্ন আকারের অসংখ্য পাথরের টুকরা পাওয়া যাচ্ছে। এই পাথরগুলো একসময় ইটের তৈরি স্থাপনারই বিভিন্ন অংশ নির্মাণের জন্য ব্যবহৃত হতো। মন্দিরটি পরিত্যক্ত হওয়ার পর বা পরিত্যক্ত হওয়ার ঠিক আগে স্থাপনাটি কারো দ্বারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল বলে মনে হচ্ছে।’
‘পরিত্যক্ত হওয়ার পরের পর্যায়ে স্থাপনাটি ব্যবহারকারীরা বিভিন্ন অংশের ইট খুঁড়ে তুলে নিয়ে পুনরায় ব্যবহার করেছে। পরবর্তী সময়ে ভেঙে পড়া ইটের দেয়ালে আগের ধ্বংসপ্রাপ্ত পাথরের খণ্ড ব্যবহার করে সংস্কার করা হয়েছিল।
তবে নতুন অধিবাসীরা ধর্মীয় উদ্দেশ্যে কাঠামোটি ব্যবহার করত কি না সে ব্যাপারে সন্দেহ আছে বলে জানিয়েছেন পিএইচডি গবেষক ও দলের সদস্য আবির বিন কায়সার। খনন শেষে বিশ্লেষণের পর স্থাপনাটির জীবনবৃত্তান্ত সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য জানা যাবে,’ যোগ করেন সিঁথি।
এখানে খনন ও ড্রইংয়ের কাজ আরো এক মাস চলবে। এরপর স্থাপনাটি সম্পর্কে আরো বিশদ তথ্য জানা যাবে।
তবে পরবর্তী ব্যবহারকারীদের সংস্কার এবং সাম্প্রতিক সময়ে স্থানীয় প্রভাবশালী গোষ্ঠী ঢিবির মাটি ও ইট কেটে নিয়ে যাওয়ার কারণে পুরো স্থাপনাটি সম্পর্কে সঠিক ও নির্ভুল ধারণা পাওয়া সম্ভব হবে না বলে মনে করছেন খননদলের আরেক সদস্য সোহাগ আলী।
মাহেরপুরের হিন্দু মন্দির
ছাতৈল ইউনিয়নের মাহেরপুরে আইনুল ইসলাম একটি ঢিবির মাটি কাটার পর সেখানে একটি স্থাপনা দেখতে পান। পরে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুর রউফ মণ্ডলকে জানালে তাঁরা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এই খননদলের পরিচালক ড. স্বাধীন সেনকে জানান। স্থাপনাটি পরিষ্কার করার পর এটিকে একটি হিন্দু মন্দির বলে শনাক্ত করেন ড. স্বাধীন সেন।
মন্দিরটি মূলত তিনটি ভাগে বিভক্ত। মূল কাঠামো গঠন করেছে একটি ইটের তৈরি নিরেট আয়তাকার প্লাটফরম সদৃশ কাঠামো যার মাপ ২.৩৮ মিটার ও ৩.২৬ মিটার। এটির পূর্ব দিকে যুক্ত রয়েছে একটি কক্ষ যার মাপ ৩.১৫ মিটার ও ৩.২০ মিটার। হিন্দু মন্দিরের গঠন অনুসারে নিরেট স্থাপনাটি ছিল গর্ভগৃহ। পূর্ব ভারতীয় মন্দির স্থাপত্যের ধরন বিবেচনা করে এর উপরিকাঠামো দেউল/শিখর আকৃতির ছিল বলে অনুমান করা হচ্ছ।
স্বাধীন সেন জানান, ভূমিনকশার দিক থেকে কিছুটা আলাদা হলেও ভারতের পশ্চিম বাংলার বাঁকুড়ার বহুলড়ার সিদ্ধেশ্বর মন্দিরের সঙ্গে এর সাদৃশ্য রয়েছে। ওই মন্দিরের সাথে তুলনা করেই মন্দিরের শিখরের গঠনের কথা অনুমান করা যায়। পশ্চিম দিক ছাড়া মন্দিরটির তিন দিকেই বেষ্টনী প্রাচীরের প্রমাণ পাওয়া গেছে। স্থানীয় মানুষজন খোঁড়ায় মন্দিরটির রূপান্তর বোঝা সম্ভব হবে না। তবে এর আগে দিনাজপুরের নবাবগঞ্জের চক জুনিদে প্রায় একই রকম একটি মন্দির একই দল খনন করেছিল। প্রাপ্ত মৃৎপাত্রের টুকরা ও মন্দির নির্মাণশৈলি পর্যালোচনা করে মন্দিরটির সময়কাল নবম-দশম শতক বলে ধারণা করা যায়।
উক্ত মন্দিরটি বাংলার আদি মধ্যযুগীয় মন্দির স্থাপত্যের একটি অনবদ্য উদাহরণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। আকারে ছোট মন্দিরটি সংরক্ষণ করাও সহজতর হবে বলে খননকারী দলের শিক্ষকরা মনে করেন। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে বলেও জানিয়েছেন ড. স্বাধীন সেন।
উল্লেখ্য, এর আগে ২০১২-১৩ সালে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের একটি দল অধ্যাপক সৈয়দ মোহাম্মদ কামরুল আহছান ও স্বাধীন সেনের পরিচালনায় ও বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অর্থায়নে বোচাগঞ্জ উপজেলায় প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ পরিচালনা করে। ওই জরিপে ১২২ টি বিভিন্ন সময়ের প্রত্নস্থান চিহ্নিত ও নথিভুক্ত করা হয়।
বর্তমানে দুই জন শিক্ষক, ১০ জন শিক্ষার্থী, মহাস্থানগড় থেকে আসা ১৫ জন অভিজ্ঞ খনন শ্রমিক এবং ১৮ জন স্থানীয় শ্রমিক খননকাজে অংশ নিচ্ছেন। দলের পরিচালক জানান বর্ষাকাল আসার আগ পর্যন্ত অর্থ সংস্থান থাকলে তারা আরো একটি প্রত্নস্থানে খনন পরিচালনা করতে ইচ্ছুক।
বেশির ভাগ প্রত্নস্থান নষ্ট হয়ে যাওয়ায় টিকে থাকা অমূল্য কয়েকটি নিদর্শন পরিকল্পিতভাবে খনন না করলে অচিরেই অতীতের সমৃদ্ধ বরেন্দ্র অঞ্চলের মানুষের ও বসতির ইতিহাস জানা অসম্ভব হয়ে পড়বে বলেও মনে করেন প্রত্নতত্ত্ববিদরা।