মাহবুব ফিরলেন মৃত্যুপুরী থেকে

Looks like you've blocked notifications!
মালয়েশিয়ায় অপহরণের শিকার মাহবুবের ওপর নির্যাতন করে দুর্বৃত্তরা। ছবি : এনটিভি

‘গহিন বনে খালের পানিতে বুক পর্যন্ত নামিয়ে রাখা হয়। দিনের পর দিন না খেয়ে ওভাবে বুক পানিতে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। খেতে চাইলে কেবল পানি খেতে দেওয়া হতো। আর মারধর তো ছিলই। অথচ কান্নার শব্দ বন পেরিয়ে কোথাও যেত না।’ 

এভাবেই নিজের অভিজ্ঞতার কথা শোনান মাহবুব আলম। মালয়েশিয়ায় কাজ করতে গিয়েছিলেন তিনি। গত ২৮ নভেম্বর অপহরণের শিকার হন মাহবুব। বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার পুলিশের দক্ষতায় প্রাণ নিয়ে দেশে ফিরতে পেরেছেন তিনি। গত ১ ডিসেম্বর মালয়েশিয়ার পাহাং এলাকার একটি বন থেকে মাহবুবকে উদ্ধার করা হয়। গতকাল শনিবার রাত ১২টায় মাহবুব বাংলাদেশে ফিরে আসেন।

আজ রোববার র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব) সাংবাদিকদের সামনে হাজির করে মাহবুবকে। 

যেভাবে অপহরণের শিকার
২০০৭ সালে বৈধ ভিসা নিয়েই মালয়েশিয়ায় কাজ করতে যান মাহবুব। সেখানে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে তিনি ‘ক্লিনার’ হিসেবে কাজ করতেন। গত বছর দুয়েক আগে সর্বশেষ মাহবুব বাংলাদেশে এসেছিলেন। তাঁর বাড়ি ভোলার চর আইচা থানার দক্ষিণ চর আইচা গ্রামে। চার ভাইয়ের মধ্যে তিনি সবার ছোট। 

মাহবুব জানান, মালয়েশিয়ার পাহাং জেলার কুনতা থানা এলাকার একটি বাসায় তিনি ভাড়া থাকতেন। গত ২৬ নভেম্বর মাহবুব কাজ শেষ করে নিজের বাসায় ফিরে আসেন। রাত আনুমানিক ১১টার দিকে তাঁর বাসায় দুজন মালয়েশিয়ান ব্যক্তি এসে জানান যে তাঁরা পুলিশের লোক। তাঁদের সঙ্গে মাহবুবকে থানায় যেতে হবে। তখন মাহবুব তাঁদের সঙ্গে বাসার নিচে নেমে এসে দেখেন একটি গাড়ি দাঁড়ানো। সেই গাড়িতে তাঁকে তোলার পর তিনি গাড়ির ভেতরে আরো চারজন বাংলাদেশিকে দেখতে পান।

মাহবুবকে প্রথমে একটি বনে নিয়ে দুই ঘণ্টা আটকে রাখা হয়। এরপর তাঁর হাত-পা বেঁধে ওই বন থেকে অন্য একটি বনে নিয়ে যান চার বাংলাদেশি। আর পুলিশ পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া ব্যক্তিরা মাহবুবকে বনে পৌঁছে দিয়েই চলে যান। 

এরপর রাত দেড়টার দিকে জুলহাস নামক এক ব্যক্তি আসেন মাহবুবের কাছে। তিন লাখ টাকা দাবি করেন আর এ জন্য দেশে ফোন করতে বলেন। প্রথমে মাহবুব অস্বীকার করেন। আর এরপরই শুরু হয় মারধর। এক পর্যায়ে জ্বলন্ত সিগারেট দিয়ে মাহবুবের হাতে ছ্যাঁকা দেওয়া হয়। 

তখন মাহবুবের বড় ভাই সবুজকে ফোন করেন অপহরণকারী চক্রের সদস্য জুলহাস। ফোন করে জুলহাস হুমকি দেন টাকা না দিলে তাঁর ভাইকে মালয়েশিয়ায় মেরে ফেলা হবে। তখন তাঁরা মাহবুবের সঙ্গে সবুজের কথা বলান মোবাইলে। সবুজ টাকা জোগাড় করার জন্য দুই দিনের সময় চান। 

ফোনে ভাইকে পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন মাহবুব। তিনি বলতে থাকেন, ‘তোমরা ওদের টাকা দিয়ে দাও, নইলে ওরা আমাকে মেরে ফেলবে ভাই। আমাদের বাপ-মা কেউ কেউ বেঁচে নেই, তোমরা ছাড়া আমাকে কে বাঁচাবে। আমার বউ-ছেলেদের তোমরা দেখে রেখো।’ 

মাহবুব আরো জানান, ওই বনে আরো ১১ জন বাংলাদেশি ছিল। তাদের অবস্থাও তার মতো। 

যেভাবে আটক হলো চক্রের সদস্যরা
গত ২৭ নভেম্বর কুমিল্লা থেকে রিফাত নামে এক লোক মাহবুবের ভাই সবুজকে ফোন করে বলেন বিকেলের মধ্যে টাকা দেওয়ার জন্য। নইলে মাহবুবকে মালয়েশিয়ায় মেরে ফেলা হবে। এরপর বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে মগবাজার এলাকার ইনসাফ হাসপাতালের সামনে এসে রিফাত এক লাখ টাকা নিয়ে যান। আর বাকি টাকা দ্রুত দিয়ে দেওয়ার জন্য এক দিনের সময় বেঁধে দেন। 

এরই মধ্যে সবুজ র‍্যাব ৩-এ গিয়ে এ ব্যাপারে একটি লিখিত অভিযোগ দাখিল করেন। 

র‍্যাব বাকি দুই লাখ টাকা নেওয়ার জন্য অপহরণকারী দলের সদস্যদের মালিবাগ ফ্লাইওভারের নিচে আসতে বলে। সেখানে টাকা নিতে এলে দুলাল (৪০) ও রুপচাঁদ আলী (২৫) নামে দুজনকে আটক করে র‍্যাব। পরে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের দূতাবাসের মাধ্যমে তারা মালয়েশিয়ান পুলিশের সহায়তায় মাহবুবকে উদ্ধার করে দেশে ফিরিয়ে আনে। আর এই ঘটনায় যুক্ত আলী আহমেদ রিফাতকেও আটক করে।  

মাহবুবের ছোট ভাই নাজমুল হক সবুজ এনটিভি অনলাইনকে জানান, তাঁর ভাই গতকাল রাত ১২টায় বাংলাদেশে এসেছে। বিমানবন্দর থেকে তাঁকে প্রথমে একটি হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। মাহবুবের সারা শরীরে অনেক আঘাতের জখম রয়েছে। 

মো. মনির নামের মাহবুবের অপর এক ভাই জানান, তাঁরা এখন মাহবুবকে ভালো একটি হাসপাতালে চিকিৎসা করাবেন। আর এই ঘটনায় যুক্ত দোষীদের শাস্তির দাবি করেন মাহবুবের তাঁরা।