যুদ্ধদিনের দুই বন্ধু
একাত্তরে আর দশজন মুক্তিযোদ্ধার মতোই প্রশিক্ষণ শেষে জমায়েত হওয়া ক্যাম্পে তাঁদের পরিচয়। ভারতের মিজোরাম রাজ্যের দেমাগ্রিতে বসেছিল ওই ক্যাম্প। কেউই জানতেন না কাউকে। কীভাবেই বা জানা সম্ভব? একজন তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, অন্যজন রাজশাহী ক্যাডেট কলেজের। কিন্তু নিয়তির কী পরিহাস! একই মাটির দুই তরুণ ঠিকই শিকড়ের কাছেই মিলিত হলেন। তাঁদের একজন শামসুদ্দীন আহম্মেদ পেয়ারা, অন্যজন মনীষ দেওয়ান।
ক্যাম্পের প্রাথমিক পরিচয়ের একপর্যায়ে জানা গেল, দুজনের জন্মই পার্বত্য শহর রাঙামাটিতে। বাবার চাকরিসূত্রে কর্মস্থল রাঙামাটিতেই জন্ম হওয়া শামসুদ্দীন রাঙামাটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৬৬ সালে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, তিনি তৎকালীন কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের স্ট্যান্ড করা ছাত্র। আর শামসুদ্দীনের দুই বছরের ছোট মনীষ তখন রাজশাহী ক্যাডেট কলেজের ছাত্র। সেই যুদ্ধের মাঠে পরিচয়। নেতা তাঁদের শেখ ফজলুল হক মনি এবং ভারতীয় নামকরা সেনা কর্মকর্তা জেনারেল সুজান সিং ওভান।
রাঙামাটির বরকল উপজেলার সীমান্তবর্তী ভারতের মিজোরামের দেমাগ্রি সীমান্তের বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের অন্যতম যাঁরা রাঙামাটি শহরে হানা দিতেন, তাঁদেরই টিম মেম্বার এ দুই বীর মুক্তিযোদ্ধা। তাঁরা ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর রাঙামাটি শহরে প্রবেশ করে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেছিলেন।
স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরও শামসুদ্দীন আর মনীষের বন্ধুত্ব অটুট। এ যেন প্রকৃতির বেঁধে দেওয়া বিরল এক সম্পর্ক।
সাবেক সেনা কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) মনীষ দেওয়ান বলেন, ‘যুদ্ধের মাঠে আমাদের পরিচয়, স্বাধীন-সার্বভৌম একটি দেশের স্বপ্নই আমাদের কাছাকাছি এনেছিল। প্রথম পরিচয়ে তো জানতামই না, দুজন একই মাটির সন্তান। যুদ্ধের যেসব স্মৃতি, একসঙ্গে কাটানো দুঃসহ সেসব সময়, আর ইতিহাস এখনো মধ্যরাতে বুকের ভেতর ঠিকই জ্বালা ধরায়, কষ্ট দেয়। তবুও ৪৫ বছর ধরে আমাদের বন্ধুত্ব, সম্পর্ক, হৃদ্যতায় এতটুকুনও চিড় ধরাতে পারেনি।’
শামসুদ্দীন আহম্মেদ বলেন, ‘আপনারা জেনে আশ্চর্য হবেন, গত ৪৫টি বছর ধরেই প্রতিটি বিজয় দিবসেই যেখানেই থাকি, মনীষ আমাকে ফোন করেছে। ফোন করেই শুধু বলেছে, বন্ধু মনে পড়ে সেই (১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১) রাতের কথা? আমার চোখ ভিজে আসে, মনীষেরও। কিছুক্ষণ ফোনের দুপ্রান্তে অশ্রুপাত দুই বন্ধুর। এটাই হয়তো জীবন। যুদ্ধক্ষেত্রেই আমাদের পরিচয়, যুদ্ধই নির্মাণ করেছে আমাদের বন্ধুত্ব, যুদ্ধ শেষের স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশই আমাদের ঠিকানা। এটাই হয়তো জীবন।’
‘কিছু মানুষ চিরকালই নিজের শ্রেষ্ঠ সময়টার কাছেই পড়ে থাকে। আমি কিংবা মনীষও জীবনের শ্রেষ্ঠতম সেইসব দিনের কাছেই পড়ে আছি। অবশ্য এর চেয়ে বড় কোনো চাওয়া কিংবা পাওয়া নেই আর। আমাদের ভালোবাসার, কষ্টে, ত্যাগের বাংলাদেশ ভালো থাকুক।’
শামসুদ্দীনের চোখ ভিজে আসে। পাশে বসে থাকা মনীষও চশমার ফ্রেম সরিয়ে চোখ আড়ালে লুকান। কিন্তু এক দৃঢ়তা দুই অসম সাহসী বীরযোদ্ধার চোখে-মুখে, যাঁরা ৪৫ বছর আগে দুর্গম পাহাড়ে উড়িয়েছিলেন স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা।