সিরিজ বোমা হামলা : ১৮ বছর আত্মগোপনের পর তুহিন রেজা গ্রেপ্তার
নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) নিজেদের সক্ষমতা জানান দিতে ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশের ৬৩ জেলায় একযোগে সিরিজ বোমা হামলা চালায়। মাত্র আধা ঘণ্টার ব্যবধানে রাজধানীর ৩৪ স্থানসহ দেশের ৪৫০টি স্থানে প্রায় ৫০০ বোমার বিস্ফোরণ ঘটায় জেএমবি। ২০০৫ সালে ঝিনাইদহ জেলায় ওই সিরিজ বোমা হামলার ঘটনায় জড়িত সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে ১৮ বছর পর গ্রেপ্তারের দাবি করেছে র্যাব। গ্রেপ্তার ব্যক্তির নাম তুহিন রেজা। গতকাল বৃহস্পতিবার (২২ জুন) রাতে রাজধানীর তেজগাঁও রেলগেট এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। র্যাবের দাবি, তিনি একটি বেসরকারি টেলিভিশনের ভিডিও এডিটর হিসেবে কাজ করছিলেন।
আজ শুক্রবার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে সংস্থাটির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান র্যাব-৩-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ।
আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে মুন্সীগঞ্জ বাদে রাজধানী ঢাকাসহ ৬৩টি জেলায় এই হামলা করা হয়। রাজধানীর হাইকোর্ট, সুপ্রিমকোর্ট, জেলা আদালত, বিমানবন্দর, মার্কিন দূতাবাস, সচিবালয়, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়, প্রেসক্লাব ও সরকারি-আধা-সরকারি বিভিন্ন স্থাপনায় এই বোমা হামলা চালায় জঙ্গিরা। আধা ঘণ্টার ব্যবধানে চালানো এ সিরিজ বোমা হামলায় দুজন নিহত এবং দুই শতাধিক আহত হয়। একযোগে এই হামলার মাধ্যমে বাংলাদেশে নিজেদের সংঘবদ্ধ উপস্থিতির জানান দেওয়ার চেষ্টা করেছিল জেএমবির সদস্যরা।’
র্যাব-৩-এর অধিনায়ক আরও বলেন, ‘সিরিজ বোমা হামলায় সারা দেশের মতোই ঝিনাইদহ জেলার ডিসি অফিস, জজ কোর্ট ও পায়রা বন্দরসহ কয়েকটি এলাকায় একই সময়ে একযোগে বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো হয়।এ ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে একটি মামলা দায়ের করা হয়। মামলা নং-১৭। মামলাটি স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল ঝিনাইদহে বিচার শেষে অভিযুক্ত ২১ জনের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ রাষ্ট্রপক্ষ প্রমাণ করতে সক্ষম হলে আসামিদের সবাইকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। কিন্তু, আসামিরা মৃত্যুদণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করলে আদালত তাদের অভিযোগপত্র পুনঃবিবেচনায় নিয়ে ২০০৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৪ জন আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডসহ ৫০ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ড দেন এবং সাতজন আসামিকে খালাস দেন।’
আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ জানান, পরবর্তীতে সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামিদের গ্রেপ্তারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপরতা শুরু করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে এখন পর্যন্ত সাজাপ্রাপ্ত ১৪ জন আসামির মধ্যে ১২ জন আসামিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গ্রেপ্তার করেছে। পলাতক দুই জনের মধ্যে ওই মামলার ১০ নম্বর আসামি ও যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত দীর্ঘ ১৮ বছর ধরে পলাতক জেএমবির সদস্য তুহিন রেজাকে বৃহস্পতিবার রাতে তেজগাঁও রেলগেট এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত সাত নম্বর আসামি মোহন এখনও পলাতক রয়েছেন।’
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাতে আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ আরও জানান, গ্রেপ্তার তুহিন ২০০৪ সালে জেএমবির ঝিনাইদহ সদর শাখায় সদস্য হিসেবে যোগদান করেন। এরপর থেকে তিনি এ শাখার লিফলেট তৈরি, লিখিত প্রচার-প্রচারণার সম্পাদনা, গোপন ও নাশকতমূলক খবরাখবর আদান-প্রদান, বিভিন্ন ভিডিও এডিটিংয়ের মাধ্যমে তৈরি করা বিভ্রান্তিমূলক প্রামাণ্যচিত্র দিয়ে তরুণদের পথভ্রষ্ট করতেন। ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট হামলাকে কেন্দ্র করে পূর্ববর্তী দীর্ঘ সময় ধরে তারা হামলার নীল নকশা সাজায়। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৭ আগস্ট ভোর থেকেই অন্যান্য হামলাকারীদের সঙ্গে তুহিন আদালত চত্বরের আশপাশে অবস্থান নেয় এবং হামলার সময় সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। এলোপাতাড়ি বোমা হামলার পর তারা বিভিন্ন দিকে দৌড়ে পালিয়ে যায়।
আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘তুহিন ১৭ আগস্ট বোমা হামলার পর ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে ঝিনাইদহ সদরে জঙ্গি ক্যাম্পে কিছুদিন গা ঢাকা দিয়ে থাকেন। মামলা ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হলে কিছুদিনের মধ্যে পালিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। এখানে তিনি প্রথমে যাত্রাবাড়ী, পরবর্তীতে খিলগাঁও, উত্তরা, মহাখালীসহ বিভিন্ন জায়গায় স্থান পরিবর্তন করে বাস করতেন। ২০২১ সাল থেকে তিনি তেজগাঁও এলাকায় একটি বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস করতে থাকেন। সেখান থেকেই গোপন সংবাদের ভিত্তিতে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। পলাতক অবস্থায় তিনি একটি বেসরকারি টেলিভিশনে ভিডিও এডিটিংসহ বিভিন্ন সফটওয়্যারভিত্তিক কাজের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করতেন।’