বাংলাদেশ রেল : ঝিক ঝিক ঝিক ‘দুর্নীতির গাড়ি’

Looks like you've blocked notifications!
ঢাকার কমলাপুর থেকে পদ্মা সেতু দিয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা জংশনে পরীক্ষামূলক ট্রেন চালু হয় গত বৃহস্পতিবার। ছবি : স্টার মেইল

যে বস্তু পাওয়া যায় ১৯ হাজার টাকায়, রেল কর্তৃপক্ষ তা কিনেছে তিন লাখ টাকায়। আবার ৬৫ হাজার টাকার মেশিন কেনা হয়েছে নয় লাখ ৬৫ হাজার ৬০০ টাকায়। এমন ঘটনায় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, রেলের চাকার মতো কি দুর্নীতির চাকাও ঘুরছে?

২০১৯ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশ রেলওয়ের ১০টির দুর্নীতির খাত চিহ্নিত করেছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। কমিশন এ নিয়ে রেলওয়ের সঙ্গে তখন বৈঠকও করেছিল। তারা ওই খাতগুলোতে দুর্নীতি কমানোর তাগিদ দিয়েছিল। দুর্নীতি কমাতে মোট ১৫টি সুপারিশ করেছিল তারা। তখন রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন সংবাদমাধ্যমকে বলেছিলেন, দুদকের প্রতিবেদন আমলে নিয়ে তারা ব্যবস্থা নেবেন। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি এতদিনেও। কোনো সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হয়নি।

দুদক তখন রেলে যে ১০টি খাতে দুর্নীতির কথা বলেছিল, সেগুলো হলো—রেলওয়ের অধীনে ওয়াগন, কোচ, লোকোমোটিভ ক্রয় ও সংগ্রহ; স্টেশন সিগনালিং ব্যবস্থার পুনর্বাসন ও আধুনিকায়ন; ডাবল লাইন, সিঙ্গেল লাইন, ডুয়েল গেজ ট্র্যাক নির্মাণ; রেলওয়ের ভূমি অধিগ্রহণ, যাত্রীবাহী ক্যারেজ পুনর্বাসন নিলামে যন্ত্রাংশ বিক্রয়, রেলওয়ের অধীনে ওয়ার্কশপগুলো ও স্লিপার ফ্যাক্টরি কার্যকর না করে আমদানির মাধ্যমে অনিয়ম। এছাড়া নিয়োগ ও টিকিট বিক্রিতেও অনিয়মের কথা বলা হয় তখন।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘বাংলাদেশ রেলওয়েকে একটি প্রকল্প নির্ভর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়েছে। এই প্রকল্প প্রণয়ন থেকে বাস্তবায়ন সবখানেই দুর্নীতি। কেনাকাটার ক্ষেত্রে বড় ধরনের দুর্নীতি হয়। দীর্ঘদিন ধরে রেলওয়ে একটা দুর্নীতর কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। রেলে দুর্নীতির কালো বিড়ালের থাবা দীর্ঘদিন ধরে আছে। ফলে রেলে লাখো কোটি টাকা বিনিয়োগ করলেও কোনো উন্নয়ন হয় না।’

দুদক দুর্নীতির যে খাতগুলোর কথা বলেছে, সেসব খাতে কোনো দুর্নীতি কমেনি, বরং বেড়েছে। রেলওয়ের আগে নেওয়া প্রকল্পগুলোর খরচ এখন বেড়ে যাচ্ছে। কোনো কোনো প্রকল্পের খরচ ১০ গুণও বেড়েছে। ২০১০ সালে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) অনুমোদন হওয়ার সময় চট্টগ্রামের দোহাজারি থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার ও রামু থেকে মিয়ানমারের কাছে ঘুমধুম পর্যন্ত ১২৮ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছিল এক হাজার ৮৫২ কোটি টাকা। এই প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ার আগেই ২০১৬ সালে বিস্তারিত নকশা প্রণয়ন শেষে প্রকল্প ব্যয় এক লাফে বেড়ে দাঁড়ায় ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা। নির্মাণ শুরুর আগেই প্রকল্প ব্যয় বেড়ে যায় ১০ গুণ বা ১৬ হাজার ১৮২ কোটি টাকা । অস্বাভাবিক ব্যয় বাড়ানোর পরও এই প্রকল্পে নিম্নমানের কাজ ও নানান অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।

পরিবহণ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান বলেন, ‘পার্বতীপুর ও পাহাড়তলীতে রেলের যে কারখানাগুলো আছে, সেই কারখানায়ই রেলের কোচ তৈরি করা যেত, তৈরি করা যেত যন্ত্রাংশ। ভারী লোকোমোটিভ মেরামত করা যেত। কিন্তু দুর্নীতি করার জন্য ওই কারখানাগুলোর সক্ষমতা নষ্ট করা হয়েছে বা সক্ষমতা তৈরি করা হয়নি। এখন সব কিছুই বাইরে থেকে কিনতে হয়, যাতে ব্যাপক দুর্নীতি হয়।’

ড. হাদিউজ্জামান বলেন, ‘রেলের উন্নয়নের নামে যে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করা হয় তা-ও রেলের আয় বাড়ানোর জন্য নয়, যা করলে আয় বাড়বে তা করা হয় না। রেলকে লাভজনক করতে হলে পণ্য পরিবহণে নজর দিতে হবে, সেদিকে কোনো বিনিয়োগ নেই। রেলের আয় বাড়ানোর কোনো উদ্যোগ নেই। তাদের মানসিকতাই হলো সাবসিডি দিয়ে চলা এবং বিভিন্ন প্রকল্প নিয়ে দুর্নীতি করা। রেলের এখন টপ টু বটম দুর্নীতি।’

রেলওয়ের কেনাকাটায় দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে হরহামেশাই। মহা-হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় গত জুনে যে প্রতিবেদন দিয়েছে, তাতে দেখা যায় বাজারের চেয়ে ১৫-২০ গুণ বেশি দাম দিয়ে রেলওয়ে নানান যন্ত্রপাতি কিনছে। রেলগাড়ি লাইনচ্যুত হলে চাকা তুলতে ব্যবহৃত ‘লিফটিং জ্যাক’ বাজারে কিনতে পাওয়া যায় ১৯ হাজার টাকায়, কিন্তু রেল তা কিনেছে তিন লাখ টাকায়। একইভাবে লোহার পাত ছিদ্র করার ৬৫ হাজার টাকার একটি ড্রিলিং মেশিন কেনা হয়েছে নয় লাখ ৬৫ হাজার ৬০০ টাকায়। বাজারমূল্যের চেয়ে আট গুণ বেশি দামে কেনা হয়েছে লোহার পাত কাটার যন্ত্র ‘কাটিং ডিস্ক’। এইভাবে কেনাকাটায় কোটি কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে রেলওয়ের। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রেলওয়ের ১৫টি কার্যালয়ের কেনাকাটায় সরকারের মোট ১১ কোটি ১৮ লাখ ৮১ হাজার ৪২৬ টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। 

রেলের সর্বশেষ প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০-২১ সালে সংস্থাটির লোকসান বেড়ে দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ১০০ কোটি টাকা। লোকসানের সঙ্গে সঙ্গে কমেছে রেলওয়ের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতাও। ২৫ বছর আগে যেখানে এক টাকা আয় করতে গিয়ে ৯৬ পয়সা ব্যয় করতে হতো সংস্থাটিকে, সেখানে বর্তমানে এক টাকা আয় করতে গিয়ে রেলওয়ের ব্যয় হচ্ছে দুই টাকা ৭৮ পয়সা। ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছররেও সংস্থাটিতে উদ্বৃত্ত ছিল প্রায় সাড়ে ১৮ কোটি টাকা।

গত আড়াই দশকে মোটা অঙ্কের বিনিয়োগ পেয়েছে রেল খাত। ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত বাস্তবায়ন করা হয় ৮৩টি উন্নয়ন প্রকল্প। এতে ব্যয় হয় ২০ হাজার ৬৬৬ কোটি টাকা। বর্তমানে চলমান রয়েছে ৩৪টি প্রকল্প, যেগুলোর ব্যয় এক লাখ ৪১ হাজার ৫০৫ কোটি টাকা। এত ব্যয়ের বিপরীতে উল্টে লোকাসানের পথে হাঁটছে রেলওয়ে।

এ বিষয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘দেশের মানুষ রেলে চড়তে চায়। আমাদের আশপাশের দেশেও রেল জনপ্রিয়। কিন্তু একদা লাভজনক রেলের লোকসান এখন বাড়ছেই। এর মূল কারণ দুর্নীতি।’

ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘রেলকে কেন্দ্র করে এই দুর্নীতির সিন্ডিকেট অনেক দিনের। এখানে দুর্নীতি হয়, অপচয় হয়, অনিয়ম হয়। এগুলো বন্ধ করা গেলে রেল এমনিতেই লাভজনক হতো।’

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক আরও বলেন, ‘রেলের এই দুর্নীতির সঙ্গে যারা রেলে কাজ করেন শুধু তারাই নয়, অনেক উপরের লোকজন জড়িত। ফলে বড় বড় দুর্নীতর ঘটনা প্রকাশ হলেও আমরা দৃষ্টান্তমূলক কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখিনি। আর ব্যবস্থা না নেওয়ায় দুর্নীতিও কমে না, বরং বাড়ে।’

এসব ব্যাপারে বক্তব্য জানতে রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তাকে পাওয়া যায়নি।