খানজাহান আলী (র.)-এর মাজার সংলগ্ন দীঘির মাদ্রাজি কুমিরের মৃত্যু
বাগেরহাটের খানজাহান আলী (র.)-এর মাজা সংলগ্ন দীঘিতে থাকা দুটি মাদ্রাজি কুমিরের একটি মারা গেছে। আজ বৃহস্পতিবার (১৯ অক্টোবর) সন্ধ্যায় প্রশাসনের নির্দেশে দীঘি থেকে কুমিরের মরদেহটি উপরে ওঠানো হয়।
এর আগে দুপুরের দিকে দীঘির দক্ষিণ-পশ্চিম পাশে পুরুষ (বড়) কুমিরটির মরদেহ ভাসতে দেখে স্থানীয়রা। খবর পেয়ে পুলিশ, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, উপজেলা প্রশাসন, মাজার কর্তৃপক্ষ, খাদেমসহ দর্শনার্থীরা মাজার প্রাঙ্গণে ড়িড় করে। কুমিরের মৃত্যুর কারণ জানতে ময়নাতদন্ত করা হবে বলে জানিয়েছেন প্রানিসম্পদ অধিদপ্তর, খুলনার বিভাগীয় পরিচালক ডা. লুৎফর রহমান।
এর আগে ২০২১ সালের ১২ জুন এই কুমিরটি বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। তখন সুন্দরবন পূর্ব বনবিভাগের করমজল বন্যপ্রাণী প্রজননকেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আজাদ কবির ও স্থানীয় খাদেমদের সহায়তায় কুমিরটিকে উপরে তোলা হয়েছিল। প্রাণিসম্পদ বিভাগের পক্ষ থেকে কুমিরটিকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছিল। তারপর থেকে মোটামুটি সুস্থ ছিল মাদ্রাজি পুরুষ এ কুমির। স্থানীয় ফকিরদের দাবি, কুমিরের একটি চোখ অন্ধ ছিল।
এদিকে কুমিরের মৃত্যু নিয়ে খাদেম, ফকির ও স্থানীয়দের পক্ষ থেকে বিভিন্ন অভিযোগ উঠেছে। চেতনানাশক ও ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দীর্ঘদিন এক পাড়ে আটকে রাখার অভিযোগ করেছেন কয়েকজন।
দারা ফকির নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি অভিযোগ করেন, এখানে কুমিরকে ঘুমের বড়ি খাইয়ে বশ করা হয়। শেষ পাঁচ ছয় মাস ধরে এই কুমির দীঘির দক্ষিণ-পশ্চিম পাড়ে এফ এম মোস্তফা ফকিরের বাড়ির পুকুরে ছিল। দীর্ঘদিন কুমির এক জায়গায় থাকে না। ওষুধ দিয়ে তারা ব্যবসার জন্য কুমির আটকে রেখেছিল।
মাজারের প্রধান খাদেম ফকির শের আলী বলেন, ‘কুমিরগুলো আসলে দীঘির প্রাণ ছিল। কিন্তু কিছু অসাধু ব্যক্তি এই কুমিরকে টাকা কামানোর মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতেন। কুমিরকে আটকে রেখে দর্শনার্থী ও ভক্তদের কাছ থেকে টাকা নেওয়া হতো। ছয়-সাত মাস ধরে কুমিরটিকে একজনের বাড়ির পুকুরে আটকে রাখা হয়েছিল। এত দিন ধরে কুমির এক জায়গায় থাকে না। আমরা এ বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে অভিযোগও করেছি।’
এই কুমির মেরে ফেলা হয়েছে। কুমিরের মৃত্যুর সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার দাবি করেন এই খাদেম।
প্রানিসম্পদ অধিদপ্তরের খুলনা বিভাগীয় পরিচালক ডা. লুৎফর রহমান বলেন, ‘কুমিরটি তিন বছর আগেও একবার অসুস্থ হয়েছিল। তখন আমরা চিকিৎসা দিয়েছিলাম। এরপর মোটামুটি ভালো ছিল। আমরা কুমিরের মরদেহের ময়নাতদন্ত করব। মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা করব।’
বাগেরহাট মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কে এম আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘খবর পেয়ে আমরা ঘটনাস্থলে এসেছি। মাদ্রাজ থেকে আনা দুটি কুমিরের পুরুষ কুমিরটি মারা গেছে। এখানে খাদেমদের অভিযোগ রয়েছে, আমরা তদন্ত করছি। এ ছাড়া কুমিরের ময়নাতদন্ত করা হবে। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
সুলতানী শাসন আমলে খ্রিস্টীয় ১৪ শতকের প্রথম দিকে হজরত খান জাহান আলী (র.) বাগেরহাটে ‘খলিফতাবাদ’ নগর বা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। এ সময় তিনি এই অঞ্চলে ৩৬০ দীঘি খনন করেন। এর মধ্যে সব থেকে বড় ‘ঠাকুরদীঘি’। যে দীঘির পাড়ে তাঁর সমাধি রয়েছে। এই দীঘিতে তিনি দুটো মিঠাপানির প্রজাতির কুমির ছেড়ে ছিলেন। যাদের নামছিল ‘কালাপাহাড়’ ও ‘ধলাপাহাড়’। খানজাহান আলী (র.)-এর মৃত্যুর পর মাজারের খাদেম ও ভক্তরা ওই কুমির দুটিকে নিয়মিত খাবার দিতেন। দীর্ঘদিন পর্যন্ত ওই কুমির যুগলের বংশধরেরা এখানে বসবাস করে আসছিল। কিন্তু বিভিন্ন সময় মারা যাওয়ায় কালাপাহাড় ও ধলাপাহাড়ের বংশধরেরা শঙ্কায় পড়ে। সর্বশেষ ২০০৬ সালে দীঘির কুমির ‘কালাপাহাড়’ এবং ২০১৫ সালে ‘ধলাপাহাড়’ মারা যায়। ধলাপাহাড়ের চামড়া বাগেরহাট জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে।
এরই মধ্যে মাজারে কুমিরের ঐতিহ্য ধরে রাখতে ২০০৫ সালে ভারতের মাদ্রাজ ক্রোকোডাইল ব্যাংক থেকে ছয়টি কুমির এনে মাজারের দীঘিতে ছাড়া হয়। নিজেদের মধ্যে মারামারি করে দুটি কুমির মারা যায়। দুটি কুমির সুন্দরবনের করমজলে পাঠানো হয়। অপর দুটি কুমির এত দিন এই মাজারে ছিল। এদের মধ্যে নারী কুমিরটি কয়েকবার ডিম দিলেও, কোনো বাচ্চা হয়নি। পুরুষ কুমিরটির অস্বাভাবিক মৃত্যুতে নারী কুমিরটি সঙ্গীহারা হয়ে পড়েছে।