আন্দোলন-সংগ্রামে বিএনপির ২০২৩

Looks like you've blocked notifications!

বছরজুড়ে আলোচনায় ছিল দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে পাল্টাপাল্টি যুক্তি, মিটিং-মিছিলে বক্তব্য ছিল তুঙ্গে। এরইমধ্যে ‘একদফা’ দাবি নিয়ে আন্দোলনে নামে সরকারবিরোধী দলগুলো। বর্তমান সরকারের পদত্যাগের পাশাপাশি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে চলমান তাদের কর্মসূচি। দফায় দফায় হরতাল, অবরোধের পর বিএনপি ও তাদের সমমনারা শুরু করে অসহযোগ কর্মসূচি। বছরের শেষ দিনগুলোতে তারা তিন দিনের লিফলেট বিতরণ কর্মসূচি পালন করছে। নতুন বছরে প্রত্যাশা পূরণের কথা জানিয়েছেন দলটির নেতারা। যদিও এই কর্মসূচিকে রাষ্ট্রবিরোধী বলে আখ্যা দিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তবে, অন্যান্য বছরের তুলনায় নির্বাচনি বছরের পুরোটাজুড়ে তারা ছিল আন্দোলন-সংগ্রাম কর্মসূচিতে।

বছরজুড়ে বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতাদের বক্তব্যে ছিল সরকার পতনের ডাক। তাদের ডাকে বিক্ষোভে, সামাবেশে, মিছিলে নেতাকর্মীদের উপস্থিতিও ছিল উল্লেখযোগ্য। তাদের অনেকেই এখন কারাগারে। অনেকের হয়েছে সাজাও। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দাবি, নানা মামলায় তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যদিও বিএনপির দাবি, মিথ্যা মামলায় এসব গ্রেপ্তার ও সাজা দেওয়া হচ্ছে।

আন্দোলনের প্রস্তুতি

২০২৩ সাল নির্বাচনি বছর ধরে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জানুয়ারি থেকেই সরকারের পতনের আন্দোলনে সরব হয়ে ওঠে বিএনপি। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত দলের সাংগঠনিক সক্ষমতা নিয়ে চলে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা। আর এই প্রক্রিয়া শুরু হতে দেখা যায় ২০২২ সালের অক্টোবরে। ওই অক্টোবরে সারাদেশে সাংগঠনিক বিভাগগুলোতে ধারাবাহিক সমাবেশ কর্মসূচি করে বিএনপি, যা শেষ হয় একই বছরের ১০ ডিসেম্বর রাজধানীর গোলাপবাগ মাঠের সমাবেশের মধ্য দিয়ে। সেই সমাবেশ থেকে সংসদ বিলুপ্ত, সরকারের পদত্যাগ এবং নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবিসহ ১০ দফা ঘোষণা করে দলটি।

এক দফা

নানা কর্মসূচির মধ্যে এগোতে থাকা বিএনপি বছরের মাঝামাঝিতে আসে এক দফায়। গত ১২ জুলাই রাজধানীর নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ থেকে ঘোষণা হয় সরকার পতনের এই এক দফার ডাক। এক দফা ঘোষণায় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের জনগণের ভোটাধিকার হরণকারী বর্তমান ফ্যাসিবাদী, কর্তৃত্ববাদী সরকারের পদত্যাগ ও বিদ্যমান অবৈধ সংসদের বিলুপ্তি, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠন ও নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করে তার অধীনে অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যবস্থা, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ সব রাজবন্দির মুক্তি, মিথ্যা-গায়েবি মামলা প্রত্যাহার, ফরমায়েশি সাজা বাতিল এবং সংবিধান ও রাষ্ট্রব্যবস্থার গণতান্ত্রিক সংস্কারের মাধ্যমে জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি, ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার এক দফা দাবিতে রাজপথে সক্রিয় বিরোধী রাজনৈতিক জোট ও দলসমূহ যুগপৎ ধারায় ঐক্যবদ্ধ বৃহত্তর গণআন্দোলন গড়ে তোলা ও সফল করার লক্ষ্যে এই এক দফা।’ এই সমাবেশে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হয়ে বক্তব্য দেন, যা ছিল দলের নেতাকর্মীদের কাছে চমক। সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের সঙ্গে তার সার্বক্ষণিক যোগাযোগ দলের কর্মসূচিকে বেগবান করেছে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

অন্যান্য দলকে আন্দোলনে সম্পৃক্তকরণ

জুলাইয়ে সরকার পতনের এক দাবির ডাকের পর অন্যান্য রাজনৈতিক দলকে আন্দোলনে সম্পৃক্ত করতে মাঠে নামে বিএনপি। এরপর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিএনপির আন্দোলনের গতিপথেও আসে বৈচিত্র্য। ধীরে ধীরে সক্রিয় হয়ে ওঠে জোট মিত্ররা।  এ সময়ে বিএনপির রাজনীতিতে দৃশ্যপটে আসেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। এরই মধ্যে ঘনিয়ে আসে নির্বাচনের সময়। দিন যত যায়, বিএনপির এক দফার দাবি আরও জোরাল হয়। বিপরীতে চলে দল ভাঙার বহু চেষ্টা-ফিকির। নির্বাচন ঘিরে বিএনপির একাধিক নেতা ভোটে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দেন। তবে, শেষ পর্যন্ত চলতি বছরে বিএনপিতে চূড়ান্ত কোনো ভাঙন দেখা যায়নি।

২৮ অক্টোবরের ঢাকা

গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশ করে বিএনপি। ওইদিন পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের এক পর্যায়ে মহাসমাবেশ পণ্ড হয়ে যায়। পরদিন ২৯ অক্টোবর ঢাকার সব প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচি দেওয়া হয়। একদিন বিরতি দিয়ে ৩১ অক্টোবর থেকে শুরু হয় তিন দিনের অবরোধ। ওই মহাসমাবেশের পরপরই দলটির একাধিক শীর্ষ নেতা বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার হন।  এরমধ্যে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীসহ দলটির বেশ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতাও কারাবন্দির জীবন শুরু করেন। এরপর গ্রেপ্তার এড়াতে আত্মগোপনে চলে যান মাঠে সক্রিয় থাকা অন্য অনেক নেতাকর্মীও।

অবরোধ-হরাতাল, অসহযোগ

বিএনপি ও সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর ২৮ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া কর্মসূচি তফসিল ঘোষণার পর গতি পায়। তারা দফায় দফায় হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি দিতে শুরু করে। ৩১ অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত ১২ দফায় ২৩ দিন অবরোধ এবং চার দফায় পাঁচ দিন হরতাল পালন করে বিএনপি ও সমমনারা। ১৯ ডিসেম্বর সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালনের পর আর কোনো হরতাল কর্মসূচি আসেনি এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত।

এরইমধ্যে ৭ জানুয়ারির ভোট বর্জন করে সর্বসাধারণের প্রতি সরকারকে অসহযোগিতার আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপি। গত ২০ ডিসেম্বর সরকারের পদত্যাগ দাবিতে সারা দেশে এই অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেয় দলটি। একই দিন ২১, ২২ ও ২৩ ডিসেম্বর ঢাকাসহ সারা দেশে গণসংযোগ এবং ২৪ ডিসেম্বর সকাল-সন্ধ্যা অবরোধ কর্মসূচি পালনের ঘোষণা করে তারা। আর ২৬, ২৭ ও ২৮ ডিসেম্বর সারাদেশে গণসংযোগ এবং লিফলেট বিতরণ করে দলটি।

নেতাদের দল পরিবর্তন

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান পদধারীসহ অন্তত ২৫ জন নেতা দল ছেড়ে নির্বাচনে অংশ নেন। সাংগঠনিক ও ভোটের মাঠে এই নেতাদের তেমন গুরুত্ব না থাকলেও দলের ভাইস চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর বীর উত্তম এবং দীর্ঘদিনের আন্দোলনের সঙ্গী বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীককে শেষ পর্যন্ত জোট ছেড়ে চলে যাওয়া আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়।

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার দাবি

সরকার পতনের আন্দোলন জোরদার করার পাশাপাশি বছরজুড়েই দলের চেয়ারপাসন অসুস্থ খালেদা জিয়ার বিদেশে উন্নত চিকিৎসার ইস্যুটিও ছিল বিএনপির আলোচনার কেন্দ্রে। ২০২০ সালের ২৫ মার্চ সরকারের নির্বাহী আদেশে শর্তসাপেক্ষে কারামুক্ত খালেদা জিয়া বর্তমানে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। কখনও কেবিনে আবার কখনও আইসিইউতে রেখে তার চিকিৎসা চলছে। এরই মধ্যে গত ২৫ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের তিনজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ঢাকায় এসে ২৬ অক্টোবর খালেদা জিয়ার অস্ত্রোপচার করেন। বছরের শেষ দিকে তার শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতির খবর আসে। তবে, এই মুহূর্তে বাসায় ফিরতে পারছেন না তিনি। থাকতে হচ্ছে চিকিৎসকদের অবজারভেশনে।