‘সব গেছে যাক, শিশুটাকে যদি আল্লাহ বাঁচিয়ে দিতেন’!

Looks like you've blocked notifications!
আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া শারমিন আক্তারের ছোটবোন সুমাইয়া আহম্মেদ কাজলের আহাজারি। ছবি : এনটিভি

শারমিন আক্তার জামালপুরের ইসলামপুরের শ্বশুরবাড়ি থাকতেন। সেখান থেকে দেড় বছরের ছোট্ট শিশু নাফি হোসেনকে নিয়ে তেজগাঁওয়ের মোল্লাবাড়ি বস্তিতে বাবা-মায়ের কাছে বেড়াতে আসেন গত ৮ জানুয়ারি। ফিরে যাওয়ার কথা ছিল আগামী ১৫ জানুয়ারি, সোমবার।

সে অনুযায়ী গতকাল শুক্রবার জামালপুরগামী ট্রেনের টিকিট কাটা হয়। অপেক্ষা ছিল কেবল সোমবার সকালের। কিন্তু, সোমবার আর তাদের জীবনে আসেনি। তার আগেই শুক্রবার দিনগত গভীর রাতে আগুন লাগে মোল্লাবাড়ি বস্তিতে। সেই আগুনে পুড়ে মারা গেছে নাফি ও শারমিন। মারা যাওয়ার সময় নাফিকে বুকে জড়িয়ে ছিলেন শারমিন।

নাফি আর শারমিনের মৃত্যু যেন কেউ মেনে নিতে পারছে না। বস্তিতে ৩০০ এর মতো ঘর পুড়ে গেছে বলে ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে। কিন্তু, বস্তিতে ও আশপাশে আলোচনা যেন একটাই; শিশু নাফিকে বুকে জড়িয়ে ধরে মারা গেছেন শারমিন। ওই বস্তিতে ৩০ বছর ধরে থাকা মোবারক হোসেন কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, ‘সব গেছে যাক, শিশুটাকে যদি আল্লাহ বাঁচিয়ে দিতেন!’

চারদিকে যখন এ আলোচনা, তখন (শনিবার দুপুরে) শারমিন আক্তারের ছোটবোন নবম শ্রেণির ছাত্রী সুমাইয়া আহম্মেদ কাজলের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। এসব কথা বলতে বলতে সুমাইয়া ফুফিয়ে কেঁদে ওঠেন। সুমাইয়ার এ বর্ণনা শুনে পাশে থাকা বস্তির আরও তিন বাসিন্দা কেঁদে ওঠেন। এ দৃশ্য যেন পোড়া বস্তির পরিবেশ আরও ভারী করে তোলে!

সুমাইয়া আহম্মেদ বলছিলেন, ‘আমাদের ঘর থেকে বের হওয়ার একটাই পথ ছিল। কিন্তু, মানুষের হুড়োহুড়িতে বের হতে পারছিলেন না অনেকে। আবার ওই পথের এক পাশে আগুন লেগে যায়। এ দেখে শারমিন নাফিকে নিয়ে বের হতে চাচ্ছিলেন না। যদি সন্তানের কিছু হয়ে যায়! এসবের মধ্যে আমি বের হয়ে যাই।’

সুমাইয়া আহম্মেদ কাজল বলেন, ‘এর মধ্যে আমাদের ঘরেও আগুন লেগে যায়। তখন আমাদের পাশের একটি ঘরে আগুন ছিল না। সেজন্য, ওই ঘরে নাফিকে রেখে দেয় আমার ভাই আর বোন মিলে। তখন আমার ভাইকে শারমিন বের হয়ে যেতে বলে। কিন্তু, ভাই ওদের রেখে বের হতে চায়নি। তখন শারমিন না-কি ভাইকে বলেছে, ভাই তুই চলে যা। তুই একটা ছেলে, তোর কিছু হলে মা শোকে মারা যাবে। তুই আগে বের হ, আমরা আসতেছি। এ কথা আমার ভাইয়ের কাছ থেকে শুনেছি।’

‘তারপর আমার ভাই বাঁশ বেয়ে টিনের চালের ওপর উঠে লাফ দিয়ে বাইরে চলে যায়। গিয়ে সবাইকে বলতে থাকে, আমার বোন ভেতরে পুড়তেছে। তারে একটু বাঁচান। অনেকে চেষ্টা করছে, কিন্তু আমার বোন আর ভাগ্নেকে আর কেউ বাঁচাতে পারেনি। পরে আমার ভাইকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। সেও আহত হয়েছে। যখন তাদের দুজনের লাশ উদ্ধার করা হয়, তখন নাফিকে কোলে জড়িয়ে ছিল আমার বোন’, যোগ করেন কাজল।

তাদের লাশ তেজগাঁও থানায় রাখা আছে জানিয়ে দুপুরের দিকে কাজল বলেন, ‘গতকাল শুক্রবার বোনের জন্য টিকিট কাটা হয়েছে। সোমবার চলে যাওয়ার কথা ছিল জামালপুর। কিন্তু, আর যেতে পারল না। বেড়াতে এসে কী থেকে কী হয়ে গেল।’

সুমাইয়া আহম্মেদ কাজল আরও বলেন, ‘আমার দুলাভাইয়ের নাম মিজান আহম্মেদ। দুলাভাই ঢাকাতে চাকরি করেন। দুলাভাই এ বস্তিতে থাকেন না। আমার আরেক বোন শায়লা আক্তার চকলেট ফ্যাক্টরিতে চাকরি করেন। সে রাতে ডিউটিতে ছিল। আগুন লাগার সময় আমার বাবা করিম হোসেন আর মা লিপি আক্তারও বাইরে ছিলেন।’

কাজলের দাবি, ‘আমি যতটুকু জানি, চার-পাঁচজনের বেশি লোক মারা গেছে। এখানে ৩০০ এর বেশি ঘর ছিল। সব পুড়ে গেছে। কিচ্ছু নিয়ে বের হতে পারিনি। আমাদের সব শেষ হয়ে গেছে।’

কাজলের সঙ্গে সুর মিলিয়ে ওই বস্তিতে ১৫ বছর ধরে থাকা আব্দুস সালাম বলেন, ‘ফায়ার সার্ভিস শুরুতে চারজনের লাশ বস্তায় করে বের করেন। তাদের আমাদের দেখতে দেওয়া হয়নি।’