তীব্র গ্যাস সংকট, নারায়ণগঞ্জে বন্ধের পথে রপ্তানিমুখী শিল্প-কারখানা

Looks like you've blocked notifications!
নারায়ণগঞ্জে তীব্র গ্যাস সংকটে বন্ধ রয়েছে শিল্প কারখানার উৎপাদন। ছবি : এনটিভি

নারায়ণগঞ্জের রপ্তানিমুখী পোশাক শিল্প তীব্র গ্যাস সংকটে বন্ধ হওয়ার পথে। পোশাক শিল্পে মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে গ্যাস সংকটের কারণে নতুন উদ্যোক্তারা যেমন আস্থা হারাচ্ছেন, তেমনি দুশ্চিন্তায় রয়েছে এই সেক্টরের ৪৫ লাখ শ্রমিক। প্রতিদিন নারায়ণগঞ্জের সিএনজি স্টেশনগুলোতেও দেখা যাচ্ছে যানবাহনের লম্বা লাইন। আবাসিক এলাকাতেও একই চিত্র। গ্যাস না থাকায় গৃহিণীরা রান্নার কাজ সারছেন মাটির চুলা দিয়ে। গ্যাস না থাকায় বিপাকে পরিবহণ চালক ও সিএনজি স্টেশন কর্তৃপক্ষ।

গ্যাসের চাপ শূন্যের কোঠায় নেমে যাওয়ায় শিল্প চেইন ভেঙে পড়াসহ শ্রম অসন্তোষের আশঙ্কা করছেন কেউ কেউ। সেই সাথে বেড়ে গেছে নিটওয়্যার উৎপাদনে কাঁচামালের দাম। ফলে একদিকে শিল্প পরিচালনা ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে, অন্যদিকে সময়মতো রপ্তানি করা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানান রপ্তানিকারকরা। নীট ওয়্যার শিল্প মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিকেএমইএ’র সিনিয়র সহ-সভাপতি মনসুর আহমেদ জানিয়েছেন, পেট্রোবাংলাকে বলা হলে কিছুদিন গ্যাসের প্রেসার পাওয়া গেলেও পরবর্তীতে গ্যাসের প্রেসার নেমে আসে। গ্যাসের সংকট নিরসন করে অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে সরকারের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের প্রতি রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্পে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ দেওয়ার দাবি জানান তিনি।

তিতাস গ্যাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হারুনুর রশিদ মোল্লা জানিয়েছেন, শীত কমে গেলে সাময়িক সংকটের সমাধান হবে আর মার্চ থেকে গ্যাসের সরবরাহ বাড়বে। 

নারায়ণগঞ্জ জেলার পঞ্চবটির বিসিক শিল্প নগরী, সদর, বন্দর, রূপগঞ্জ, সোনারগাঁ, আড়াইহাজারসহ পাঁচটি উপজেলায় দেশের সর্ববৃহৎ রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক শিল্পের গ্যাস নির্ভর প্রায় ১৫০০ পোশাক কারখানা রয়েছে। এগুলোতে কর্মরত আছেন প্রায় ৪৫ লাখ শ্রমিক।

দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে ও কর্মসংস্থান বাড়াতে মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছেন ফতুল্লার পঞ্চবটি এলাকার নারী উদ্যোক্তা ও মাদার কালার লিমিটেডের পরিচালক নাফিসা আলম। সেখানে গিয়ে দেখা যায় গ্যাস সংকটের কারণে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, সময়মতো পণ্য রপ্তানি করতে পারছেন না। নাফিসা আলম বলেন, ‘পোশাক শিল্প হলো বাংলাদেশের উন্নয়নের চাবিকাঠি। আমাদের অনেক শ্রমিক এখানে কাজ করে। যেহেতু গ্যাসের সংকট, খুবই খারাপ অবস্থা এখন। আমাদের এখানে অনেক সময় গ্যাসের প্রেসার জিরো পিএসআই-এ নেমে যাচ্ছে। আমাদের যতগুলো মেশিনারিজ আছে সবগুলোই গ্যাস নির্ভর। গ্যাস কমে যাওয়ার সাথে সাথে মেশিনারিজ রান করা যাচ্ছে না। ক্যাপাসিটি অনুযায়ী বায়ারের যে অর্ডার নেওয়া হচ্ছে সেই অর্ডারগুলো দেখা যাচ্ছে গ্যাস সংকটের কারণে ঠিক সময়ে শিপমেন্ট করা যাচ্ছে না। আমরা সঠিক সময়ে যদি সাপ্লাই দিতে না পারি তখন এয়ার শিপমেন্ট হচ্ছে। যখনই আমাদের এয়ার শিপমেন্ট হয় তখন অনেক বড় ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়।’

নাফিসা আলম আরও বলেন, ‘আমরা উদ্যোক্তা হিসেবে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার ইনভেস্ট করছি। এই ইনভেস্টমেন্ট উঠিয়ে আনতে এবং শ্রমিকদের বেতন ভাতা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এখন এই সময়ে এসে গ্যাস সংকটের কারণে যদি আমরা বিদেশি বায়ার হারাই তাহলে বাংলাদেশের জন্য বিপর্যয় হয়ে দাঁড়াবে। এমন অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। এখন আমাদের টিকে থাকার জন্য গ্যাস সমস্যার সমাধান করা দরকার।’ গার্মেন্টস সেক্টরে যদি সঠিকভাবে গ্যাস সরবরাহ না করা হয় তাহলে দেশের উন্নয়নের জন্য তা অনেক বড় একটি বিপদ বয়ে নিয়ে আসবে বলেও  জানান তিনি।

ফতুল্লার কাঠেরপুল এলাকার আজাদ রিফাত ফাইবার্স প্রাইভেট লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠানে গিয়ে দেখা যায় গ্যাসের প্রেসার জিরো পিএসআই, গ্যাসের বদলে পাচ্ছে বাতাস। টন টন কাপড় পড়ে আছে ডাইং মেশিনের সামনে। কখন গ্যাস আসবে তা জানা নেই। এই প্রতিষ্ঠানের প্রথম সারির কর্মকর্তা মামুন খান, আরিফুজ্জামান ও সোহেল চৌধুরী জানান, গ্যাস না থাকার কারণে শত শত টন কাপড় ডাইং করা যাচ্ছে না। লাইনে গ্যাস নেই, গ্যাসের বদলে পাওয়া যাচ্ছে বাতাস। কিছুক্ষণের জন্য গ্যাস আসলেও হঠাৎ চলে যায় তখন ডাইং করা অবস্থায় কাপড় নষ্ট হয়ে যায়। পরবর্তীতে রি ডাইং করতে হয় তখন উৎপাদন খরচ আরও বেড়ে যায়।

গ্যাস সংকটে আরও দুরাবস্থা নারায়ণগঞ্জ জেলার প্রতিটি সিএনজি স্টেশনগুলোতে। শত শত যানবাহন গ্যাসের জন্য লম্বা লাইন ধরে আছে সিএনজি স্টেশনগুলোতে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে গ্যাস না থাকায় বিপাকে পড়ছেন যানবাহন চালকসহ সিএনজি স্টেশন কর্তৃপক্ষ। ঢাকা নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের জেলখানার পাশে অবস্থিত মাস সিএনজি ওয়ার্কশপ লিমিটেডের ইঞ্জিনিয়ার কাজী রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের সিএনজি স্টেশনে বর্তমানে গ্যাসের প্রেসার জিরো পিএসআই। মেশিন ছাড়লে গ্যাস পাওয়া যায় না। গত এক সপ্তাহ ধরে এই গ্যাসের সমস্যা।’

বুনন শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইয়ের তথ্য মতে এই শিল্প-কারখানাগুলোতে জড়িয়ে রয়েছে প্রায় ৪৫ লাখ শ্রমিকের জীবন। তবে গ্যাস সংকটের কারণে দিনে দিনে বন্ধ হওয়ার পথে অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান।

বিকেএমইএর সিনিয়র সহ-সভাপতি মনসুর আহমেদ বলেন, ‘গ্যাস সংকট এভাবে চলতে থাকলে আরও প্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা যেমন রয়েছে তেমনি লাখ লাখ শ্রমিক বেকার হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।’ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সরকার তথা সংশ্লিষ্টদের নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ করার আহ্বান জানান তিনি।

বিকেএমইএ পক্ষ থেকে আরও বলা হয়, গ্যাস না থাকায় একটি ছোট কারখানায় প্রতিদিন তিন থেকে চার লাখ টাকার ডিজেল কিনতে হচ্ছে। মাঝারি শিল্প কারখানায় ছয় থেকে সাড়ে আট লাখ টাকা এবং প্রথম সারির কারখানায় ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকার ডিজেল কিনতে হচ্ছে। এতে ডিজেল কিনে কারখানা পরিচালনায় রীতিমতো অসম্ভব হয়ে উঠছে বলে জানানো হয়। 

এদিকে গত বেশ কয়েকদিন ধরে নারায়ণগঞ্জের আবাসিক এলাকা ভূইয়ারবাগ, মাসদাইর, ইসদের, খানপুর, জালকুড়ি, সিদ্ধিরগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকায় গ্যাস না থাকায় মাটির চুলা দিয়ে রান্নার কাজ করছেন গৃহিণীরা।