রোহিঙ্গাদের জন্য সহায়তা কমায় রেকর্ড
বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য ২০২৩ সালে যে সহায়তা চাওয়া হয়েছিল, তার মাত্র ৫০ শতাংশ পাওয়া গেছে৷ এই অবস্থায় বুধবার ২০২৪ সালের জন্য ৮৫২ দশমিক ৪ মিলিয়ন ডলার চেয়েছে জাতিসংঘ৷
বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, বিশ্ব পরিস্থিতি বিশেষ করে ইউক্রেন যুদ্ধ ও গাজা পরিস্থিতির কারণে সামনে সহায়তা আরও কমতে পারে৷ কারণ এখন মানবিক সহায়তা ভাগ হয়ে যাচ্ছে৷ এতে বাংলাদেশের ওপর আর্থিক চাপ তৈরি হতে পারে৷ অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য সংকটও তৈরি হতে পারে৷
২০২৩ সালে জাতিসংঘ ও দাতারা রোহিঙ্গাদের জন্য ৮৭৬ মিলিয়ন ডলার চেয়েছিল৷ কিন্তু পাওয়া গেছে মাত্র ৪৪০ মিলিয়ন ডলার৷ ২০১৭ সাল থেকে কোনো বছরই প্রত্যাশিত সহায়তা পাওয়া যায়নি৷ তবে গত বছর রীতিমতো ধস নেমেছে৷ ২০১৭ সালে প্রত্যাশিত সহায়তার ৭৩ ভাগ, ২০১৮ সালে ৭২, ২০১৯ সালে ৭৫, ২০২০ সালে ৫৯, ২০২১ সালে ৭৩ এবং ২০২২ সালে ৬৯ ভাগ সহায়তা পাওয়া গেছে৷ আর ২০২৩ সালে তা অর্ধেকে নেমে এসেছে৷ অর্থাৎ ২০২৩ সালে সহায়তা কমায় রেকর্ড হয়েছে৷
এদিকে, ২০২৪ সালের জন্য ৮৫২ দশমিক ৪ মিলিয়ন ডলার চেয়েছে জাতিসংঘ৷ বুধবার সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় এই সহায়তা চাওয়া হয়৷ আর্থিক সংকটের কারণে গত বছর থেকেই রোহিঙ্গাদের জন্য দৈনিক রেশন ৩৩ শতাংশ কমানো হয়৷ একজন রোহিঙ্গার জন্য এখন প্রতি মাসে আট মার্কিন ডলারের খাদ্য সহায়তা দেওয়া হয়৷ গত বছরের শুরুতে মাথাপিছু মাসে ১২ মর্কিন ডলারের খাদ্য সহায়তা দেওয়া হতো৷ সেটা মার্চে করা হয় ১০ মার্কিন ডলার৷ জুনে করা হয় আট মার্কিন ডলার৷
জাতিসংঘ বলছে, রেশনের কাটছাঁট প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গার জীবনে প্রভাব ফেলবে৷
গত বছর জুনে বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গোয়েন লুইস বলেছিলন, ‘আমরা অত্যন্ত উদ্বিগ্ন, বিশ্ব খাদ্য সংস্থা বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের খাদ্য সাহায্য কমাতে বাধ্য হচ্ছে৷ এতে তাদের স্বাস্থ্য ও পুষ্টির ফলাফল হবে ভয়াবহ৷ নারী, শিশু ও সবচেয়ে নাজুক মানুষেরা বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে৷’
‘বাংলাদেশ অর্থনৈতিক চাপে পড়তে পারে’
বাংলাদেশের নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান বলেন, ‘এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক চাপের মুখে পড়তে পারে৷ শুধু রোহিঙ্গা নয়, মিয়ানমারে এখন যে পরিস্থিতি চলছে, তাতে অন্য জাতিগোষ্ঠীর লোকও বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে পারে৷ তখন সব দিক দিয়েই বাংলাদেশের জন্য সংকটের কারণ হবে৷’
আ ন ম মুনীরুজ্জামান আরও বলেন, ‘প্রথমে ইউক্রেন যুদ্ধ, এরপর গাজা পরিস্থিতির কারণে রোহিঙ্গাদের ওপর থেকে ফোকাস সরে গেছে৷ ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে এখন ইউরোপে অনেক নতুন শরণার্থী৷ এরপর গাজায় যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, সেই কারণে রোহিঙ্গাদের প্রতি মনোযোগ আরও কমেছে৷ মধ্যপ্রাচ্যেও সংকট বেড়ে গেছে৷’
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী একটা হিউম্যানিটিরিয়ান ফেটিগ তৈরি হয়েছে৷ ফলে আমাদের এখান থেকে দৃষ্টি সরে যাচ্ছে৷ সম্পদ ভাগ হয়ে যাচ্ছে৷ আমাদের ব্যর্থতা হলো আমরা কূটনৈতিকভাবে বিষয়টি সব সময় আলোচনার কেন্দ্রে রাখতে পারিনি৷ আমাদের উচিত হবে বিশ্বের বিভিন্ন ফোরামে অব্যাহতভাবে বিষয়টি তুলে ধরা৷’
মিয়ানমারে বাংলাদেশের সাবেক সামরিক অ্যাটাশে মেজর জেনারেল (অব.) মো. শহীদুল হক বলেন, ‘সহায়তা কমে যাওয়া অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা খাদ্য সংকটে পড়বেন৷ তারা প্রয়োজনীয় খাদ্য না পেলে অপুষ্টির শিকার হয়ে নানা রোগে আক্রান্ত হবেন৷ বিশেষ করে বৃদ্ধ, গর্ভবতী রোহিঙ্গা নারী ও শিশুরা ক্ষতির মুখে পড়বেন বেশি৷ এ ছাড়া তাদের স্বাস্থ্যসেবাসহ আরও অনেক বিষয়ে কাটছাঁট হবে৷’
শহীদুল হক বলেন, ‘এরফলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার আশঙ্কা আছে৷ বিশেষ করে কক্সবাজার অঞ্চলে এই রোহিঙ্গারা নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়তে পারে৷ তাদের খাদ্য না থাকলে তারা ক্যাম্পে এবং ক্যাম্পের বাইরে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়তে পারেন৷’
সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বলেন, ‘২০১৭ সাল থেকে কখনোই কাঙ্ক্ষিত সহায়তা পাওয়া যায়নি৷ আর নতুন নতুন ঘটনা পুরনো ঘটনার গুরুত্ব কমিয়ে দেয়৷ এখন ইউরোপেই ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সাত মিলিয়ন শরণার্থী৷ স্বাভাবিক কারণে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের নজর সেদিকেই বেশি থাকবে৷ তাই হয়েছে৷ তারপর গাজা আরেকটি নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে৷’
এম হুমায়ুন কবির আরও বলেন, ‘আমাদের সমস্যা এখন দুই রকম৷ রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো এবং তাদের জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তা কমে যাওয়া৷ আমাদের দুইটি নিয়েই এখন কাজ করা দরকার৷ কারণ আন্তর্জাতিক নানা সংকটের কারণে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর বিষয়টি নিয়েও এখন আর তেমন কথা হচ্ছে না৷ মিয়ানমারের যা পরিস্থিতি তাতে এখন হয়তো সেখানে আমাদের পক্ষে প্রতিনিধি পাঠানো সম্ভব নয়৷ তারপরও তৃতীয় দেশের মাধ্যমে চেষ্টা করা উচিত৷ আর রাখাইন যদি পুরোটা আরাকান আর্মির দখলে চলে যায়, তাহলে কী করণীয় তা-ও ভাবতে হবে৷ তখন তাদের সঙ্গে আমরা কীভাবে যোগাযোগ করব, তা এখনই ভাবা দরকার৷’