অত্যাবশকীয় সংস্কার ও নির্বাচন প্রক্রিয়াকে পাশাপাশি রাখতে হবে
অত্যাবশকীয় সংস্কার ও নির্বাচন প্রক্রিয়াকে পাশাপাশি রাখার দাবি জানিয়েছে রাজনীতিক, শিক্ষার্থী ও সুশীল সমাজের নেতারা। তারা অন্তর্বর্তী সরকারকে তাদের নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করার আহ্বান জানিয়েছেন। একইসঙ্গে দেশ সংস্কারের পাশাপাশি নির্বাচনি প্রক্রিয়া দ্রুত সময়ে নেওয়ার তাগিদ দেন।
আজ মঙ্গলবার (৩ সেপ্টেম্বর) বিকেলে গুলশানের একটি হোটেলে ‘গণতন্ত্র উত্তরণে অন্তর্বতীকালীন সরকার তথা রাজনৈতিক দলের ভূমিকা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এসব কথা বলেন। এ বৈঠকের আয়োজন করে মিলিনিয়াম বিশ্ববিদ্যালয় ও খান ফাউন্ডেশন।
দি মিলিনিয়াম বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ারপার্সন, বোর্ড অফ ট্রাস্টিজ অ্যাডভোকেট রোখসানা খন্দকারের সঞ্চালনায় গোলটেবিল বৈঠকে আরও বক্তব্য দেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান, বিএনপি যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী, বাংলাদেশ বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধরণ সম্পাদক সাইফুল হক, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, দি হাঙ্গার প্রজেক্টের কান্ট্রি ডিরেক্টর বদিউল আলম মজুমদার, গণফোরামের সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুরু, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক মহাসচিব নূর খান লিটন, সাংবাদিক আাশরাফ কায়সার, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ফেমার সাবেক সভাপতি মুনিরা খান, মায়ের ডাকের সমন্বক সানজিদা ইসলাম তুলি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সহ-সভাপতি তানিয়া রব, ড. শায়ন্ত সাখাওয়াত প্রমুখ।
ড. আবদুল মঈন খান বলেন, আজকে সরকার যৌক্তিক সময় দাবি করছে। যদিও প্রেক্ষাপটটা এমন যে, যৌক্তিক সময় নির্ধারণ করা কঠিন। তিনি বলেন, দেশের বিষয়ে যেকোনো সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব এখন বর্তমান সরকারের। মানুষ জবাব চাইছে বিএনপির কাছে। কারণ, মানুষ মনে করছে, বিএনপি সরকারে চলে এসেছে। মানুষের এই পারসেপশনের বাস্তবতা অস্বীকার করা যাবে না।
আবদুল মঈন খান বলেন, এই সরকারকে ম্যান্ডেড দিয়েছে ছাত্র-জনতা। ৫৩ বছর পরে ছাত্র-জনতা যা করছে, তা ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে, যা কোনো রাজনৈতিক দল করতে পারেনি। এর কারণও যৌক্তিক। কারণ, আমরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে বিদায় দিতে চেয়েছিলাম। আমরা ১৭টি বছর জীবন দিয়েছি, আর ছাত্ররা ১৭ দিনে এক হাজার ৭০০ জীবন দিয়েছে। এ কারণেই তারা সফল হতে পেরেছে। তিনি আরও বলেন, ছাত্র-জনতা যা পেরেছে, তা রাজনৈতিক দল করতে পারেনি। কারণ, ছাত্রদের কোনো পিছুটান ছিল না। গণতন্ত্র পুনরুপান্তর করতে সুনির্দিষ্ট কিছু সংস্কার প্রয়োজন। সংস্কার ও নির্বাচনকে পাশাপাশি নিয়ে যেতে হবে। এক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের উচিৎ হবে, পুলিশ প্রশাসন ও নির্বাচন কাঠামো পরিবর্তন করে নির্বাচনের প্রস্তুতি গ্রহণ করা।
শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের সময় জনগণই দেবে, অন্য কেউ নয়। এই সরকারের প্রধান দায়িত্ব একটা সুন্দর সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা। তিনি বলেন, বর্তমান সরকারের উচিৎ এই মুহূর্তে নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণা করা। কারণ, কোনো পাইপ লাইন ছাড়া যেকোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে দেশ চালানো অসম্ভব।
বিএনপির এই সিনিয়র নেতা শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, একটি কুচক্রি মহল ছাত্রদের রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করানোর ষড়যন্ত্র করছে; এটা হতে দেওয়া যাবে না। এসব ব্যাপারে অন্তবর্তী সরকারকে কঠিন পদক্ষেপ নিতে হবে।
সাইফুল হক বলেন, আমাদের লড়াইটা ছিল ১৬ বছরের, আর ছাত্র-জনতার আন্দোলন শেষ হলো ৩৬ দিনে। ১৬ বছরে আমরা অনেক অত্যাচার নির্যাতন সহ্য করে সরকার পতনের যে প্রেক্ষাপট তৈরি করে দিয়েছিলাম, ছাত্ররা এসে শেষ ধাক্কা দিয়েছে। তিনি বলেন, সরকার বলছে সংস্কার করবে, এটা তাদের একার কথা নয়, সকল রাজনৈতিক দলের একই দাবি। এই মুহূর্তে হাসিনার বিদায়ে খুশি হলে চলবে না, ৩১ দফা বাস্তবায়নে সকলে মিলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। তিনি বলেন, ‘সরকার বলছে সংস্কার হলে নির্বাচন, এটা খবই হতাশার কথা। সংস্কারের পাশাপাশি নির্বাচনের প্রস্তুতিও জরুরি।
মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ছাত্র-জনতার জয় পুরো দেশকে ঐক্যবদ্ধ করেছে। এখন পুরোপুরি গণতন্ত্র ফেরাতে সংস্কার জরুরি। তিনি বলেন, দেশে একটা নির্বাচন ভালোভাবে করতে হলে প্রশাসনকে সাজিয়ে জনবান্ধব পুলিশ গড়ে তুলতে হবে। পুলিশ, সিভিল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন সব পরতে পরতে পরিবর্তন করা নতুন করে সাজাতে হবে।
সুব্রত চৌধুরী বলেন, ফ্যাসিবাদের পতনের পরে আমরা এখন স্বস্তির মধ্যে আছি। তবে, অনেক পাপিষ্ঠ আমাদের আশপাশে ঘুরছে। মাঠেময়দানে জাতীয় পাটি ঘুরে বেড়াচ্ছে; যারা ছাত্র-জনতার আন্দোলন বিবৃতি দিয়ে সমর্থন দিয়েছিল, মাঠে নামেনি। তারা পতিত স্বৈরাচারের সঙ্গে মিলে নির্বাচনকে বৈধতা দিয়েছিল। এখন এসব শত্রুদের পরিত্যাগ করতে হবে। আন্দোলনে সকল শহীদের পরিবারকে খুঁজে বের করে তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে রাজনৈতিক দলগুলোকে। তিনি বলেন, এই সরকারকে চাপাচাপি করা যাবে না, তাদের সস্কারের সময় দিয়ে তাদের কাজে সহায়তা করতে হবে।
নুরুল হক নুরু বলেন, এই আন্দোলন এক সময় আমরাই লিড দিয়েছিলাম। এখনকার মতো ভুক্তভোগীদের সহায়তা করতে পারিনি, এটা অত্যন্ত কষ্টের। তিনি বলেন, ধারাবাহিকভাবে এ আন্দোলনে সব শ্রেনি-পেশার মানুষের সম্পৃক্ততা সমান। গত ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদ থেকে মুক্তি পেতে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি বিএনপি জামায়াতের মতো মেজর রাজনৈতিক দলের সম্মিলিত আন্দোলনের ফল হাসিনা সরকারের বিদায়।
নুর বলেন, এখনও চক্রান্ত চলছে। পুলিশ প্রশাসনকে এই সরকার এখনও নিয়ন্ত্রণে নিতে পারেনি, এটা অত্যন্ত জরুরি। প্রসাশনকে 'মাস্ট বি ক্লিন' করতে হবে। বিচার বিভাগ এখনও নিরপেক্ষ নয়, যেখানে সুস্পষ্ট নীতিমালা প্রয়োজন। নতুন নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন দরকার। তিনি বলেন, একটি অনির্বাচিত সরকার বেশি দিন থাকলে সেখানে ফরেন ইনভেস্টমেন্ট হবে না। এজন্য নির্বাচনের সুস্পষ্ট রোডম্যাপ সামনে এনে সংস্কার কাজ দ্রুত শেষ করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিদের অন্তর্বর্তী সরকারে অন্তর্ভুক্ত করে তাদের সঙ্গে বোঝাপড়া ছাড়া সংকটের সমাধান হবে না।
বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে দেশ নতুন করে স্বাধীন হওয়ার পরে এখন পরিবর্তন কীভাবে হবে তা নিয়ে ভাবতে হবে। তবে, পরিবর্তন কারও মধ্যেই তেমন হয়নি। ক্ষমতার অপব্যবহার কমাতে হবে, অতীতের স্বৈরাচার শাসকের পতন থেকে শিক্ষা নিতে হবে। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোকে নতুন খোলসে আত্মপ্রকাশ করতে হবে, যদি তারা গণতন্ত্রকে দেশে আবার ফিরিয়ে আনতে চায়।