পিলখানা হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত দাবি সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল মইনের
২০০৯ সালে তৎকালীন বাংলাদেশ রাইফেলস (বিডিআর) সদর দপ্তর পিলখানায় সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করেছেন সেসময়ের সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) মইন ইউ আহমেদ। গত বৃহস্পতিবার (৫ সেপ্টেম্বর) নিজের ইউটিউব চ্যানেলে পোস্ট করা এক ভিডিওতে এ দাবি করেন তিনি।
এবারই প্রথম ওই হত্যাকাণ্ড নিয়ে মুখ খুললেন সাবেক এই সেনাপ্রধান। তিনি বলেন, ‘সেদিন (২৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৯) সকাল সাড়ে ৭টায় সামরিক সদর দপ্তরের দৈনন্দিন কাজ শুরু হয়। সকালে আমি সেখানে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। এমন সময় সিজিএস লেফটেন্যান্ট জেনারেল সিনহা আমার কাছে এসে বললেন, আমাদের কিছু মর্টার আছে, যেগুলো সেনাবাহিনী ব্যবহার করে না। এগুলোর গুদামজাতকরণ ও রক্ষণাবেক্ষণ আমাদের জন্য কঠিন। বিডিআর এগুলো ব্যবহার করে, তারা নিলে আমাদের উপকার হবে।’
মইন ইউ আহমেদ বলেন, “এরপর আমি বিডিআর মহাপরিচালক জেনারেল শাকিলের সাথে কথা বললে তিনি মর্টারগুলো নিতে রাজি হন। আমি বিশ্বাস করি, তিনি তখন পর্যন্ত ওই বিদ্রোহ সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। এরপর আমি আরেকটি সিজিএস মিটিংয়ে গেলাম। সকাল ৯টায় বৈঠক শুরু হয়। আমরা সবাই সেখানে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে আমার প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি কর্নেল ফিরোজ রুমে ঢুকে আমাকে বললেন, ‘পিলখানায় গোলমাল হয়েছে এবং আমাদের আপনার নির্দেশনা দরকার’। কিছুক্ষণ পর আমি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করি। কিন্তু তার ফোন ব্যস্ত ছিল।”
মইন ইউ আহমেদ বলেন, “তখন সামরিক গোয়েন্দারা আমাকে পরিস্থিতি সম্পর্কে জানায়। পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝতে পেরে আমি সময় বাঁচাতে কারও নির্দেশ ছাড়াই সেনাবাহিনীর আরেকটি ব্রিগেডকে অভিযানের জন্য প্রস্তুত হওয়ার নির্দেশ দেই। তারা অবিলম্বে ব্যবস্থা নিতে শুরু করে, যার নাম দেওয়া হয় ‘অপারেশন রিস্টোর অর্ডার’।”
সাবেক সেনাপ্রধান বলেন, “সকাল ৯টা ৪৭ মিনিটে বিডিআরের ডিজিকে (শাকিল আহমেদ) ফোনে পাওয়া যায়। তিনি আমাকে বললেন, ‘দরবার চলাকালে দুজন সশস্ত্র সৈন্য ঢুকে এবং একজন আমার পিছনে দাঁড়ায়। তখন বাইরে থেকে গুলির শব্দ আসে। সঙ্গে সঙ্গে সৈন্যরা দরবার হল ত্যাগ করে। মনে হচ্ছে সবই পরিকল্পিত এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী চলছে। তাদের ফিরিয়ে আনতে আমি সেক্টর কমান্ডার ও ব্যাটালিয়ন কমান্ডারদের পাঠিয়েছি।’ তখন আমি তাকে অপারেশনের কথা বললাম।”
মইন ইউ আহমেদ আরও বলেন, ‘সকাল ৯টা ৫৪ মিনিটে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করতে পেরেছি। এরই মধ্যে তিনি বিডিআর বিদ্রোহের অনেক তথ্য পেয়েছেন। আমি যখন তাকে অপারেশনের কথা বলি, তখন সে জানতে চায় ব্রিগেড প্রস্তুত করতে কতক্ষণ লাগবে। আমি সময়টা জানিয়ে পিলখানায় ব্রিগেড পাঠানোর অনুমতি চাইলাম। এই ক্ষেত্রে, যদিও এটি সাধারণত দীর্ঘ সময় নেয়, ৪৬তম ব্রিগেড এক ঘণ্টার মধ্যে যাত্রা শুরু করে।’
সাবেক সেনাপ্রধান বলেন, ‘এদিকে, বিদ্রোহীরা বিডিআর গেটের সামনে আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য রকেট লঞ্চার, মর্টার এবং অন্যান্য অস্ত্র মোতায়েন করেছে। ৪৬তম ব্রিগেডের প্রথম গাড়িটি বেলা ১১টায় প্রধান ফটকের কাছে আসার সঙ্গে সঙ্গে বিদ্রোহীরা একটি পিকআপ লক্ষ্য করে রকেট ছোড়ে। ঘটনাস্থলেই চালকের মৃত্যু হয়। লেফটেন্যান্ট কর্নেল শামসের তথ্যমতে, সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বেলা ১১টার মধ্যে ডিজি, ডিডিজি, কর্নেল আনিস, কর্নেল কায়সারসহ অনেক অফিসারকে গুলি করে হত্যা করা হয়। আমাদের দল সকাল ১১টার পর পৌঁছে।’
মইন ইউ আহমেদ বলেন, বিদ্রোহের সময় টিভি চ্যানেলে লাইভ কভারেজের সমালোচনা করে তৎকালীন সেনাপ্রধান বলেন, ঘটনার সময় টিভি চ্যানেলের সরাসরি সম্প্রচার বিডিআর বিদ্রোহ ছড়িয়ে দিতে নেতিবাচক ভূমিকা পালন করেছিল।
সাবেক সেনাপ্রধান বলেন, ‘সকাল ১০টার আগে ক্যাপ্টেন শফিক তার নেতৃত্বে ৩৫৫ জন র্যাব সদস্য নিয়ে পিলখানায় পৌঁছেন। এ সময় তিনি তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে পিলখানায় প্রবেশের অনুমতি চাইলেও তিনি তা পাননি। তাকে অনুমতি দেওয়া হলে পরিস্থিতি মোকাবিলা করা সহজ হতো এবং এতটা ক্ষতি হতো না।’
মইন ইউ আহমেদ বলেন, ‘বেলা ১১টা ৪৫ মিনিটের দিকে পিএসও এএফডি জানায়, সরকার রাজনৈতিকভাবে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছে। বিদ্রোহীরা দাবি করেছে, যেকোনো আলোচনার আগে ওই এলাকা থেকে সেনাবাহিনীকে প্রত্যাহার করতে হবে। তাদের সঙ্গে সমঝোতা না হলে সামরিক অভিযান চালানো হবে। দুপুর ১২টার দিকে পিএসও আমাকে ফোন করেন এবং জরুরি ভিত্তিতে যমুনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে বলেন। দুপুর ১টার দিকে সাবেক মন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক ও হুইপ মির্জা আজম আলোচনার জন্য পিলখানায় যান।’
জেনারেল (অব.) মইন ইউ আহমেদ বলেন, “আমি যমুনায় যাওয়ার এক ঘণ্টা পর বিমান ও নৌবাহিনীর প্রধানরা সেখানে যান। অর্থাৎ আমি যাওয়ার পর তাদেরকে সেখানে যেতে বলা হয়েছিল। দীর্ঘ সময় পর তারা সেখানে পৌঁছালে আমরা জানতে পারি, সাবেক মন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক ও হুইপ মির্জা আজম একদল বিদ্রোহী নিয়ে যমুনায় আসছেন এবং তারা (বিদ্রোহীরা) সাধারণ ক্ষমার দাবি জানিয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী (শেখ হাসিনা) বলেছেন, ‘বিদ্রোহীদের যদি কিছু বলার প্রয়োজন হয়, আমাদের বলা উচিত।’ তখন আমি তাকে বলেছিলাম, ‘অনেককে হত্যা করা হয়েছে। তাদের কোনো দাবিই মানা যাবে না। আপনি তাদের আগে বলুন, অফিসারদের হত্যা এখনই বন্ধ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, আটক সবাইকে অবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে। তৃতীয়ত, অস্ত্রধারী বিদ্রোহীদের আত্মসমর্পণ করতে হবে। চতুর্থত, সাধারণ ক্ষমার প্রশ্নই নেই’।”
ঘটনার তদন্তে সেনাবাহিনী সরকারের সহায়তা পায়নি উল্লেখ করে জেনারেল (অব.) মইন ইউ আহমেদ বলেন, ‘আমি যখন বিডিআর বিদ্রোহের তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিলাম, তখন আমাকে বলা হয়েছিল যে সরকার যখন এই বিষয়টি তদন্ত করছে তখন আমাদের কেন করার দরকার? এই তদন্ত পরিচালনার জন্য সরকারের কাছ থেকে যে সহায়তার প্রয়োজন ছিল তা আমরা পাইনি।’
সাবেক সেনাপ্রধান বলেন, ‘সেনাবাহিনীর তদন্ত কমিটির প্রধান ছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (বর্তমান স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা)। তিনি তার কাজ ঠিকমতো করতে পারেননি, কারণ অনেকেই জেলে ছিলেন, অনেককে জিজ্ঞাসাবাদ করা যায়নি। তিনি (জাহাঙ্গীর আলম) আমার কাছে এসে তার সমস্যার কথা কয়েকবার বলেছেন।’
মইন ইউ আহমেদ বলেন, ‘তিনি (জাহাঙ্গীর আলম) এখন স্বরাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা হয়েছেন। আশা করি, তিনি এই তদন্ত কমিটি পুনর্গঠন করে দোষীদের খুঁজে বের করতে সক্ষম হবেন। সরকার গঠনের পর আমি তাকে এ ব্যাপারে অনুরোধ করেছিলাম।’
মইন ইউ আহমেদ তার ভিডিওতে পিলখানা হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করেছেন। তিনি আরও বলেন, বিডিআর বিদ্রোহ নিয়ে তার লেখা বই শিগগিরই প্রকাশিত হবে।
২০০৯ সালের ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পিলখানায় তৎকালীন বাংলাদেশ রাইফেলস (বিডিআর) সদর দপ্তর, বর্তমানে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদর দপ্তরে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে নৃশংস গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল। পিলখানা হত্যাকাণ্ডে ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ মোট ৭৪ জন নিহত হন। অনেকেই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ নেতাদের পিলখানা হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা হিসেবে আখ্যায়িত করছেন। এবার বর্বরোচিত এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে মুখ খুললেন তৎকালীন সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমেদ।