এই মুহূর্তে আইনের শাসন দরকার : রুমিন ফারহানা
ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী। সাবেক সংসদ সদস্য এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির আন্তর্জাতিকবিষয়ক সহসম্পাদক। তাঁর সঙ্গে একান্তে কথা বলেছেন এনটিভি অনলাইনের বিশেষ প্রতিনিধি জাহিদুর রহমান।
এনটিভি অনলাইন : ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর কেটে গেছে দুই মাস। এই সময়ে পরিবর্তনটা কেমন দেখছেন?
রুমিন ফারহানা : সামাজিক, রাজনৈতিক এমনটি অর্থনৈতিক দিক দিয়ে আমরা অস্থির সময় পার করছি। অর্থনীতির অস্থিরতা পুরাতন। রাজনৈতিক দলগুলোর নিজেদের মধ্যে একটা বিশাল ঘাটতি। কোনো দল চাইছে দ্রুত নির্বাচন, আবার কেউ চাইছে একটি যুক্তিসঙ্গত এবং গ্রহণযোগ্য সংস্কারের পরে নির্বাচন। আবার সরকারের তরফেও দেখা যাচ্ছে দোটানা। কেউ বলছেন, ১৮ মাসের মধ্যে নির্বাচন হবে। আবার কেউ বলছেন, না। এটা সরকারের বক্তব্য নয়। সরকার সময় সুযোগ বুঝে তার মতো নির্বাচন দেবে। যেটা নিয়ে এক ধরনের ধোঁয়াশা এবং অস্পষ্টতা বেশি লক্ষণীয়। এবার আসি সামাজিক অস্থিরতার প্রসঙ্গে। ‘মব জাস্টিস’ বলে যে বিষয়টি প্রচলিত সেটাকে আমি আসলে বলি, ‘মব ইন জাস্টিস’। সেটি অনেক অনেক বেড়ে গেছে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি ঘটনায় দেখা গেছে, অনেকে আক্রান্ত হয়েছেন। ন্যূনতম আইনের শাসন থাকলে কিন্তু এমন প্রাণহানি ঘটার কথা নয়। এটা অগ্রহণযোগ্য। আবার অর্থনৈতিক দিকে তাকালে দেখা যাচ্ছে, ভঙ্গুর চিত্র। বিগত স্বৈরাচারী সরকার গত ১৫ বছরে ১৯ লাখ কোটি টাকা ঋণ করেছে। বিদেশে পাচার করেছে লাখ লাখ কোটি টাকা। সুতরাং সব মিলিয়ে একটি টালমাটাল অস্থিরতা তো আছেই।
এনটিভি অনলাইন : সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের কথা বলছে। বলা যায়, সংস্কারের বিষয়টিকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। আপনার কাছে কী মনে হয়? সংস্কারের জন্য এ সরকার কতটা সময় পেতে পারে?
রুমিন ফারহানা : এ সরকার স্বচ্ছতা এবং স্পষ্টতার ক্ষেত্রে কিন্তু কিছুটা পেছনেই পড়ে আছে। কারণ আমরা জানি না, সংস্কার বলতে আসলে এই সরকার কী বোঝাতে চাইছে? নাগরিক হিসেবে সরকারের কাছে আমার জিজ্ঞাসা, আপনারা স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘ মেয়াদে কী কী সংস্কার করতে চান? সেটার জন্য সময়টা আপনারা কতটা নিতে চান?
বিশেষায়িতভাবে বলতে গেলে, স্বল্প, মধ্যম এবং দীর্ঘমেয়াদে কোন বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিয়ে সংস্কার করা হবে? এটাকে আগে পরিষ্কার করা দরকার। নইলে ১০০ কোটি বার সংস্কারের কথা বলেও কিন্তু কোনো লাভ নেই। কারণ আমরা কেউ বুঝতে পারছি না, সরকার আসলে সংস্কার বলতে কী বোঝাতে চাচ্ছে? হ্যাঁ, কয়েকটি কমিশন গঠিত হয়েছে। আমাদের জানা নেই, সেই কমিশনগুলো এখনও কাজ শুরু করেছে কি না? যারা এসব কমিশনের দায়িত্বে আছেন তাঁরাও যদি নিজেদের কাজগুলো নিয়ে আমাদের সামনে পরিষ্কার ধারণা দিতেন, আমার মনে হয় ভালো হতো।
এনটিভি অনলাইন : নির্বাচন বিষয়ে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর চাহিদা বিষয়টাকে আপনি কোন দৃষ্টিতে দেখেন?
রুমিন ফারহানা : দুটো দল যার যার সুবিধা অনুযায়ী বলছে। বিএনপির হিসাব করে দেখছে, যত তাড়াতাড়ি নির্বাচন হবে তত বেশি আসন নিয়ে তার সংসদে যাওয়া সম্ভব হবে। সময় যত গড়াবে বিএনপি হয়তো ভাবছে, তার আসন সংখ্যা কমলেও কমতে পারে। আবার জামায়াতে ইসলামী ভাবছে, দ্রুত নির্বাচন হলে তাদের যতগুলো আসন পাওয়া সম্ভব দেরিতে হলে তার চেয়ে আসন সংখ্যা বাড়বে। আমার মনে হয়, যে যার দৃষ্টিকোণ থেকে সুবিধা অনুযায়ী সময়টা ঠিক করছে।
এনটিভি অনলাইন : অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময় দুই মাস অতিক্রম হলো। এই সময়টাতে সরকার কতটা জন প্রত্যাশা পূরণ করতে পেরেছে বলে আপনার মনে হয়?
রুমিন ফারহানা : দেখুন, এ দেশের জন্য ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে যারা শহীদ হয়েছেন তাদের সবার লক্ষ্য ছিল এক। কিন্তু প্রত্যাশা ছিল ভিন্ন ভিন্ন। ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানে প্রতিষ্ঠিত এই সরকারের পেছনে ঠিক তেমনি অসংখ্য মানুষের আত্মত্যাগ আছে। তাদের প্রত্যেকের লক্ষ্যটাও এ ক্ষেত্রে অভিন্ন ছিল। কিন্তু প্রত্যাশাটা ছিল ভিন্ন। কারো স্বপ্ন হয়তো খুব সামান্য। সে তার সন্তানকে আস্ত একটি ডিম পাতে তুলে দিতে চায়। তবে একটি ডিমের দাম যদি ১৫ টাকা হয়, তাহলে কিন্তু তার স্বপ্ন পূরণ হবে না। আবার কারও স্বপ্ন হয়তো কোনো কোটা দিয়ে নয় বরং মেধা দিয়ে যতটুকু যাওয়া সম্ভব ততটুকু যেতে চাওয়া। অনেকের চাওয়া, মামা চাচা ধরে নয়। নিজের যোগ্যতায় যতটুকু যাওয়া যায় ততটুকুই লক্ষ্যে পৌঁছানো। কারো স্বপ্ন, অর্থনীতিতে সাম্যের প্রতিষ্ঠা। কেউ হয়তো ভাবছে, ক্রোনি ক্যাপিটালিজম বা ‘স্বজনতোষী পুঁজিবাদ’ থেকে মুক্তি। এই যে প্রত্যেকের বিস্তৃত এবং ব্যাপক যে স্বপ্ন—মাত্র দুই মাসের মধ্যে আমরা এর প্রতিফলন দেখতে পাব কিংবা আশা করব—এটা মনে হয় একটু বেশি হয়ে যায়। তবে আমাদের যদি মনে হতো যাত্রাটা অন্তত শুরু হয়েছে, সেটা যদি দেখতে পেতাম—তাহলে অন্তত একটা ভরসার জায়গা তৈরি হতো।
এনটিভি অনলাইন : মামলা নিয়ে বেশ আলোচনা চলছে। আইনজ্ঞ হিসেবে আপনার কাছে কী মনে হয়? এই মামলাগুলো বিচারের পথকে কতটা বিতর্কমুক্ত রাখবে?
রুমিন ফারহানা : আমি জানি না। ১৫ বছরের একটা পরিস্থিতির মধ্যে থাকার ফলেই কিনা। আসলে অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, আমরা সবাইই এক একজন ‘শেখ হাসিনা’। আমরা সবাই চাই সবকিছু ‘আমার’ মতো করে নিয়ন্ত্রণ করতে। শেখ হাসিনার আমলেও ভিন্নমতের সবার বিরুদ্ধে ঢালাও মামলা হয়েছে। সে সময় আমরা এটার প্রতিবাদ করেছি। একই জিনিস এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি। পাড়া, ওয়ার্ড, থানা পর্যায়ে পর্যন্ত যারা ভিন্নমতের আছে তাদের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে। বেশিরভাগ মামলায় শেখ হাসিনাকে খুনের আসামি করা হচ্ছে। আরে ভাই, বিশ্বাসযোগ্য পাঁচটা মামলাই তো যথেষ্ট। তথ্য প্রমাণ সঠিক থাকলে একটি মামলাই যথেষ্ট। সে জায়গায় আমি পাঁচটা বললাম। দেখা গেল, ৫০০ মামলা হয়েছে। এতে হচ্ছে কি, মামলা তার গুরুত্ব হারাচ্ছে। সচেতন মহলের পাশাপাশি জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবেও প্রমাণ হচ্ছে, এই মামলাগুলোর তেমন কোনো ভিত্তি নেই। একটা সময় কি হবে জানেন? ওই যে একটা কথা আছে না, এক মাঘে শীত যায় না। সময় পাল্টাবে, তখন আজকে যাদের বিরুদ্ধে মামলাগুলো হচ্ছে, তারা সুবিধাটা নেবে। তখন তারাই বলবে, এই মামলাগুলোর কোনো ভিত্তি ছিল না। তারা বলবে, আমরা বিরোধীপক্ষে ছিলাম বলেই আমাদের নামে এভাবে মামলা হয়েছে। আমার প্রশ্ন, কেন এভাবে তাদের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে? যে বাংলাদেশের নতুন স্বপ্ন নিয়ে যাত্রা শুরু হলো, সেই বাংলাদেশের ১৫ বছর ধরে যেভাবে যা করা হতো, আজকে সেভাবেই তা করা হচ্ছে। তাহলে এই অভ্যুত্থানের অর্থ কী দাঁড়ায়?
এনটিভি এনটিভি : এ বিষয়ে বিএনপিরও তো একটা বড় ভূমিকা থাকার কথা?
রুমিন ফারহানা : মনে করুন, আপনার সঙ্গে আমার জমি নিয়ে বিরোধ রয়েছে। আমি আপনার বিরুদ্ধে মামলা দিলাম। এখানে বিএনপির কি বা করার আছে? অন্য দলেরই বা কী করার আছে? আবার যারা দীর্ঘদিন এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল, তাদের কাছ থেকে সুযোগ-সুবিধা নিয়ে তার বিরুদ্ধে মামলা হলো না। অথচ নিরপরাধ একজনের বিরুদ্ধে মামলা হলো। এখানে দলগুলো কতটা ভূমিকা রাখতে পারে সেটা আমার জানা নেই। তবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাটা পালন করতে পারে, মামলা যে নেয় অর্থাৎ পুলিশ। আমি মনে করি নিঃসন্দেহে যাচাই-বাছাই করেই মামলা নেওয়া উচিত।
এনটিভি অনলাইন : অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কিন্তু একটা কথা বলছে তারা কারো বিরুদ্ধে মামলা দিচ্ছে না।
রুমিন ফারহানা : সরকার কেন মামলা করছে না? সেটা কিন্তু আমারও প্রশ্ন? কারণ এই সরকারের কাছে আমাদের অনেক প্রত্যাশা। এটা তো অস্বীকার করার উপায় নেই। গত জুলাই এবং আগস্ট মাসে গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে—এটাতো অস্বীকার করার উপায় নেই, গত ১৬ বছরে ৮ শতাধিক মানুষ গুম হয়েছে। যে সময়টাতে বিচার বহির্ভূতভাবে হত্যা করা হয়েছে আড়াই থেকে তিন হাজার মানুষকে। এটাও তো অস্বীকার করার উপায় নেই যে, পুলিশ হেফাজতে অসংখ্য মানুষ নির্যাতিত হয়েছে, মারা গেছে। তো মামলা হবে না কেন? মামলা তো হওয়া উচিত।
কিন্তু কার বিরুদ্ধে কোন মামলা হবে? সেটা নির্ধারণ করার জরুরি। যার বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়ের মামলা হওয়া উচিত তার বিরুদ্ধে যদি আপনি খুনের মামলা দেন তার মানে আপনি তো তাকে বাঁচিয়ে দিলেন। ট্রায়ালে গিয়ে তো ওই মামলা টিকবে না। এস আলম কিংবা সালমান এফ রহমানদের বিরুদ্ধে আপনি তো টাকা পাচারের মামলা দিবেন। তারা যে ঋণ খেলাপি সে বিষয়ে মামলা দিবেন। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে যদি আপনি হত্যাসহ অন্য ফৌজদারি অপরাধের মামলা দেন তাহলে তো হলো না।
এনটিভি অনলাইন : এভাবে মামলা করার ক্ষেত্রে বাদীপক্ষকে ভবিষ্যতে কী ধরনের আইনগত জটিলতা কিংবা বিড়ম্বনার মুখে পড়তে হতে পারে?
রুমিন ফারহানা : জিঘাংসা থেকে যেসব মামলা হয়েছে, যদি বিচার বিভাগ স্বাধীন হয়, নিঃসন্দেহে এসব মামলা টিকবে না। এর চাইতে বড় উদ্বেগের কারণ হচ্ছে, এর মাধ্যমে একটি বাজে বার্তা যাচ্ছে। আগে পুলিশ যা করত, এখনও পুলিশ তাই করছে। পার্থক্য বলতে, নাম পাল্টাচ্ছে। চেহারা পাল্টাচ্ছে। এমন চলতে থাকলে অভ্যুত্থানে এত মানুষের আত্মত্যাগ নিঃসন্দেহে সবাইকে প্রশ্নের মুখে ফেলবে।
এনটিভি অনলাইন : ৫ আগস্টের আগে আপনার কি কখনো মনে হয়েছিল, সরকার আর টিকবে না?
রুমিন ফারহানা : শেখ হাসিনাই ভাবেনি আমি কোত্থেকে ভাবব? তবে হ্যাঁ, যখন দেখেছি, বাচ্চাদের উপরে নির্বিচারে গুলি চলছে, সরকারি এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা একেবারে পথে নেমে গেছে—তাদের অভিভাবকরাও তাদের বাধা দিচ্ছেন না, বরং তাদের সঙ্গেই পথে নামছেন—তখন একটা বার্তা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছিল, তাদের মনোভাবটা এমন ছিল ডু অর ডাই। অর্থাৎ মৃত্যুর জন্যই তাদের প্রস্তুতি ছিল।
এনটিভি অনলাইন : ৯০-এর স্বৈরাচারী সরকারকে উৎখাতে যে গণঅভ্যুত্থান হলো তখন মানুষের যে আকাঙ্ক্ষা তা পূরণ হয়নি। ২০২৪ সালে এসেও মানুষের একই আকাঙ্ক্ষা—কতটা পূর্ণ হবে বলে আপনি মনে করেন?
রুমিন ফারহানা : যে যার জায়গা থেকে সততা নিয়ে কাজ করলে আমার মনে হয় না এ অভ্যুত্থান বৃথা যাবে। আমি একটা কথাই বলব, প্রতিটা দিন মূল্যবান। একটা দিন চলে যাওয়া মানে, একটু একটু করে পিছিয়ে যাওয়া। সুতরাং কাজটা এখনই শুরু করা উচিত এবং সময় ক্ষেপণ না করে এই মুহূর্তেই তা করা উচিত।
এনটিভি অনলাইন : ভবিষ্যৎ বাংলাদেশকে আপনি কেমন দেখতে চান?
রুমিন ফারহানা : আমার স্বপ্ন মানবিক ও সাম্যের বাংলাদেশ। আমার স্বপ্ন বৈষম্যহীন বাংলাদেশ।
এনটিভি অনলাইন : আপনাকে ধন্যবাদ।
রুমিন ফারহানা : এনটিভি অনলাইনকেও অসংখ্য ধন্যবাদ।