সিন্ডিকেট ও কমিশন বাণিজ্যে অঢেল সম্পদের মালিক খাদ্যমন্ত্রী
বিভিন্ন হাটে চট পেতে বসে ধান কিনতেন। সে ধান গরুর গাড়িতে করে বিভিন্ন মোকামে পৌঁছে দিতেন। এভাবেই হয়ে ওঠেন ধান-চালের ব্যাপারী। তিনি সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার। জীবনের শুরুর গল্পটা ছিল এমনই।
আশির দশকে নিজ এলাকা নওগাঁর নিয়ামতপুরে একটি ধান ভাঙার কল বসান সাধন চন্দ্র মজুমদার। এরপর আস্তে আস্তে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৮৪ সালে প্রথমে হাজীনগর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান এবং পরে নিয়ামতপুর উপজেলা চেয়ারম্যান হন। ২০০৮ সালে প্রথমবার নওগাঁ-১ (নিয়ামতপুর-পোরশা-সাপাহার) আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর টানা চারবার হয়েছেন সংসদ সদস্য। হাজিনগর ইউনিয়ন পরিষদের ইউপি চেয়ারম্যান থেকে হয়েছেন আওয়ামী লীগ সরকারের দুই বারের খাদ্যমন্ত্রী।
বদলি বাণিজ্য, চালের বাজারের সিন্ডিকেট, টেন্ডারের কমিশন, জলমহাল দখল, আধিপত্য বিস্তারসহ ভিন্ন ভিন্ন পন্থায় আয় করেছেন শত শত কোটি টাকা। জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার সুবাদে সড়ক বিভাগ, এলজিইডি, কৃষি বিভাগ, খাসপুকুর, সরকারি জমি ও বিভিন্ন নিয়োগ বাণিজ্য ছিল তাঁর দখলে। পরিবারের সদস্যরা তাঁর ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে জেলায় গড়ে তোলেন মজুমদারির সাম্রাজ্য।
ছোট ভাই মনোরঞ্জন মজুমদার মনা ছিলের সিন্ডিকেটের মুল হোতা। সাধন মজুমদারের মেয়ে সোমা মজুমদার, কাবেরী মজুমদার, কৃষ্ণা মজুমদার, তৃণা মজুমদার, তিন জামাতা আবু নাসের বেগ (মাগুড়ার সাবেক ডিসি), নাসিম আহম্মেদ (নওগাঁ পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক) ও শোভন দাস (পেশা পাইলট), তাঁর ভাতিজা রাজেশ মজুমদার, সিলেটের আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক সাইফুল ইসলাম, দিনাজপুরের পুলহাট খাদ্যগুদামের সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুস সালাম মিলে গড়ে তোলেন প্রতাপশালী এক সিন্ডিকেট। টাকার বিনিময়ে সব ধরনের অনিয়মকে নিয়মে পরিণত করত এই সিন্ডিকেট। আর এই সিন্ডিকেটের গ্রিন সিগনাল পেলে সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সাধন মজুমদার কোন পদে কাকে কোথায় পদায়ন করতে হবে সেই আদেশ দিতেন।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, সব অপকর্মের সমন্বয় করতেন ভাতিজা রাজেশ মজুমদার। তিনি ছিলেন খাদ্যমন্ত্রীর সহকারী; বসতেন মন্ত্রণালয়ে। সঙ্গে ছিলেন মন্ত্রীর জামাতা আবু নাসের বেগ ও মন্ত্রীর এপিএসের দায়িত্বে ছিলেন ছোট মেয়ে তৃণা মজুমদার। টাকার বিনিময়ে দপ্তরের যেকোনো পদায়ন, বদলি, বরাদ্দ সবকিছু মন্ত্রণালয়ে বসে করতেন তাঁরাই। টাকার লেনদেন হতো সাবেক খাদ্যমন্ত্রীর ছোট ভাই মনোরঞ্জন মজুমদার মনার বাসায়। মন্ত্রীর নিয়ামতপুর উপজেলার শিবপুর গ্রামের বাড়িতে এবং ঢাকায় বেইলি রোডের সরকারি বাসায়। রাজশাহী বিভাগের বদলি, পদায়নের টাকা আসত সরাসরি মনোরঞ্জন মজুমদার মনার কাছে আর রংপুর বিভাগের বদলি, পদায়নের টাকা আসত দিনাজপুরের পুলহাট খাদ্যগুদামের সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুস সালামের মাধ্যমে। বিনিময়ে সিন্ডিকেটের সদস্য পুলহাট খাদ্যগুদামের সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুস সালাম কয়েক কোটি টাকা খরচ করে নওগাঁর সেবাশ্রমপাড়ায় গড়ে তুলেছেন সাত তলা ভবন। প্রতিটি ফ্লোরে দুটি করে ইউনিট আছে।
বদলি-পদায়ন
খাদ্য বিভাগে যেকোনো জেলার সদরসহ লোভনীয় খাদ্যগুদামে বদলি ও পাদায়নের ক্ষেত্রে এই সিন্ডিকেট ২০ লাখ থেকে কোটি টাকা টাকা পর্যন্ত নিতেন বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। আর এসব লোভনীয় পদের মধ্যে ছিল আরসি ফুড (রিজিওনাল কন্ট্রোলার অব ফুড), ডিসি ফুড (ডিস্ট্রিক্ট কন্ট্রোলার অব ফুড), সিএসডির (কেন্দ্রীয় খাদ্য সংরক্ষণাগার) ম্যানেজার, এসএমও (চলাচল ও সংরক্ষন কর্মকর্তা) এবং ওসি এলএসডি (খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা)।
নওগাঁ, বগুড়া, দিনাজপুর, কুষ্টিয়া জেলাকে ধান-চালের মূল মোকাম বলা হয়ে থাকে। এসব জেলায় খাদ্য গুদামে পদায়নের ক্ষেত্রে বিপুল অঙ্কের টাকা নিত সাধন মজুমদারের পারিবারিক সিন্ডিকেটের সদস্যরা। এ ছাড়া ধান-চাল বেশি উৎপাদন হয় এমন তালিকাভুক্ত জেলার বাইরেও যেকোনো স্থান ও পদে পদায়নের জন্য নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা দিতে হতো সাধন মজুমদারের পারিবারিক সিন্ডিকেটকে। খাদ্য বিভাগের একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী সূত্র এনটিভি অনলাইনকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে।
সূত্র মতে, গত সাড়ে পাঁচ বছরে সাধন মজুমদার খাদ্যমন্ত্রী থাকাকালীন তাঁর ছোট ভাই বদলি বাণিজ্য সিন্ডিকেটের মূল হোতা মনোরঞ্জন মজুমদার মনা এবং মন্ত্রীর জামাতা আবু নাসের বেগ নাসিম আহম্মেদ (নওগাঁ পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক) ও শোভন দাস, তাঁর ভাতিজা রাজেশ মজুমদারের মাধ্যমে সব থেকে বেশি সুবিধা নিয়েছেন সিলেটের বর্তমান আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক সাইফুল ইসলাম। তিনি এর আগে উত্তরাঞ্চলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বগুড়া, দিনাজপুর ও সিরাজগঞ্জ জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক ছিলেন। তিন জেলায় সাবেক খাদ্যমন্ত্রীর আমলে চাকরি করে আয় করেছেন কোটি কোটি টাকা। যার ফলশ্রুতিতে কোটি টাকা খরচ করে পদোন্নতি নিয়ে হয়েছেন সিলেট বিভাগের আঞ্চলিক খাদ্য কর্মকর্তা (আরসি ফুড)। মূলত খাদ্য বিভাগে যারা জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের পদে চাকরি করেন তাঁদের মূল টার্গেট থাকে নওগাঁ, দিনাজপুর, বগুড়া জেলার খাদ্য নিয়ন্ত্রক হওয়া।
খাদ্যমন্ত্রীর সিন্ডিকেট ঠিক রাখার জন্য যখন যাকে যেখানে প্রয়োজন সেখানে লোভনীয় পোস্টিং দেওয়া হয়েছে। যার কারণে তদবির বাণিজ্যের সুবিধার্থে খাদ্য পরিদর্শক আব্দুস সালামকে নওগাঁর মহাদেবপুর থেকে বদলি করা হয় রংপুর বিভাগের দিনাজপুর জেলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য গুদাম পুলহাটে। খাদ্যমন্ত্রীর এই সিন্ডিকেট গত সাড়ে পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বশেষ চলতি বছরের (এপ্রিল-মে মাসে) কোটি টাকার বিনিময়ে কুমিল্লা থেকে দিনাজপুরের জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক হিসেবে সুবির নাথ চৌধুরী এবং ২০ লাখ টাকায় নওগাঁর মহাদেবপুর খাদ্য গুদামে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে জাহেদুর রহমানকে পদায়ন করেন। এ ছাড়া, ২০ লাখ টাকায় নওগাঁ সদর উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক গোলাম মওলা, সাধন চন্দ্র মজুমদার খাদ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথমে ৫০ লাখ টাকায় বগুড়ার সান্তাহার সিএসডির ম্যানেজার পদে দুলাল উদ্দিন খান, তারপর ৫০ লাখ টাকায় হারুনুর রশিদকে সান্তাহার সিএসডির ম্যানেজার পদে পদায়ন করা হয়। ফরিদপুরের অম্বিকাপুর খাদ্য গুদামের এসএমও বিকাশ চন্দ্র প্রামানিককে পদায়ন করা হয় ৩০ লাখ টাকায়। এর আগে বিকাশ চন্দ্র প্রামানিক ৫০ লাখ টাকা খরচ করে পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার মুলাডুলি সিএসডির ম্যানেজার পদে দুই বছর চাকরি করেন। ৫০ লাখ টাকায় দিনাজপুর সিএসডির ম্যানেজার দেলোয়ার হোসেন, পাবনার ঈশ্বরদী এলএসডির এসএমও হিসেবে ৩০ লাখ টাকায় মিজানুর রহমান কাঞ্চন, পাবনার ঈশ্বরদী মুলাডুলি সিএসডির ম্যানেজার হিসেবে ৫০ লাখ টাকায় আব্দুল হান্নানকে পদায়ন করা হয়।
এছাড়া খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে ৫০ লাখ টাকায় দিনাজপুরের পুলহাট খাদ্যগুদামে আব্দুস সালাম দুই বছর দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে ৫০ লাখ টাকায় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পেয়ে ভবতোষ কুমার বিশ্বাস পুলহাটে বহাল তবিয়তে দায়িত্ব পালন করছেন। বগুড়া সদর খাদ্যগুদামে ৩০ লাখ টাকায় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে ইউসুফ আলী, তালোড়া খাদ্যগুদামে ২০ লাখ টাকায় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে তন্ময় কুমার বিশ্বাস, সান্তাহার খাদ্যগুদামে ২০ লাখ টাকায় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে আজিজুল ইসলাম. নওগাঁ সদর খাদ্য গুদামের ৫০ লাখ টাকায় সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাসুদ রানা (বর্তমানের টেকনিক্যাল ইন্সপেক্টর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ) দায়িত্ব পান। চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর খাদ্যগুদামে ৩০ লাখ টাকায় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে আবু এরশাদ দায়িত্ব পান। জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদের সঠিক হিসেবে দিতে না পারায় তাঁর নামে দুদকেও মামলা চলছে।
নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার সরস্বতীপুর খাদ্যগুদামে ২০ লাখ টাকায় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে পরেশ চন্দ্র মাহাতো, জয়পুরহাটের পাঁচবিবি খাদ্যগুদামে ২০ লাখ টাকায় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে শাহনাজ পারভীন দায়িত্ব পান। গত সাড়ে পাঁচ বছরে এ রকম শতাধিক পোস্টিং দিয়েছে সাধন মজুমদারের পারিবারিক এই সিন্ডিকেট। দেশের পট পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু তারপরও এই ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা বহাল তবিয়তে এখনও দাপটের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন।
এ বিষয়ে জানতে এসব খাদ্য কর্মকর্তার সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তাঁরা সব অভিযোগ অস্বীকার করে জানান, মেধা এবং যোগ্যতার ভিত্তিতে তারা পোষ্টিং পেয়েছেন। কেউ কেউ আবার বলেছেন, তারা কোন দিন খাদ্যমন্ত্রী সাধন মজুমদার, তার ভাই মনোরঞ্জন মজুমদার মনা ও জামাতাদের দেখেননি এবং চেনেনও না।
আবার টাকা খেয়েও কাজ করেননি এমন বিস্তর অভিযোগও আছে সাধন চন্দ্রের সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে। ভুক্তভোগী নিয়ামতপুর উপজেলার ব্যবসায়ী আবুল কাশেম বলেন, ‘আমার ছোট ভাইকে পদায়নের কথা বলে খাদ্যমন্ত্রীর ভাই মনা মজুমদার ৩০ লাখ টাকা নিয়েছিলেন। গত পাঁচ বছরেও পদায়ন হয়নি। টাকাও ফেরত পাইনি। একদিন টাকা চাইতে গেলে হুমকি দিয়ে বলেছিলেন, কেটে পানিতে ভাসিয়ে দেবে। ভয়ে আর টাকা চাইতে যাননি তাঁরা।
সাধন মজুমদারের জীবন বৃত্তান্ত
১৯৫০ সালে নওগাঁ জেলার নিয়ামতপুর উপজেলার শিবপুর বলদাহঘাট গ্রামে নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম হয় সাধন চন্দ্র মজুমদারের। বাবা মৃত কামিনী কুমার মজমুদার ছিলেন শিবপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। সেই সময় যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো ছিল না। ভাঙাচোরা রাস্তা দিয়ে নওগাঁর নিয়ামতপুরে যেতে হতো সাধারণ মানুষকে। তখন কোনো যানবাহন ছিল না। নৌকায়, হেঁটে, সাইকেলে, ঘোড়ার গাড়ি বা গরুর গাড়িই ছিল চলাচলের অন্যতম মাধ্যম। একেবারে প্রত্যন্ত গ্রাম বলতে যা বোঝায়, তা-ই ছিল নিয়ামতপুর উপজেলা।
নওগাঁর বিভিন্ন জনের সঙ্গে কথা বলে ও পারিবারিক ভাবে জানা যায়, ১/১১-এর পর রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলে ২০০৮ সালে পোরশা, সাপাহার ও নিয়ামতপুর উপজেলা নিয়ে গঠিত নওগাঁ-১ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন সাধন চন্দ্র মজুমদার। এর আগে এই আসন থেকে আরও দুবার নির্বাচন করেও বিএনপির প্রার্থীর কাছে হেরে যান তিনি। মূলত ১/১১ এর পর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনই তাঁর জীবনে আশীর্বাদ হয়ে আসে।
সাধন চন্দ্র মজুমদারের নির্বাচনি এলাকায় মানুষের মুখে মুখে এখন ধান ব্যবসায়ী হয়েও তাঁর অঢেল সম্পদ আর টাকার গল্প। মানুষের প্রশ্ন কীভাবে রাতারাতি তিনি এত টাকার মালিক হলেন।
পোরশা উপজেলার ঘাটনগর বাজারের মিজানুর রহমান বলেন, ‘নোসনাহারপুকুর, ছয়ঘাটিপুকুরসহ বিভিন্ন এলাকার কয়েকটি পুকুর মন্ত্রীর ভাই মনা মজুমদার জোরপূর্বক দখল করে, সরকারকে রাজস্ব না দিয়ে নিজেই মালিক সেজে আবার তা লিজ দিয়ে টাকা নিজের পকেটে পুরতেন। এখনও ওই সব পুকুরে মনা মজুমদারের লোকজনই লিজ নিয়ে মাছ চাষ করছে।’
গত ৫ আগষ্ট ক্ষমতার পালাবদলের পর প্রভাবশালী খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারকে গত ৩ অক্টোবর রাত সাড়ে ৮টার দিকে ঢাকার বসুন্ধরা এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। বর্তমানে তেজগাঁও থানায় দায়ের করা ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের শিক্ষার্থী রমিজ উদ্দিন রূপকে গুলি করে হত্যা মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে এবং আদালতে সোপর্দ করে সাত দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে।
নির্বাচনি হলফনামা
সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের গত দুই সংসদ নির্বাচনে দেওয়া হলফনামা থেকে জানা যায়, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি হলফনামায় কৃষি খাত থেকে বার্ষিক আয় দেখান ৩০ হাজার টাকা। কৃষিজমির পরিমাণ দেখান লিজসহ ২৩ বিঘা। ব্যবসা থেকে আড়াই লাখ টাকা। শেয়ার, সঞ্চয়পত্র-ব্যাংক আমানত (এফডিআর) দেখান ৪৯ লাখ টাকা। নিজ নামে ব্যাংকে নগদ টাকা দেখান ২১ লাখ ৪১ হাজার ৮০৫ টাকা। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা অর্থ ছিল ১০ লাখ ৫০০ টাকা। পোস্টাল, সেভিংস, সার্টিফিকেটসহ বিভিন্ন ধরনের সঞ্চয়পত্রে বা স্থায়ী আমানতে বিনিয়োগ ৩৯ লাখ টাকা। গাড়ি ছিল দুটি। একটির দাম ১৬ লাখ ৩০ হাজার টাকা, অন্যটি (এমপি হিসেবে করমুক্ত সুযোগের) ৪১ লাখ ৬৯ হাজার টাকা। বিয়ে সূত্রে পেয়েছেন ১২ ভরি সোনা। এই হলফনাফায় তিনি সই করেন ২ ডিসেম্বর ২০১৩ সালে।
আবার ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খাদ্যমন্ত্রী হলফনামায় কৃষি খাত থেকে বার্ষিক আয় দেখান ৩৫ হাজার টাকা। ব্যবসা থেকে দুই লাখ ৯৫ হাজার টাকা। শেয়ার, সঞ্চয়পত্র-ব্যাংক আমানত (এফডিআর) দেখান এক কোটি ৮৮ লাখ ৭৯ হাজার টাকা। নিজ নামে ব্যাংকে নগদ গচ্ছিত দেখান এক কোটি ৭৪ লাখ ৪২ হাজার টাকা। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা অর্থ ছিল ২৪ লাখ ৬০ হাজার ৫০০ টাকা। পোস্টাল, সেভিং, সার্টিফিকেটসহ বিভিন্ন ধরনের সঞ্চয়পত্রে বা স্থায়ী আমানতে বিনিয়োগ ৭৫ লাখ ৬৬ হাজার ৭৮৩ টাকা। ওই নির্বাচনের সময় মাত্র একটি গাড়ির তথ্য হলফনামায় তুলে ধরেন। হলফনামা মতে, গাড়িটির মূল্য ৬৪ লাখ ৭৬ হাজার ৭৪২ টাকা। গত দুই সংসদ নির্বাচনেও ১২ ভরি স্বর্ণই দেখিয়েছেন। জমিও লিজসহ ২৩ বিঘাই দেখিয়েছেন। এ ছাড়া ১১ কাঠার একটি অকৃষি জমির কথা বলা হয়েছে, যার মূল্য ধরা হয়েছে ৩৬ লাখ ৬৪ হাজার ৯৩২ টাকা। তবে ২০১৩ সালের হলফনামায় মার্কেন্টাইল ব্যাংক নওগাঁ শাখা থেকে সিসি ঋণ দেখান ছয় লাখ ৪৪ হাজার ৩৪৮ টাকা। পরের নির্বাচনে তিনি এই ঋণটি সমন্বয় দেখান। ২০১৮ সালের হলফনামায় তিনি ছয় লাখ ৬০ হাজার টাকা সংসদ সদস্য হিসেবে সম্মানি ভাতা পাওয়ার বিষয়টি তুলে ধরেন। আয়ের উৎস অন্যান্য/এফডিআর থেকে প্রাপ্ত সুদ হিসেবে দেখান চার লাখ ১০ হাজার ৫০৯ টাকা। এর আগের নির্বাচনের হলফনামায় সেটা দেখানো হয়নি। ফ্রিজ একটি, ফ্যান তিনটি, খাট দুটি, ড্রেসিং টেবিল একটি, ডাইনিং টেবিল একটি দেখানো হলেও এসির হিসাব দেননি।
স্থানীয়রা জানান, এসব তো কাগজে-কলমের হিসাব। তবে তাঁর জীবনযাত্রা ছিল তার চেয়ে কয়েক গুণ ব্যয়বহুল। সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের হলফনামার হিসাব ধরলেও তিনি কোটি কোটি টাকার মালিক। এক সংসদ নির্বাচন থেকে অন্য সংসদ নির্বাচনের মধ্যকার সময়ের মধ্যেও তাঁর কোটি কোটি টাকার সম্পদের দেখা মেলে। দুই নির্বাচনের হলফনামায় এসব সম্পদ দৃশ্যমান হলেও অদৃশ্য সম্পদ কত আছে সেই প্রশ্ন মানুষের মুখে মুখে।
নওগাঁর নিয়ামতপুর উপজেলার আওয়ামী লীগনেতা খালেকুজ্জামান তোতা জানান, তাঁদের মূল্যায়ন না করে মন্ত্রী সাধন চন্দ্র সিন্ডিকেটলীগ তৈরি করেছিলেন। এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করেই প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিতেন। যেকোনো কাজ শুরু হলেই তাঁকে ২০ শতাংশ কমিশন দিতে হতো।
চালের বাজারে সিন্ডিকেট
সাধন চন্দ্রের ছোট ভাই মনোরঞ্জন মজুমদার ও বড় মেয়ে জামাতা পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নাসিম আহম্মেদের হাতের মুঠোয় ছিল নওগাঁ। দেশের অন্যতম ধান-চালের মোকাম নওগাঁয় দামের সামান্য হেরফের হলেই ধাক্কা লাগে চালের বাজারে। অথচ এ জেলাতেই বিভিন্ন গুদামে হতো অবৈধ ধান-চাল মজুদ। মিলারের বেশির ভাগই তাঁর আত্মীয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক চাল ব্যবসায়ী বলেন, ক্ষমতায় থাকাকালে বড় বড় মিলার গোডাউনে হাজার হাজার টন পুরোনো ধান-চাল মজুদ করে রাখত। এ সিন্ডিকেটের কারণেই চালের বাজারে কখনোই কাটেনি অস্থিরতা। এসব করে তারা শত শত কোটি টাকা লুটে নিয়েছে।
সাবেক খাদ্যমন্ত্রীর ভাই মনোরঞ্জন মজুমদার মনার চালের মিল আছে নিয়ামতপুরে। তাঁর অবাধ্য হওয়ার সুযোগই ছিল না বড় চাল ব্যবসায়ীদের। চালকল ব্যবসায়ী শফিকুল ইসলামও নিজেকে পরিচয় দিতেন আওয়ামী লীগ নেতার ঘনিষ্ঠ হিসেবে। নিয়ম বহির্ভূতভাবে ধান-চাল মজুদ রাখার অভিযোগ থাকলে কখনও তাদের বিরুদ্ধে অভিযান হয়নি। জেলায় যত অবৈধ মজুদদার রয়েছে, তাদের বেশিরভাগই মনার কারণে হয়েছেন প্রভাবশালী। চক্রটি সব সময় নিজেদের সাবেক খাদ্যমন্ত্রী ও সরকারের নীতিনির্ধারকদের ঘনিষ্ঠজন পরিচয়ে সিন্ডিকেট চালিয়েছে।
জেলা চাল কল মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন চকদার মোবাইল ফোনে জানান, চালকল মালিক গ্রুপের হিসাব অনুযায়ী, এখন জেলায় সচল চালকলের সংখ্যা ৫৭১টি। এর মধ্যে ৫৩টি অটোমেটিক ও ৫১৮টি হাসকিং মিল। এসব মিলে প্রতিদিন অন্তত দুই হাজার টন চাল উৎপাদন হয়। নওগাঁয় চালের বাজারে কোনো সিন্ডিকেট নেই। হাজার হাজার মানুষের সম্পৃক্ততা থাকলে সেখানে সিন্ডিকেট করা সম্ভব হয় না। তবে তিনি বলেন, জেলায় ইতোমধ্যে কয়েকটি করপোরেট কোম্পানি ঘাঁটি গেড়েছে। আর এসব করপোরেট কোম্পানিগুলোর মধ্যে এসিআই, সিটি গ্রুপ, আকিজ গ্রুপ, নাবিল গ্রুপ এরা সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সাধন মজুমদারের সঙ্গে যোগসাজসে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ, ধান-চাল মজুদ রেখে সিন্ডিকেট করতে পারে।
২০ শতাংশ কমিশন বাণিজ্য
রাস্তা উন্নয়ন, পাকাকরণ, সংস্কারসহ সব কাজেই ২০ শতাংশ কমিশন দিতে হতো সাধন সিন্ডিকেটকে। ঘুষের কমিশনের টাকা কম হলেই রোষানলে পড়তেন ঠিকাদাররা। সর্বশেষ সড়ক বিভাগ সদর থেকে আত্রাই, বদলগাছী ও মহাদেবপুর এবং মান্দা থেকে নিয়ামতপুর উপজেলার ছয়টি সড়কে এক হাজার ১২০ কোটি টাকার কাজ শুরু হয়। আঞ্চলিক মহাসড়ক উন্নয়নের এ প্রকল্প থেকে আগাম ২০ শতাংশ টাকা নিয়েছে সাধন সিন্ডিকেট।
এ ছাড়া কমিশন নেওয়া অন্য প্রকল্পগুলোর মধ্যে ভূমি অফিস, ফায়ার সার্ভিস স্টেশন স্থাপন, মডেল মসজিদ স্থাপন, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, হাসপাতাল বর্ধিতকরণ, থানা ও পুলিশ ব্যারাক সম্প্রসারণ প্রকল্প, জজকোর্ট সম্প্রসারণ, টিটিসির একাডেমিক ভবন নির্মাণ, খাদ্য বিভাগের গুদাম নির্মাণ, কারিগরি প্রশিক্ষণকেন্দ্র নির্মাণসহ আরও ৫০০ থেকে ৬০০ কোটি টাকার উন্নয়নকাজ উল্লেখযোগ্য।
স্থানীয়রা জানায়, সাধন চন্দ্র মজুমদারের হুকুম ছাড়া কোনো নথি নড়ার সুযোগ ছিল না। সরকারি নির্মাণকাজ, রাস্তাঘাট উন্নয়ন ছাড়াও নিয়োগ, স্কুল-কলেজের ম্যানেজিং কমিটি, জমি দখল, বাজার ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণসহ সবখানেই লাগত তাঁর অনুমোদন।
জেলার সব হাট-বাজার নামমাত্র মূল্যে ইজারা নিতেন সাধনের লোকজন। তারাই নির্মাণ করেছেন নিম্নমানের দুর্যোগ সহনীয় ঘর। এ ছাড়া জেলায় হাজার কোটি টাকার সিএসডি নির্মাণ প্রকল্প ও সাপাহারে অর্থনৈতিক জোন গড়ে তোলার পরিকল্পনায় সাধন সিন্ডিকেটের বড় ধরনের বাণিজ্য করার উদ্দেশ্য ছিল। সেখানে বেশিরভগ জমিই বায়নাসূত্রে মালিক বনে গিয়েছিল সাধন সিন্ডিকেটের সদস্যরা। কম দামে জমি কিনে বেশি দামে সরকারের কাছে বিক্রির ছক এঁকেছিল তারা। তবে দেশের পটপরিবর্তনে সে পরিকল্পনা ভেস্তে যায়।
শিবপুরের বাসিন্দারা জানায়, উত্তরাধিকার সূত্রে বাবা কামিনী কুমার মজুমদারের ধান-চালের ছোট ব্যবসা পেয়েছিলেন সাধন চন্দ্র মজুমদার। নয় ভাই-বোনের মধ্যে সাধন মজুমদার অষ্টম। তাঁদের আদি নিবাস ছিল নোয়াখালীর চৌমুহনী। ১৯৪৬ সালে সেখানে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা শুরু হলে সাধনের বাবা এখানে চলে আসেন। সাধনের জন্ম শিবপুরেই। বাবার মাত্র ৪ বিঘা ধানি জমি ছিল এলাকায়। এখন তাঁর পরিবার শত শত বিঘা জমির মালিক। এ ছাড়া নওগাঁ শহরে একাধিক বাড়ি-জমি এবং ঢাকায়ও ফ্ল্যাট রয়েছে তাঁর।
এ ব্যাপারে মনোরঞ্জন মজুমদারের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য একাধিকবার ফোন করা হলে তাঁর নম্বর, হোয়াটস অ্যাপ, মেসেঞ্জার বন্ধ পাওয়া যায়। দেশের পট পবির্তনের সাথে সাথে সাধন চন্দ্র মজুমদারের পারিবারিক সিন্ডিকেটের সদস্যরা আত্মগোপনে চলে গেছেন। তাঁরা এখন ফেরার জীবন যাপন করছেন।