‘স্বামী-স্ত্রী’ নয়, দুদেশের সম্পর্ক হবে ন্যায্যতার ভিত্তিতে, প্রত্যাশা ঢাকার
টানা সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলের শেখ হাসিনাকে নিয়ে ভারতপ্রীতির কথা বেশ চাউর ছিল। তার সরকারের মন্ত্রী, দলীয় নেতাকর্মী ও আওয়ামী বলয়ের প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিদের বক্তব্যেও ছিল যার প্রমাণ। ফলে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় রসায়ন নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গণ ছিল সরগরম। কূটনৈতিক মহলেও তার প্রভাব দেখা দিয়েছিল। সে সময়ের ক্ষমতাসীনরা নানা সময়ে নানাভাবে এ সম্পর্ককে তুলে ধরেছেন। কখনও বলেছেন ‘স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক’, কখনওবা ‘রক্তের রাখিবন্ধণে আবদ্ধ’। এমনকি, শেখ হাসিনা যখন শেষবারের মতো চীন সফরে যান, তখন তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাসান মাহমুদ বলেছিলেন, শেখ হাসিনার চীন সফরে ভারতের আপত্তি নেই। অর্থাৎ, কোথাও সফর করতে গেলেও হাসিনার লাগত ভারতের অনুমতি। শেখ হাসিনার ভাষায় দুদেশের সম্পর্ক হয়ে ওঠে সমুজ্জ্বল—ভারতকে যা দিয়েছি, আজীবন মনে রাখবে।
ভারতের সঙ্গে এ সম্পর্কের ছন্দপতন ঘটে গত ৫ আগস্ট। এদিন তীব্র ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পদচ্যুত হয়ে শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন। দিল্লীর স্বার্থ রক্ষায় উদার ও দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত বন্ধুর এমন পরিণতি ভালোভাবে নিতে পারেনি ভারত, যা দেশটির নেতাদের বক্তব্য ও বিবৃতিতে প্রকাশ পেয়েছে বহুবার। সেদেশের অনেক গণমাধ্যমে বাংলাদেশ নিয়ে মিথ্যা তথ্যে প্রচার করা হচ্ছে সংবাদ। সাম্প্রদায়িক উসকানিতে পরিপূর্ণ এসব সংবাদে সেদেশে অবস্থানকারী বাংলাদেশিদের জন্য একের পর এক তৈরি হচ্ছে অনিরাপদ পরিস্থিতি। ভাবিয়ে তুলছে আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা, কলকাতা ডেপুটি হাইকমিশনে হামলাচেষ্টার ঘটনা। এমন পরিস্থিতিতে নয়াদিল্লি থেকে নতুন বার্তা নিয়ে আসছেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিসরি। ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পালাবদলের পর বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপন ও নতুন পথরেখা তৈরিতে তার এই সফর বলে জানিয়েছে তিনি।
বিক্রম মিসরির সফরসূচি
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, আগামী ৯ ডিসেম্বর ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের ঢাকা সফরের কর্মসূচি নির্ধারিত হয়েছে। সফরের সময় তিনি পররাষ্ট্র সচিব মো. জসীম উদ্দিনের সঙ্গে একান্ত বৈঠক করবেন। এরপর দুই দেশের প্রতিনিধিদের নিয়ে আনুষ্ঠানিক বৈঠক হবে। পাশাপাশি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করবেন বিক্রম মিসরি।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধতন কর্মকর্তা এনটিভি অনলাইনকে জানিয়েছেন, গত ৫ আগস্টের পর ভারতের সচিব পর্যায়ের কোনো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার এটিই প্রথম বাংলাদেশ সফর। এরআগে অবশ্য গত ২৩ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অবসরে ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের মধ্যে বৈঠক হয়। সেই বৈঠকেও ভারতীয় পক্ষ বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে কাজ করার বিষয়ে অঙ্গীকার ব্যক্ত করে।
যা বলছে ভারতীয় গণমাধ্যম
ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের আসন্ন বাংলাদেশ সফর নিয়ে গতকাল বুধবার (৪ ডিসেম্বর) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে হিন্দুস্তান টাইমস। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিসরি আলোচনার জন্য আগামী ১০ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সফর করবেন বলে আশা করা হচ্ছে। গত আগস্টে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর সিনিয়র কোনো ভারতীয় কর্মকর্তার ঢাকায় এটিই প্রথম সফর হতে চলেছে বলে বিষয়টি সম্পর্কে অবগত ব্যক্তিরা জানিয়েছেন।
গণমাধ্যমটি বলছে, ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিসরির এই সফরটি এমন এক সময়ে হতে চলেছে যখন বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্কে অভূতপূর্ব উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। হিন্দু সংখ্যালঘুদের ওপর কথিত নিপীড়ন এবং রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে অভিযুক্ত চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেপ্তারের অভিযোগে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী কয়েকটি ভারতীয় রাজ্যে বিক্ষোভ হচ্ছে।
এ ছাড়া ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলায় অবস্থিত বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের হামলা-ভাঙচুর এবং বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা অবমাননার দায়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মঙ্গলবার ভারতীয় রাষ্ট্রদূত প্রণয় ভার্মাকে তলব করে কড়া প্রতিবাদ জানায়।
ঢাকার প্রত্যাশা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘এটা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই যে, ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর বাংলাদেশে ওপর থেকে ভারতের একচ্ছত্র আধিপত্ত ও কর্তৃত্ব অনেকখানি খর্ব হয়ে এসেছে। ভারতের বিষয়ে আমাদের নীতিতেও পরিবর্তন এসেছে, যেটা অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের বক্তব্যে প্রকাশ পাচ্ছে।’
৫ আগস্টের আগের কয়েকটি উদাহরণ দিয়ে ওই কর্মকর্তা বলেন, আপনারা অবশ্যই লক্ষ্য করেছেন, ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডের ভেতরে ঢুকে আমাদের বিজিবি জওয়ানকে গুলি করে হত্যা করে লাশ নিয়ে গিয়েছিল। এ বিষয়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কোনো প্রতিবাদ পর্যন্ত জানানো হয়নি। বাংলাদেশের স্বার্থ ক্ষুণ্ন করে ভারতের স্বার্থকে অগ্রাধিকার নিয়ে অসংখ্য প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল। ট্রানজিটসহ অনেক চুক্তি হয়েছে, যাতে বাংলাদেশের স্বার্থ পুরোপুরি উপেক্ষিত থেকেছে। শেখ হাসিনাও এসব বিষয় নিয়ে বলেছিলেন, ‘ভারতকে যা দিয়েছি, আজীবন মনে রাখবে।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও চীন সফরে যেতে হয়েছে ভারতের অনুমোদন নিয়েই, যেটা সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ সংবাদ সম্মেলনেই প্রকাশ করেছিলেন।
ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশ কী আশা করছে এমন প্রশ্নের জবাবে ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘বাংলাদেশ প্রতিবেশি হিসেবে ভারতের সঙ্গ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে আরও গিয়ে নিতেই কাজ করবে। তবে এ সম্পর্ক হবে ন্যায্যতার ভিত্তিতে। আগের মতো ‘স্বামী-স্ত্রী’র সম্পর্কের মতো নয়।
যা বলছেন উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যরা
ভারতের বাংলাদেশ নীতির সমালোচনা করে অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল গত ২ ডিসেম্বর নিজের ভেরিফাইয়েড ফেসবুক পেজে লেখেন, আমরা সমমর্যাদা আর সমানাধিকার ভিত্তিক বন্ধুত্বে বিশ্বাসী। শেখ হাসিনার সরকার বিনাভোটে ক্ষমতায় থাকার লোভে ভারত-তোষণনীতিতে বিশ্বাসী ছিল। তবে, ভারতকে বুঝতে হবে, এটা শেখ হাসিনার বাংলাদেশ নয়। এই বাংলাদেশ স্বাধীন, সার্বভৌম ও আত্নমর্যাদাশীল। এই বাংলাদেশ নির্ভীক একটি তরুণ সম্প্রদায়ের।
৩ ডিসেম্বর নৌপরিবহণ উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন ভারতের সমালোচনা করে বলেছেন, ‘অপপ্রচার চালিয়ে বাংলাদেশকে হেনস্থা করে যাচ্ছেন। মনে রাখবেন বাংলাদেশ ১৮ কোটি জনগণের দেশ। আপনাদের আশপাশের ছোট কোনো দেশ না। আপনারা আমাদের দেশের অন্য ধর্মাবলম্বীদের বিষয়ে কথা বলেন। এসব নিয়ে কথা না বলে নিজেদের দেশের দিকে নজর দেন।
তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম গতকাল বুধবার (৪ ডিসেম্বর) রাত সাড়ে ১২টার পর একটি ফেসবুক পোস্টে বলেছেন, ভারতের শাসক গোষ্ঠী বিভেদের রাজনীতি ও বাংলাদেশ-বিরোধী মিথ্যাচারে লিপ্ত রয়েছে। ভারতের শাসকগোষ্ঠী ও হিন্দুত্ববাদী শক্তিগুলো দুদেশের জনগণের মধ্যে গণতান্ত্রিক সম্পর্ক ও সম্প্রীতি চায় না। তিনি বলেন, পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও আসামের সঙ্গে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক রয়েছে, তারা আমাদের স্টেকহোল্ডার। বাংলাদেশে চলমান গণঅভ্যুত্থানের সময় কলকাতা ও দিল্লির ছাত্ররা আমাদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে শেখ হাসিনার নৃশংসতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছে।
ভারতের এই গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষেরা বাংলাদেশের বন্ধু উল্লেখ করে তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেন, তবে ভারতের শাসকগোষ্ঠী ও হিন্দুত্ববাদী শক্তিগুলো এ ধরনের গণতান্ত্রিক সম্পর্ক ও সম্প্রীতি চায় না। তারা বাংলাদেশের অভ্যুত্থান এবং এর ছাত্রদের রাজনৈতিক জাগরণকে হুমকি হিসেবে দেখে। ফলে তারা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ পোষণ করছে। তিনি আরও বলেন, ‘দিল্লি ‘সংখ্যালঘু নিপীড়ন’-এর ধুয়া তুলে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন এবং বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ও দেশ-পুনর্গঠন প্রক্রিয়া ব্যাহত করার চেষ্টা করছে। শুরু থেকেই আমরা জোর দিয়ে আসছি যে ভারত সরকারকে বাংলাদেশকে আওয়ামী লীগের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখা বন্ধ করতে হবে এবং ন্যায়, ন্যায্যতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধার ভিত্তিতে একটি নতুন সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে যা জানালেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র
বাংলাদেশ ও ভারতের পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের আসন্ন বৈঠকে আলোচনার বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রফিকুল আলম সাংবাদিকদের বলেন, এফওসিতে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের মধ্যে যত উপাদান আছে সবগুলোই রাখার চেষ্টা করা হয়। কখনও আলোচ্যসূচি ঠিক করার ক্ষেত্রে দুই পক্ষের সম্মতি লাগে। এটা এখন পর্যন্ত চলমান। তবে, সাধারণভাবে যেটা বলা যায়, বাণিজ্য আছে, কানেক্টিভিটি আছে, সীমান্ত আছে, পানি আছে। এ বিষয়গুলো আলোচনাতে থাকবে। আরও অনেক উপাদান নিশ্চয়ই আছে, এই মুহূর্তে আমার কাছে সেটা নেই।