ইচ্ছেমতো স্বজন ও দলীয় নেতাকর্মী নিয়োগ দিয়েছেন মেয়ররা

কারখানা নেই, কিন্তু মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার আছেন একজন। টিকাদান কেন্দ্র না থাকলেও আছেন ছয়জন টিকাদানকারী। এমন বেশকিছু পদের কর্মকর্তা আছেন, যাদের কাজের কোনো ক্ষেত্র নেই। যে যখন মেয়র হয়েছেন প্রয়োজনের বাইরে ইচ্ছেমতো আত্মীয়-স্বজন ও দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়োগ দিয়েছেন। অথচ ৭২ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর ২৪ মাসের বেতন বকেয়া রয়েছে। মাস্টাররোলের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে আছেন আরও ৪২ জন। অতিরিক্ত এই জনবলের ভারে ধুঁকছে নাটোরের গুরুদাসপুর পৌরসভা। প্রতিমাসে প্রায় ২৮ লাখ টাকা বেতনভাতা দিতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে কর্তৃপক্ষকে। এতে ব্যাহত হচ্ছে উন্নয়ন কার্যক্রম।
পৌরবাসীর অভিযোগ, প্রতিষ্ঠার পর মশিউর রহমান বাবলু দুই মেয়াদে, আমজাদ হোসেন এক মেয়াদ এবং সর্বশেষ শাহনেওয়াজ আলী মোল্লা তিন মেয়াদে পৌর মেয়র থাকাকালীন অসংখ্য কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছেন। তিনিই সবচেয়ে বেশি আত্মীয়স্বজন ও দলীয় কর্মী নিয়োগ দিয়েছেন। এর মধ্যে তার দুই ভাই এমদাদুল হক ও তারিকুল ইসলাম, ভাগনা কামরুল হাসান রহিম, ভগ্নিপতি, শ্যালকসহ বেশ কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী রয়েছেন। বিগত ১৫ বছরে পৌরসভার ৯টি ওয়ার্ডে কোনো উন্নয়ন না হলেও নিজেদের পকেটের উন্নতি করেছেন মেয়র, তার আস্থাভাজন কাউন্সিলর ও কতিপয় কর্মচারী। কিছু কর্মচারী বেতন না পাওয়া সত্ত্বেও করেছেন বাড়ি-গাড়ি। অথচ পৌরসভার রাস্তাঘাট, কালভার্ট, ব্রিজের কোনো উন্নয়ন হয়নি। ময়লা ফেলার জন্য নেই ডাম্পিং স্টেশনও। সড়ক, হাট-ঘাট ও নদীর তীরে পড়ে থাকা ময়লা-আবর্জনার স্তূপের দুর্গন্ধে অতিষ্ঠ মানুষ। দফায় দফায় কর বাড়িয়ে নামে-বেনামে আত্মসাৎ করা হয়েছে পৌর তহবিল। অথচ পৌরসভার ৭২ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর ২৮ মাসের বেতন বকেয়া ছিল। পৌর প্রশাসকের বিরুদ্ধে নিয়মবহির্ভূতভাবে বকেয়া বেতন পরিশোধের দাবিতে আন্দোলনে নামেন কর্মকর্তা কর্মচারীরা।
গত ১১ ফেব্রুয়ারি পৌরসভার চাঁচকৈড় হাট-বাজার প্রকাশ্য নিলামের মাধ্যমে প্রায় ২ কোটি ৩২ লাখ টাকায় ইজারা দেওয়া হয়। ওই সুযোগে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি বকেয়া বেতনের দাবিতে পৌরসভার সামনে টায়ার জ্বালিয়ে আন্দোলন করেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। আইন অনুযায়ী ইজারার ৪০ শতাংশ টাকা সংশ্লিষ্ট হাটের উন্নয়ন এবং ৫ শতাংশ টাকা দিয়ে ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধের বিধান থাকলেও সম্পূর্ণ টাকাই বেতন পরিশোধের জন্য ওই আন্দোলনে দাবি করা হয়। পৌর প্রশাসক মানবিক দিক বিবেচনায় সম্প্রতি ৪ মাসের বকেয়া বেতন পরিশোধ করেছেন।

পৌরসভা কার্যালয়ে গিয়ে জানা যায়, ১১ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ পৌরসভায় বসবাস করেন প্রায় ৩০ হাজার লোক। প্রথম শ্রেণির এই পৌরসভায় ১৫০টি পদের বিপরীতে সাধারণ শাখায় ৪২ জন ও প্রকৌশল শাখায় ৩০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছে। এ ছাড়াও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে রয়েছেন ৪২ জন। তাদের প্রতি বছর প্রায় ৩ কোটি ৪৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা বেতন দিতে হয়। অথচ এই পৌরসভায় গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রাজস্ব খাতে আয় হয়েছে ৪ কোটি ২৩ লাখ ৮৭ হাজার টাকা। তার মধ্যে ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছে ৪৬ লাখ টাকা। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন দিতে হয়েছে ৩ কোটি ৪৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং মেয়র-কাউন্সিলরদের সম্মানি ভাতাসহ বিভিন্ন কাজে বাকি টাকা ব্যয় হয়েছে।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এখন পর্যন্ত পৌরসভার রাজস্বখাতে আয় ২ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। কিন্তু বছর শেষে বেতনই গুনতে হবে প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা।
এদিকে, পৌরসভায় টিকাদানকারী কেন্দ্র না থাকলেও সুপারভাইজার পদে ২ জন, ইন্সপেক্টর ১ জন, ভিজিটর ১ জন ও টিকাদানকারী ২ জন মিলে সংশ্লিষ্ঠ পদে মোট ৬ জনকে নিয়োগ দেওয়া রয়েছে। কোনো শিল্পকলকারখানা না থাকলেও মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে একজনকে।
তবে পৌর নির্বাহী কর্মকর্তা হাসান আলী দাবি করেন, ‘তাদের টিকাদান কেন্দ্র না থাকলেও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সঙ্গে যৌথভাবে পৌরসভার নিয়োগকৃত ৬ জন কাজ করেন। আর নিজস্ব গাড়িসহ বিভিন্ন কাজে একজন ইঞ্জিনিয়ার প্রয়োজন হয়। এ ছাড়াও যারা আছেন তাদেরকে সরকারি বিধি মোতাবেক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গুরুদাসপুরে প্রয়োজনের অতিরিক্ত জনবল হলেও পার্শ্ববর্তী সিংড়া পৌরসভায় রাজস্বখাতে ৪০ জন, নাটোর সদরে ৩২ জন, বনপাড়ায় ৩১ জন, বড়াইগ্রামে ২৮ জন ও গোপালপুর পৌরসভায় ১৭ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন। এ সব পৌরসভায় নিয়মিত বেতন-ভাতা পান স্টাফরা এবং উন্নয়ন কার্যক্রমও চলে।
গুরুদাসপুর পৌর প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফাহমিদা আফরোজ বলেন, পৌরসভার কাজের জন্য দরকার হলে মাস্টাররোলে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়। কোনো কাজ না থাকলে তাদের নিয়োগে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। কিন্তু রাজস্ব খাতে বিভিন্ন সময় নিয়মানুসারে যেগুলো নিয়োগ হয়েছে, সে বিষয়ে কিছু বলার নেই। পৌরসভার বেতন দেওয়ার সামর্থ্য না থাকলে মাস্টাররোল নিয়ে চিন্তা করা হবে।
পৌর প্রশাসক আরও বলেন, দীর্ঘদিনের বকেয়া বেতন পরিশোধ করার মতো পৌর পরিষদে বাড়তি কোনো টাকা নেই। তবে চেষ্টা থাকবে প্রতিমাসের বেতন পরিশোধের। নিয়ম অনুযায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা টায়ার জ্বালিয়ে আন্দোলন করতে পারেন না। কিছু কর্মচারীকে শোকজ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তাদের আন্দোলনে যৌক্তিকতা থাকলে শোকজ নোটিশের জবাব দেবেন।